মমতাকে নিয়ে আশা ছিল, আজ আশা নেই

বাংলার মুখোমুখি

342মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের আশা ছিল। আমি সাধারণত রাজনীতিকদের নিয়ে খুব বেশি আশা করি না। কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকা যখন মমতাপন্থী হয়ে উঠেছিল দু’হাজার এগারো’র নির্বাচনের সময়, আমাকে অনুরোধ করেছিল আমি যেন মমতাকে নিয়ে ভালো কিছু লিখি। লিখেছিলাম, লেখাটি ওরা প্রথম পাতায় ছাপিয়েছিল। যে গুরুত্ব আনন্দবাজার সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়েছিল, সেটি আর দিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর গোপালকৃষ্ণ গান্ধী একবার বলেছিলেন আনন্দবাজার গোষ্ঠীটা যেমন মাথায় ওঠাতে পারে, তেমন আবার ল্যাং মারতে পারে, একে বিশ্বাস নেই। আনন্দবাজার অন্ধের মতো মমতা জপ করেছিল, এখন ল্যাং মেরেছে। গুণগান করেছে প্রচুর, এখন নিন্দে করছে। মমতাকে যতনা লোকে ভালোবেসে ভোট দিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি দিয়েছেন সিপিআইএম-কে ঘৃণা করে। ক্ষমতায় এসে মুসলিম মৌলবাদীদের তোষণ করতে শুরু করেছেন, শিল্পী-সাহিত্যিকদের টাকা দিয়ে কিনে নিতে চেষ্টা করেছেন, সারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন, আরও কত কী। মুসলিম মৌলবাদীদের খুশি করতে আমাকে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকতে দেননি, আমার টিভি সিরিয়াল নিষিদ্ধ করেছেন, আমার বই উদ্বোধন বন্ধ করে দিয়েছেন। মুসলিম ভোট পাওয়ার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠেছেন। বাংলাদেশের জামাতি ইসলামিকও নাকি সমর্থন করছেন। কালীভক্ত মানুষটা ভোটের জন্য আরও হাবিজাবি কাজ করছেন, মাথায় হিজাব পরেছেন, রমজানের সময় রোজা রাখছেন, আল্লাহর কাছে মোনাজাতের হাত উঠাচ্ছেন।

আজ আমি মমতাকে লেখা আমার সেই পুরোনো চিঠিটা দিচ্ছি, মমতার ওপর আমার সেই আশা ভরসার চিঠিটা। এখন আর আশা নেই, ভরসা নেই। শুধু হতাশায় বসতি।

“একটু অন্যরকম। নয় কেন?

পশ্চিমবঙ্গে যে ঐতিহাসিক ‘পরিবর্তন’ আসছে, তার স্বাদ রাজ্যের বাইরে থেকে নিলেও রাজ্যে বাস করা মানুষের কারো চেয়ে উত্তেজনা আমার কিছু কম নয়। হাওয়ার জোর থাকলে সে হাওয়া অনেক দূর পৌঁছোয়। রাজনীতির অংক আমি খুব বেশি বুঝি না, তবে চারদিক দেখে শুনে এই বিশ্বাস আমার জন্মেছে, শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে যে বাম-শাসন চলছে পশ্চিমবঙ্গে, সেই মহীরুহের শক্ত শেকড় উপড়ে তুলছেন। অসীম ক্ষমতাধর পুরুষ-নেতারা যা পারেননি, তা একজন সহজ সরল সাধারণ নারী পারছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে আমি নারী রাজনীতিক আরো দেখেছি, আমার দেশেই দেখেছি। তাঁদের কারো সাফল্য আমাকে এত বেশি অভিভূত করেনি। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি-বাবা এবং স্বামীর পরিচয়ে তাঁরা রাজনীতিতে এসেছেন এবং সাততাড়াতাড়ি ক্ষমতার দেখাও পেয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো আত্দীয় বা স্বজনের হাত ধরে মাঠে নামেননি। তিনি একাই লড়েছেন দীর্ঘদিন। প্রচণ্ড পাহাড়কে দুহাতে একাই সরিয়েছেন। দুর্যোগের রাতে একাই সমুদ্র পাড়ি দিয়েছেন, দুর্গম অরণ্যে একাই তিনি হেঁটেছেন, গোটা আকাশটাকেই টেনে নামিয়েছেন মাটিতে। যে কেউ হাল ছেড়ে দিত, তিনি ছাড়েননি। স্ফূলিঙ্গ তিনি, অসম্ভবকে সম্ভব করার যাদুকর। এই সাহসী, তেজস্বিনী, শক্তিময়ী নারীকে আমি অভিনন্দন জানাই। নিজে আমি বামপন্থায় বিশ্বাসী হয়েও জানাই। আসলে সত্যি কথা বলতে, বাম-নেতাদের সঙ্গে বিরোধ থাকলেও ভারতীয় বাম-নীতির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ বা নীতির বড় কোনো বিরোধ আছে বলে আমি মনে করি না। তিনি সাধারণ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য- এসব নিয়েও যেমন ভাবছেন, উন্নয়নের পথে বাম-শাসকরা যেমন হাঁটতে চেয়েছিলেন, তিনিও সে পথে হাঁটবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে যা ক্রমেই দুর্লভ হয়ে উঠছে, এবং মানুষ যা প্রাণপণে পেতে চাইছে, দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতি এবং সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ, তিনি পণ করেছেন, দেবেন। বামপন্থী নেতাদের কিছু ভুল, কিছু অপরাধ, অকারণ কিছু দম্ভ মানুষকে আজ অন্যদিকে মুখ ফেরাতে বাধ্য করেছে। বাংলার মানুষ বরাবরই কমবেশি বামপন্থী মনোভাবের হলেও তারা আজ ভিন্ন মানুষকে দেখতে চাইছে ক্ষমতায়। তার মানে এই নয় যে, রাজনীতির খোলনলচে পাল্টে তারা চরম কোনো ডানপন্থী শাসক বা সাম্প্রদায়িক শাসন চাইছে। বাংলার অধিকাংশ মানুষ, আমি বিশ্বাস করি, এখনো আগের মতোই ধর্মনিরপেক্ষ, আগের মতোই সমতা আর সমানাধিকারে বিশ্বাসী, অন্যায় আর অনাচারের প্রতিবাদে এখনো মুখর। ভারতীয় রাজনীতিকে যদিও ডানে বামে ভাগ করা হয়েছে, তবে নাম বাদ দিয়ে নীতির দিকে তাকালে, সব রাজনৈতিক দলকে এক ধরনের ‘নরমপন্থী ডান’ বলেই আমার মনে হয়।

মা, মাটি, মানুষ- এই তিনটি শব্দ আমার খুব প্রিয়। এই শব্দগুলো স্লোগান হিসেবে ব্যবহার হওয়ার বহু আগে থেকেই আমার কবিতায় বারবার এসেছে। আমার মা বেঁচে নেই। তিনি ছিলেন নিতান্তই এক অসহায় অত্যাচারিত নারী। আমার মা’র মতো অনেক মা এবং অনেক মেয়েই এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নির্যাতিত। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, বধূহত্যা, যৌনদাসত্ব, নারীপাচার এসবের কিছুই সমাজ থেকে দূর হয়নি। জানি অসহায় মেয়েদের রক্ষা করার আইন আছে দেশে। কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ কি খুব বেশি হয়? মেয়েদের সম্পত্তি পাওয়ার অধিকার আছে আইনে, কিন্তু কজন মেয়েকে সেই অধিকার সত্যিকার ভোগ করতে দেওয়া হয়! মেয়েরা শিক্ষিত এবং স্বনির্ভর হলেও পুরোনো নারীবিরোধী সংস্কার আর কুসংস্কারের কারণে এখনো স্বামী এবং সমাজের সম্পত্তি হয়ে, এখনো ভোগের সামগ্রী হয়ে, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হয়ে বেঁচে থাকতে বাধ্য হয়। কিছু উচ্চমধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজের মেয়েরা স্বাধীনতা ভোগ করলেও বেশির ভাগ মেয়েই দরিদ্র, স্বাধীনতা কাকে বলে এখনো জানে না। ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, নন্দিগ্রাম আর সিঙ্গুরের মেয়েরা দেখিয়েছে, তারাও লড়তে জানে অধিকারের দাবিতে, তারাও প্রতিবাদ করতে জানে। কিন্তু যে নিরীহ দরিদ্র প্রতারিত মেয়েদের যৌনদাসী বানানো হয়েছে, তারা? যে শিশু আর বালিকা প্রতিদিন বিক্রি হচ্ছে পতিতালয়ে, তারা? শত প্রতিবাদ করেও তো তারা অন্ধকার গলির বীভৎসতা থেকে মুক্তি পায় না! তারাও মা, তারাও এই মাটিরই মানুষ। তারাও আমাদের বোন, তারাও আমাদের কন্যা। আমার আশা এবং স্বপ্ন, মহীয়সী মমতা ক্ষমতায় এসে মেয়েদের যৌনদাসত্ব ঘোচাবেন; যেন বাকি জীবন তারা মাথা উঁচু করে নিজের সম্মান নিয়ে বাঁচতে পারে, পুনর্বাসনের এমন একটি ব্যবস্থা তিনি করবেন। শরীর বিক্রির জন্য নয়। জীবন লাঞ্ছিত হওয়ার জন্য নয়। প্রতিদিন অচেনা পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত, অসম্মানিত, অপমানিত, নির্যাতিত, নিগৃহীত হওয়ার জন্য জীবন নয়। অনেকে পতিতাপ্রথা টিকিয়ে রাখতে চায় এই বলে যে, পৃথিবীর প্রাচীনতম ‘পেশা’ এটি। না, ‘পেশা’ নয়, পতিতাবৃত্তি পৃথিবীর প্রাচীনতম নারীনির্যাতন। পুরোনো হোক, নতুন হোক, কোনো যুক্তিতেই নারী নির্যাতনকে কোনো সভ্য সমাজ মেনে নিতে পারে না। ক্রীতদাসপ্রথা আর পতিতাপ্রথার মূলে আছে খাঁটি দাসত্ব। শুধু পরিচয়টা দু ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে হয়। পতিতাপ্রথার জন্য দরকার যৌন-পরিচয়, আর ক্রীতদাসপ্রথার জন্য বর্ণ-পরিচয়। ক্রীতদাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটেছে, পতিতাপ্রথার বিলুপ্তি না ঘটার কোনো কারণ নেই।

এ কথা খুব দুঃখজনক হলেও ঠিক, সমাজের বেশির ভাগ মেয়েই নিজের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন নয়। দেশের আদমশুমারি তথ্য এবার বড় বিপদসংকেত বাজিয়েছে, মেয়েসংখ্যা কমছে। না, এ ভাবার কোনো কারণ নেই যে কমছে গ্রামেগঞ্জে, অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে। কমছে শহরের শিক্ষিত শ্রেণীতে। এভাবে কন্যাভ্রূণহত্যা চলতে থাকলে দেশে মেয়ে বলতে কিছু হয়তো আর থাকবে না। যতদিন নারী এবং পুরুষ উভয়ে নারীর অধিকারের ব্যাপারে সচেতন না হচ্ছে, ততদিন আইন প্রয়োগ করেও নারী নির্যাতন বন্ধ করা যাবে না। সামাজিক এবং পারিবারিক পুরোনো সব রীতি এবং সংস্কারের বিরুদ্ধে নারী যেন প্রতিবাদ করতে পারে, আত্দসম্মান এবং আত্দবিশ্বাস যেন বৃদ্ধি পায়, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অজ্ঞানতা, পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত হয়- তার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সামাজিক আন্দোলনে নারীদের সংঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতে পারেন তিনি।

আমি এই দেশের নাগরিক নই, কিন্তু ভালোবাসি বলেই এই দেশে বাস করি, আর সুস্থ সুন্দর সমতার সমাজের স্বপ্ন দেখি, ভালোবাসি বলেই দেখি। আজ সতেরো বছর আমি আমার দেশ থেকে নির্বাসিত। দেশ ক্রমশ দূরে সরেছে, অস্পষ্ট হয়েছে স্মৃতি, হারিয়ে গেছে যা ফেলে এসেছি সব। ভারতবর্ষকেই আমি আমার দেশ বলে মানি। ভারতীয় উপমহাদেশে মৌলবাদের যে নৃশংস তাণ্ডব চলে প্রায়ই, দুর্ভাগ্যবশত তার শিকার আমি। এই মৌলবাদ নারীর অধিকার এবং মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বড় একটি অশুভ শক্তি, এ কথা যে কোনো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই স্বীকার করবেন। সব ধর্মের মৌলবাদই শিক্ষা, সচেতনতা, সুস্থতা, প্রগতি, মুক্তবুদ্ধি এবং যুক্তির বিরুদ্ধে খড়গহস্তে দাঁড়ায়। এ সময় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিকের প্রয়োজন খুব। আজ যদি ধর্মীয় মৌলবাদীদের সঙ্গে রাজনীতিকরা আপোস করেন, তবে গণতন্ত্রই হবে সবচেয়ে বেশি অপমানিত। গণতন্ত্র তো কেবল ভোট দেওয়া নয়। গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে পড়ে সব নারী পুরুষ প্রত্যেকের নিরাপত্তা, ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ধর্মীয় মৌলবাদীদের তোষণ করার প্রবণতা খুব বেশি। অনেক সময় রীতিমতো তোষণের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। নির্বাচনে জয়লাভ করে আমার বিশ্বাস, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সব ধর্মের মৌলবাদকেই নিরস্ত্র এবং নিরস্ত করবেন। পঁয়ত্রিশ বছর ক্ষমতায় থেকে বামপন্থী নেতাদের যা করা উচিত ছিল, যা তাঁরা করেননি, তা নতুন এই নারী নেত্রী করবেন। মৌলবাদের ভুক্তভোগী নারীর চেয়ে বেশি তো আর কেউ নয়!

বাংলাদেশেও রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে, পুরোনো শাসকের অরাজকতার দিন আর নেই। কিন্তু আমাকে সে দেশে বাস করার অনুমতি দিতে মনোভাবের যে পরিবর্তন প্রয়োজন সেই পরিবর্তনের কোনো আভাস এখনো নেই। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশ নয়। সত্যিকার পরিবর্তন পশ্চিমবঙ্গে ঘটবে আমার বিশ্বাস। মায়ের মুখে হাসি ফুটবে, কারো পায়ের তলার মাটি কেউ কেড়ে নেবে না, মাটি উর্বর হবে আরো, মানুষ নিরাপদে, নিশ্চিন্তে, সুখে স্বস্তিতে বাস করবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আশা করবো তিনি আমাকে, এই বাঙালি লেখককে বাংলায় ঠাঁই দেবেন। বামপন্থী সরকারের কোনো অন্যায়কেই তিনি মেনে নেননি। তবে এক লেখককে বিনা অপরাধে বাংলা থেকে উচ্ছেদ করাকে তিনি কেন মেনে নেবেন! নারীর অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা আর বাকস্বাধীনতার পক্ষে যে লেখক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে লড়াই করছে, তার কেন বাংলায় বাস করার অনুমতি জুটবে না, যখন বাংলা শাসন করবেন এক নির্ভীক লড়াকু নারী! কে বলেছে শুধু আশায় বসতি আমাদের! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সত্যিকার পরিবর্তন ঘটাবেন- এ শুধু আর আশা নয়, স্বপ্ন নয়। এ এখন দৃঢ় বিশ্বাস, আমার, আমাদের।”

source: bd-pratidin.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *