ঢাকা: বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভানেত্রী ইয়াসমীন হোসেন শরীরের একেক জায়গায় হাত দেন আর বলেন, এই যে দেখেন স্প্লিন্টার। বললেন, এগুলো সারা শরীরে ঘুরে বেড়ায়। কোথাও ঢুকতে আর্চওয়ে পার হতে গেলে আওয়াজে সবাই চমকে যান। তখন বলতে হয়, শরীরে স্প্লিন্টার ও পায়ে লোহার রড লাগানো, এমন শব্দ করবেই।
দেড় দশক আগে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট, ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা ও হত্যাযজ্ঞের ঘটনার সাক্ষী ইয়াসমীন। বললেন, সেদিনের যে ভয়াবহতা, তা কেউ চাইলেও ভুলতে পারবে না। আর শরীরের ব্যথাতো সে কথা জীবনভর মনে করিয়ে দেবে। তাঁর পায়ের নিচের অংশে আগুন লেগে গিয়েছিল। পরনের সালোয়ার পুড়ে গেছে। পা অবশ, ব্যথা বুঝতে পারছেন না। জ্ঞান হারাননি তখনো।
মঙ্গলবার পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের হেমন্ত দাস রোডে ইয়াসমীন হোসেনের ভাইয়ের বাসায় বসে কথা হয়। তাঁর পায়ের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। খুঁড়িয়ে হাঁটেন। পায়ের এক নখ দেখিয়ে বললেন, মনে হয় পচন ধরেছে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর চিকিৎসকেরা দুই পা কেটে ফেলতে চেয়েছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত তা কাটতে হয়নি। কিন্তু ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বছরের পর বছর। হাতে স্প্লিন্টার থাকায় গরম কিছু ধরতে পারেন না। ফলে রান্না ঘরে ঢোকা হয় না তাঁর।
গ্রেনেড হামলার পর দলের পক্ষ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসা খরচ পেয়েছেন ইয়াসমীন হোসেন। তবে তারপর চিকিৎসা খরচ চালাচ্ছেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা। এক সময় নিজের দলের কাছে কিছু চাননি। পরে ইয়াসমীন তাঁর সার্বিক পরিস্থিতির কথা জানিয়ে দলের কাছে আবেদন করেছেন দুবার। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে আবেদনের কোনো উত্তর পাননি।
কথা বলার একপর্যায়ে ইয়াসমীন হোসেন আক্ষেপ করে বললেন, ‘আমার অনেক বড় চুল ছিল। গ্রেনেড হামলার সময় চুলগুলো রক্তে জট লেগে যায়। পরে চুলগুলো কেটে ফেলতে হয়। হামলার পর আমার শরীরের যে এক্স-রে রিপোর্ট, তা আকাশের অসংখ্য তারার মতো ছিল, একটু পরপর শুধু স্প্লিন্টারের দাগ। আমার যে ব্যাগ সঙ্গে ছিল তাতে অসংখ্য ফুটো। চাবির রিং পর্যন্ত ছিদ্র হয়ে গিয়েছিল। রক্তমাখা জামাটা ছোট বোন সহ্য করতে না পেরে ফেলে দিয়েছিল।’
২০০৪ সালে ইয়াসমীন হোসেন বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদিকার দায়িত্ব পালন করছিলেন। জানালেন, ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মাঠঘাটে আন্দোলন করেই এ পর্যায়ে এসেছেন। দলের ভেতরে ‘স্পষ্টভাষী’ বলে একধরনের বদনামও আছে।
ঘটনার দিনের বর্ণনা দিয়ে ইয়াসমীন বললেন, ‘নেত্রী শেখ হাসিনা যে ট্রাকে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তার কাছেই নিচে বসা ছিলাম। নেত্রীকে লক্ষ্য করে প্রথম যে গ্রেনেড ছোড়া হয়, তা আমার আর আইভি আপার (আইভি রহমান) পায়ের কাছে পড়ে। আমি আর আইভি আপা তিন থেকে সাড়ে তিন ফুট দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ি। তাকিয়ে দেখলাম আইভি আপার পা নেই। আপা নিজেও মনে হয় তা দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেননি, স্ট্রোক করেন।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ রাজধানীর কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পর ভারতে ২২ দিন চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন ইয়াসমীন। তবে চিকিৎসকের কাছে দৌড়ানো বন্ধ হয়নি। গত ১৫ বছরে তা চলছেই। বললেন, ‘পরিচিত অনেকেই মারা যান গ্রেনেড হামলায়। হামলার পর আদা চাচাকে দেখি। লাশের স্তূপ দেখি। কোনো সমাবেশে নেত্রী বক্তব্য দিলে অনেক সাধারণ মানুষ তা শোনার জন্য আসেন। তাই যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের মধ্যে অপরিচিতরাও ছিলেন। সেই সময়ের স্টিল ছবিগুলো দেখলে ভয়াবহতা বুঝতে পারি। পরের দিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে আইভি আপা আর আমার ছবি প্রথম পাতায় ছাপা হয়েছিল।’
ইয়াসমীন বললেন, ‘গ্রেনেড হামলার পর অনেকেই ঘটনার সাক্ষী বলে আলাদা সম্মান করেন। দীর্ঘদিন পর পটুয়াখালী গেলে একজন বয়স্ক লোক এসে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে চান। গ্রেনেড হামলার পর বিমানে করে ভারতে যাওয়ার সময় পাইলট থেকে শুরু করে সবাই আলাদা সম্মান করেন আমাদের। এসবের জন্য সব কষ্ট দূর হয়ে যায়। তবে মাঝেমধ্যেই মনে হয়, গ্রেনেড হামলার পর কতজন বেঁচে আছে বা মরে গেছে কে জানে?’
পুরান ঢাকার শাঁখারীবাজারের বাসিন্দা অঞ্জলি সরকারের সঙ্গে ইয়াসমীনের প্রতিনিয়ত যোগাযোগ হয়। একজন আরেকজনের বিপদে পাশে দাঁড়ান। ইয়াসমীন হোসেনের বাসায় বসেই কথা হলো অঞ্জলি সরকারের সঙ্গে।
অঞ্জলি সরকার গ্রেনেড হামলায় মাথায় বেশি আঘাত পেয়েছিলেন। মাথা থেকে স্প্লিন্টার বের করা সম্ভব হয়নি। ঘটনার সময় শুধু তিনটি বিকট শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন, তারপর জ্ঞান হারান। অনেকগুলো হাসপাতালে নেওয়া হয় তাঁকে। এখন পর্যন্ত সেভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। রাস্তাঘাট মনে রাখতে পারেন না। কথা ভুলে যান। আক্ষেপ করে বললেন, ‘একসময় মিছিল–মিটিং করে গুলিস্তান মাতায় রাখতাম, সেই আমার আজ এই অবস্থা। মিছিল-মিটিংয়ের কথা শুনি, কিন্তু যাইতে তো পারি না।’
অঞ্জলি সরকার সংরক্ষিত আসনে ওয়ার্ড কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেছেন। শারীরিক সমস্যার কারণেই হয়তো বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকার পরও কমিটি থেকে অঞ্জলি সরকারের নাম কাটা গেছে। মুখে মুখে উপদেষ্টার পদ দেওয়ার কথা বলা হলেও তার কোনো নজির পাননি। ফলে একধরনের ক্ষোভ কাজ করে। গ্রেনেড হামলার পর তিন লাখ টাকা এবং দলের নেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে একবার ২০ হাজার টাকা পেয়েছিলেন বলে জানালেন অঞ্জলি সরকার।
অঞ্জলি সরকার বললেন, ‘আইভি আপা বললেন, যাইও না।’ তার একটু পরেই ঘটনা ঘটে।
শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রায় ৭০ বছর বয়সী অঞ্জলি সরকার বললেন, ‘নেত্রী না বাঁচলে আমিও বাঁচতাম না। গ্রেনেড হামলার কয়েক মাস আগেই স্বামী মারা গিয়েছিলেন। মেয়ের বাচ্চা হয়েছে। সে নিজেকে সামলাবে না, আমাকে দেখবে? তারপরও পরিবারের সদস্যরা আমার জন্য করেছে, কিন্তু নেত্রী সরাসরি অনেককে নির্দেশ দিয়েছেন হাসপাতালে আমাকে দেখার জন্য। আর আইভি আপা ছিলেন আমার গার্জিয়ান, আমি তো আমার গার্জিয়ানই হারাই ফেলছি।’
রাতে পাগুলো পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়
মোহাম্মদপুরের হুমায়ুন রোডের বাসায় বসে কথা হয় খুরশীদা বেবীর সঙ্গে। এত বছর পরও তিনি রাতের বেলা ঘুমাতে পারেন না। বললেন, প্রায় প্রতি রাতেই পাগুলো পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়। অবশ লাগে। জ্বালাপোড়া করে।
খুরশীদা জানালেন, গ্রেনেড হামলার পর তিন বছর ক্রাচ ছাড়া হাঁটতে পারেননি। তাঁর স্বামী হুমায়ুন কবীর খান মারা যান ২০১১ সালে। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার সময় বিরোধীদলীয় নেত্রী এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুরশীদা বেবীর একমাত্র মেয়ের পড়াশোনা, চাকরিসহ বিভিন্ন বিষয়েই খেয়াল রেখেছেন বলে কৃতজ্ঞতা জানালেন খুরশীদা।
বর্তমানে মহিলা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করা খুরশীদা বললেন, গ্রেনেড হামলার পর বাঁচবেন সে বিশ্বাস ছিল না। তখন কমিটিতে সদস্য হিসেবে ছিলেন। ১৯৯১ সাল থেকেই তিনি সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে খুরশীদা বললেন, ‘বাসা থেকেই বলে গিয়েছিলাম আইভি আপার সঙ্গে থাকব। আইভি আপার সঙ্গে সবাই থাকতে চাইতেন, এতে ছবি এবং ভিডিওতে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নেত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ শেষের দিকে। পেছনের দিকে গিয়ে দাঁড়াব বলে চিন্তা করছিলাম। তারপর যে কী হলো নিজেও বলতে পারি না। কতজনের যে পায়ের নিচে চাপা পড়ি তার হিসাব নেই। মাথাসহ সারা শরীরেই স্প্রিন্টার। কয়েকজন মিলে আমাকে ভ্যানে তুলে দেয়। কয়েক হাসপাতাল ঘুরতে হয়। পিঠের একটি স্প্রিন্টার পেকে গিয়েছিল, পরে অস্ত্রোপচার করে বের করা হয়। শরীরে এখনো কত জায়গায় স্প্রিন্টার আছে তা নিজেও জানি না। আর এ পর্যন্ত চিকিৎসার পেছনে কত খরচ হয়েছে তাও জানি না।’
গ্রেনেড হামলার পরও মিছিল–মিটিং থেমে নেই খুরশীদার। ভয় তাড়া করে কি না—এমন প্রশ্নের উত্তরে খুরশীদা বললেন, ‘ভয়ের কী আছে?’
‘গ্রেনেড হামলার পর শেখ হাসিনা কাউকে কিছু দেননি—এ কথা কেউ বললে তা হবে মিথ্যা বলা। নেত্রী কর্মীদের সব সময় মূল্যায়ন করেন,’ বললেন খুরশীদা।