ঢাকা: এই তো গেল ঈদুল ফিতরের সময়েই বাবা-মা আর ছোট বোনের সঙ্গে কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিল ১১ বছরের রাইয়ান সরকার। ঈদের নামাজ পড়েছিল সেখানকারই মসজিদে। প্রিয় মেজ ফুফু শিল্পীর দেওয়া লাল টি-শার্ট বেশ পছন্দ হয়েছিল তার। তাই সেবারের ঈদে শুধু সেই টি-শার্টই পরেছিল সে। ঈদ উপলক্ষে পাওয়া অন্য সবক’টা নতুন পোশাকই তুলে রেখেছিল আলমারিতে। মাকে বলেছিল, অন্য পোশাকগুলো পরবে পরের ঈদে।
কিন্তু এবার ঈদুল আজহা কেন- কখনই রাইয়ান এসব পোশাক আর পরতে পারবে না। ডেঙ্গু জ্বরে সে যে হারিয়ে গেছে পৃথিবী থেকে। শোক তাই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তার আত্মীয়স্বজন সবাইকে। সন্তানকে হারিয়ে পাগলপ্রায় মা। যে বাড়িতে সন্তানকে হারিয়েছেন, সেই বাড়িতেই আর ওঠেননি মোমিন সরকার ও জান্নাত আরা জাহান দম্পতি। মোহাম্মদপুর শেখেরটেকের ভাড়া বাসা ছেড়ে তারা এখন .একমাত্র মেয়ে ছয় বছর বয়সী মালিহা বিনতে সরকারকে নিয়ে রয়েছেন মিরপুরে এক স্বজনের বাড়িতে। কারণ ওই বাসার যেদিকেই তাকাচ্ছেন তারা, সেদিকেই জ্বলজ্বল করছে রাইয়ানের স্মৃতি।
মোমিন সরকার সমকালকে বলেন, “মেয়েকে হাসপাতাল থেকে আধাঘণ্টার জন্য ওই বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ঘরের প্রতিটা দেয়াল আর জায়গাজুড়ে ছেলের স্মৃতি। ও ক্রিকেট খেলতে পছন্দ করত। বিশেষ করে ‘বল ক্যাচ’। ফলে দেয়াল, আলমারি সবখানেই ছেলের ছোড়া বলের দাগ। এসব দেখে রাইয়ানের মা কান্নায় ভেঙে পড়ে। তাই বেশিক্ষণ আর থাকিনি।” তিনি জানান, মেয়ের লেখাপড়ার সুবিধার্থে মোহাম্মদপুরেই নতুন ভাড়া বাসা খুঁজছেন। নতুন বাড়িতে চেষ্টা করবেন জীবনের স্বাভাবিক নিয়মে বেঁচে থাকতে। ডেঙ্গু আক্রান্ত আরেক সন্তান মালিহার মধ্যেই হারানো ছেলে রাইয়ানকে খুঁজে নেবেন তারা।
শুধু রাইয়ানই নয়, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে। অবশ্য তাদের মধ্যে ২৫ হাজার চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল ছেড়েছেন। এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এ পর্যন্ত ২৩ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে। প্রিয়জনকে হারিয়ে কোনো পরিবারেই এখনও শোকের ছায়া কাটেনি। কারোর মাঝেই নেই ঈদের আনন্দ।
হাসপাতালে ঈদ শান্তার পরিবারের :ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে একমাত্র মেয়ে ফাতেমা আক্তার শান্তাকে হারিয়েছেন হাজারীবাগের বাসিন্দা মোহাম্মদ শামছুদ্দিন মিয়া ও আকলিমা বেগম দম্পতি। মেয়েকে দাফনও করাতে পারেননি শান্তার বাবা ও একমাত্র ভাই তানভীর আহমেদ। কারণ তখন তারাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শ্যামলী বক্ষব্যাধি হাসপাতালের ৪২১ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। শান্তার মৃত্যুর পরের দিন থেকে তার মাও একই হাসপাতালে মহিলা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। চার সদস্যের পরিবারের একজন আর এই পৃথিবীতে নেই। সব মিলিয়ে আসন্ন কোরবানির ঈদে শান্তার বাবা, মা ও ভাই তিনজনকেই হাসপাতালে থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। কারণ তাদেরও শারীরিক অবস্থা ভালো নেই।
শান্তার চাচাতো ভাই রাকিব বলেন, ‘শান্তাকে হারিয়ে বাড়ির কেউই এখন ভালো নেই। তার বাবা-মা ও ভাইও একই রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসকরা এখনও ছাড়পত্র দেননি। তাই বাড়ি ফিরতে পারছেন না কেউ।’ শান্তা তাদের অনেক আদরের বোন ছিল জানিয়ে তিনি জানান, চাচা-চাচি ও ভাই অসুস্থ হওয়ায় পুরো চিকিৎসার সময় তিনি তাদের পাশে ছিলেন। চিকিৎসকদের অবহেলা, পরীক্ষার ফল পেতে দেরি হওয়া, এ ছাড়া রোগীর সামনেই চিকিৎসকের হতাশাজনক কথা তাকেও অনেকটা মানসিকভাবে দুর্বল করে দেয়। তিনি বলেন, “বাংলাদেশ মেডিকেলের একজন চিকিৎসক শান্তার সামনেই যখন বলেন, ‘রোগীর অবস্থা ভালো নয়। তাড়াতাড়ি ভর্তি করান’, তখন থেকেই শান্তার ব্লাড প্রেশার কমতে শুরু করে।” চিকিৎসকরা এ ধরনের আচরণ না করলে অনেক রোগীই সুস্থ হতে পারবে বলে জানান তিনি।
শান্তা ইডেন মহিলা কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। গত রোববার (৪ আগস্ট) সকালে ঝিকাতলার জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন তিনি। পরে সোমবার গাজীপুরের কাশিমপুরে তাদের গ্রামের বাড়িতে শান্তাকে দাফন করা হয়।
মাকে ছেড়ে ছোট্ট তাহরিয়ার প্রথম ঈদ :এক বছর আট মাস বয়সী জাসিয়া জাফরিন তাহরিয়া এবার জীবনের প্রথম ঈদ করতে চলেছে মাকে ছাড়া। মায়ের আদরের অভাব যেন বুঝতে না পারে, সে জন্য তাহরিয়ার বাবা নতুন পোশাক আর খেলনা কিনে দিয়েছেন তাকে।
তাহরিয়ার মা পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) এসআই কোহিনুর বেগম নীলা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ৩০ জুলাই রাতে মোহাম্মদপুরের সিটি হাসপাতালে মারা যান। আজ গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের ভুইঞা থানার অর্জুনা গ্রামে বাবা ও নানির সঙ্গে ঈদ করতে যাচ্ছেন তাহরিয়া। তার বাবা শেখ জহির রায়হান জানান, বিয়ের পর রাজধানীর মধ্য বাড্ডার আদর্শনগরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন তারা। বাবা না থাকায় মা কল্পনা বেগমকে নিজের কাছেই রেখেছিলেন কোহিনুর। তাই নানির সঙ্গে গ্রামের বাড়ি যাবে তাহরিয়া। সেখানে শিশুসহ আত্মীয়স্বজনদের স্নেহের ছায়ায় তাহরিয়াকে নিয়ে ঈদ উদযাপন করতে চাইছেন তার নানি। তিনি বলেন, “মাকে হারিয়ে মেয়ে কিছুক্ষণ পরপরই কান্না করছে। মাকে খোঁজে। এখনও কলিং বেল বাজলে ‘আম্মু আম্মু’ বলে দৌড়ে দরজার কাছে যায়। মাকে না পেয়ে কান্না করে। তাই আত্মীয়স্বজনদের কাছাকাছি রাখার চেষ্টা করছি।”
ছবি বুকে চেপে ধরে কাঁদেন রাব্বির বাবা-মা :একমাত্র সন্তান হারিয়ে ভালো নেই রবিউল ইসলাম রাব্বির মা। তার বাবা আমিনুল ইসলাম এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সন্তানের ছবি বুকে চেপে শুধু কান্নাকাটি করছেন তিনি। তারা কেউই খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করতে পারছেন না। তারপরও পেটের তাগিদে কাজ করতে হচ্ছে।’
গত বুধবার (৩১ জুলাই) ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) রাব্বি মারা যান। রবিউল রাজধানীর মিরপুরের শেওড়াপাড়ার স্যামসাং সার্ভিস সেন্টারে চাকরি করতেন। থাকতেন বাবা-মায়ের সঙ্গে শেওড়াপাড়া এলাকায়।
রিতার অপেক্ষায় মা :টঙ্গী বিসিক সুমি ফ্যাশনের পোশাক শ্রমিক ছিলেন রিতা আক্তার কমলা। পাঁচ বোনের মধ্যে রিতা সবার ছোট। তাই বড়বোনদেরও আদরের ছিলেন তিনি। টঙ্গী বিসিক হাজীনগর এলাকায় দুই বোনের পরিবারেই মাকে নিয়ে থাকতেন ৩০ বছরের রিতা। বোনদের ছয় সন্তানও রিতার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকতেন, ‘কখন খালাম্মা মজা নিয়ে আসবে।’ উচ্ছল এই তরুণী ২৭ জুলাই ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) মারা গেছেন। আজও তার বৃদ্ধ মা মেয়ের অপেক্ষায় থাকেন।
রিতার ছোট বোনের স্বামী নয়ন শরীফ মুঠোফোনে বলেন, ‘চঞ্চল মেয়ে ছিল রিতা। সবাইকে হাসি-আনন্দে ভরিয়ে রাখত। অথচ নিজের জীবনটা ছিল দুঃখেভরা। দুই বছর আগে ডিভোর্স হওয়ায় সে তাদের সঙ্গেই থাকত। বাচ্চারাও তাদের খালাকে অনেক পছন্দ করত। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল আউলিয়া নগরে।
মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন শাপলার স্বামী :প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুর খবর শুনে কোরিয়া থেকে দেশে ফিরে এসেছেন নাজমুল হক। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে এখন কারও সঙ্গেই কথা বলছেন না তিনি। শুধু একমাত্র সন্তান ছয় বছর বয়সী শাকিবকে বুকে আগলে রেখে প্রায়ই ডুকরে কেঁদে উঠছেন। ছোট্ট শাকিবও জেনে গেছে, তার মমতাময়ী মা আর নেই। কেউ জিজ্ঞাসা করলেই বলে, ‘মা আল্লাহর কাছে চলে গেছেন।’
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক নাজমুল হক ও শারমিন আক্তার শাপলার বিয়ে হয় নয় বছর আগে। তাদের প্রথম সন্তান ছেলে হলেও স্বপ্ন ছিল মেয়ে সন্তানের। সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছিল। আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন শাপলা। কিন্তু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫ আগস্ট ভোরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। শাপলার গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। নাজমুল ও তার ছেলে এখন সেখানেই রয়েছেন।
শাপলার ভগ্নিপতি আনিসুর রহমান জানান, শাপলার মৃত্যুতে তারা সবাই ভেঙে পড়েছেন। শাপলার মা ও বোন ছেলের দেখাশোনা করছেন। ছেলে যেন কোনোভাবেই কষ্ট না পায়, মায়ের অভাব বুঝতে না পারে, সে চেষ্টাই করছেন তারা। কিন্তু শোক পিছু ছাড়ছে না।
সন্তানদের জন্য ভালো থাকার চেষ্টা বাবার :প্রিয়জনকে হারিয়ে পরিবারের সবাই ভেঙে পড়লেও সন্তানদের ভালো রাখার চেষ্টা করছেন পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) শাহাবুদ্দীন কোরেশী। স্ত্রী সৈয়দা আক্তারের মৃত্যুর খবর পেয়ে ৫ আগস্ট দেশে ফেরেন তিনি। বুকের ভেতর চাপা কান্না জমে থাকলেও পরিবারের সবাইকে ভালো রাখার অঙ্গীকার তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার নজরের টিলা গ্রামে তাকে শেষ বিদায় দেন তিনি।
গত ৪ আগস্ট সকালে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে সৈয়দা আক্তার মারা যান। পেশাগত কারণে তখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে ছিলেন শাহাবুদ্দীন কোরেশী।
শাহাবুদ্দীন কোরেশী বলেন, ‘আল্লাহ সবাইকে ধৈর্য দিক। আমার সন্তানরাও শক্ত হোক। তাদের মায়ের মৃত্যু মেনে নেওয়া কঠিন। কিন্তু তারপরও জীবনের নিয়মে সবাইকে যেতে হবে।’
শাহাবুদ্দীন কোরেশী ও সৈয়দা আক্তার দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে আশিকুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, মেজ ছেলে সাজিদুর রহমান মেডিকেল কলেজে ও ছোট ছেলে আবিদুর রহমান নটর ডেম কলেজে পড়ছেন। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে।
গ্রামেই থাকবেন হাফসার ছেলেমেয়েরা :মাকে হারিয়ে অলিন ও আয়ান ভালো নেই। হাফসা লিপির স্বামী প্রবাসী সরদার আব্দুস সাত্তার তরুণও স্ত্রীকে হারিয়ে বিপর্যস্ত। তাই এবার দুই ছেলেকে নিয়ে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার পম গ্রামেই ঈদের সময় থাকবেন তিনি। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে হাফসাকে।
গত ২৮ জুলাই তরুণ ও হাফসা দু’জনই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ধানমি আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে যান। সেখানে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় দু’জনেরই ডেঙ্গু ধরা পড়ে। স্বামী তরুণের জ্বর সেরে গেলেও হাফসার জ্বর সারছিল না। গত বৃহস্পতিবার তাকে আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে পাঁচ দিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সোমবার রাত দেড়টার দিকে তার মৃত্যু হয়।