ঢাকা: বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালোবাসা আর গভীর শোকাবহ পরিবেশে জাতি স্মরণ করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। গতকাল বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে লাখো মানুষ সমবেত হন রাজধানীর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে তারা জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। ১৫ই আগস্ট শহীদ হওয়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের কবরেও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন সর্বস্তরের মানুষ। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতেও ছিল শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া মানুষের ভিড়। জাতীয় শোক দিবসে সারা দেশে পালিত হয়েছে নানা কর্মসূচি। এর মধ্যে ছিল শ্রদ্ধা নিবেদন, শোক র্যালি , আলোচনা সভা, কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিল। শোক দিবসের কর্মসূচিতে উচ্চারিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের ফিরিয়ে আনার দাবি।
দিবসটি উপলক্ষে সকাল সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তারা ১ মিনিট দাঁড়িয়ে নিরবতা পালন এবং দোয়া ও মোনাজাত করেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দলের কেন্দ্রীয় নেতা এবং মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর সর্বস্তরের মানুষের জন্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বর চত্বর উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। শোক দিবস উপলক্ষে বৃহষ্পতিবার ভোরে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ দলের ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন ইউনিট কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত এবং কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ভবন ও বিদেশস্থ বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশনে শোক দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা সরাসরি সমপ্রচারসহ বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার এবং সংবাদপত্রসমূহ বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। সকালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীসহ সর্বস্তরের মানুষ জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণের মাধ্যমে তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিজড়িত ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু ভবনে গিয়ে পঁচাত্তরের ১৫ই আগস্টের কালরাতে ওই ভবনের যে সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে ছিল, সেখানে গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে দেন। পরে তিনি ওই ভবনের একটি কক্ষে বসে কিছু সময় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল তার সঙ্গে ছিলেন। এরপর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়ক থেকে প্রধানমন্ত্রী বনানী কবরস্থানে যান। যেখানে ১৫ই আগস্ট নৃশংসভাবে নিহত তার মা, ভাই, পরিবারের অন্য সদস্য ও আত্মীয়দের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সেখানে শহীদদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করে ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাত করা হয়। আওয়ামী লীগ ও এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ বনানী কবরস্থানে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া যান। সেখানে বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এসময় বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে। অনুষ্ঠানে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল গার্ড অব অনার প্রদান করে। পরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। সেখানে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী এ মিলাদ মাহ্ফিলে অংশ নেন। এ সময় মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। এদিকে সকাল সাড়ে ১১ টায় রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে ১৫ আগস্ট নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দুস্থ ও গরীব মানুষের মধ্যে খাবার বিতরণ করা হয়। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনেসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দরিদ্রদের মধ্যে খাবার বিতরণের ব্যবস্থা করে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনগুলো। এদিকে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে সারা দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়। এছাড়াও আওয়ামী যুবলীগ, শ্রমিক লীগ,ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধুর ৪৪তম শাহাদাত বার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভা ও দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ করে। সকালে তথ্যসচিব আবদুল মালেকের নেতৃত্বে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সকল সংস্থা ও শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ জাতীয় শোক দিবসে ঢাকায় ধানমন্ডিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা: এদিকে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সকাল ১০টায় শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে ফাতেহা পাঠ ও বিশেষ মোনাজাতে অংশ নেন তিনি। সকাল ১১টায় মাজার কমপ্লেক্স মসজিদ প্রাঙ্গণে দোয়া অনুষ্ঠানে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, সরকারি উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। এসময় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হক, দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমীর হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, মুহাম্মদ ফারুক খান, সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শাহজাহান খান, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ও শেখ হেলাল উদ্দীন উপস্থিত ছিলেন। এদিকে সমাধিসৌধের মূল স্তম্ভ, বঙ্গবন্ধু ভবন, মুক্তমঞ্চ, সংগ্রহশালা, মসজিদ, বকুলতলা চত্বর এলাকায় শোভাবর্ধন করা হয়। ঢাকা থেকে আসার পথে গোপালগঞ্জের প্রবেশ দ্বার মুকসুদপুর থেকে টুঙ্গিপাড়া জাতির পিতার সমাধিস্থল পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার রাস্তায় কালো কাপড় দিয়ে বানানো হয় শত শত তোরণ। রাস্তার পাশে টানানো হয় কালো পতাকা।
বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার: কাদের
বিদেশে পালিয়ে থাকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। গতকাল সকালে বনানী কবরস্থানে ১৫ই আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সাংবাদিকদের এ কথা জানান সেতুমন্ত্রী। বলেন,আজকের এই দিনে আমাদের শপথ বঙ্গবন্ধুর যে খুনিদের আজও বিচারের রায় কার্যকর হয়নি, যারা লুকিয়ে আছে, পালিয়ে আছে, তাদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা এবং তার জন্য শেখ হাসিনার সরকার কূটনৈতিক প্রয়াস আরও জোরদার করেছে। তিনি বলেন, আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কজনক, রক্তাক্ত, ট্র্যাজেডির দিন ১৯৭৫ সালের এ দিন। আজকের এই দিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা, মহান স্থপতি ও বাংলাদেশের মানচিত্রের রূপকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শাহাদৎ বরণ করেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, আজকের দিনের শপথ, আমরা বঙ্গবন্ধুর সততা ও আদর্শে বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলবো। সামপ্রদায়িক বিষ-বৃক্ষকে মূল উৎপাটন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠিত করবো।