ঢাকা: হেলমেট পরা হামলাকারীরা ফটোসাংবাদিক রাহাত করিমকে পেটাচ্ছেন। ফাইল ছবিহেলমেট পরা হামলাকারীরা ফটোসাংবাদিক রাহাত করিমকে পেটাচ্ছেন। ফাইল ছবিনিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় নির্মম হামলার শিকার হয়েছিলেন ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক রাহাত করিম। মাথায় হেলমেট পরা হামলাকারীরা ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে তাঁকে রড ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রক্তাক্ত করে। হামলার ভিডিও ও স্থিরচিত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও রাহাতকে পেটানোর ছবি ভাইরাল (ছড়িয়ে পড়া) হয়েছিল। এত প্রমাণ থাকার পরও রাহাতের হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ, কোনো মামলাও হয়নি, শনাক্ত করার চেষ্টাও করা হয়নি।
শুধু রাহাত করিম নন, গত বছরের আগস্টে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি-ধানমন্ডি এলাকায় হামলার শিকার হন সাংবাদিকেরা। ঘটনাটি গত বছরের ৫ আগস্টের। সেদিন হেলমেটধারীদের নির্বিচার হামলায় আহত হন ১২ জন সাংবাদিকসহ অন্তত ৩০ জন। হামলার শিকার সাংবাদিকেরা তখন বলেছিলেন, ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের হেলমেট পরা একটি দল ওই ঘটনা ঘটায়।
হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে একাধিকবার আশ্বাস দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। পুলিশের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছিল, ভিডিও ফুটেজ দেখে হেলমেটধারীদের গ্রেপ্তার করা হবে। হামলাকারীদের গ্রেপ্তারে সাংবাদিকনেতারা দেখা করেছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে। হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চেয়ে ৭ আগস্ট চিঠিও দিয়েছিলেন হাসানুল হক ইনু।
তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, হামলাকারীদের চিহ্নিত করে তিনি ব্যবস্থা নেবেন, সাংবাদিকনেতাদের কাছে দেওয়া কথা তিনি রাখবেন।
কিন্তু বাস্তবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, সম্পাদক পরিষদসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনও হামলার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জড়িত ব্যক্তিদের শাস্তি দাবি করেছিল। কিন্তু ঘটনার এক বছর হতে চললেও কাউকে গ্রেপ্তার করা দূরের কথা, শনাক্তও করা হয়নি।
২১ জুলাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি সেই সময় মামলা করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘটনাটা তাঁর মনে আছে। কিন্তু এখন তিনি জানেন না আসলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল কি না। বিষয়টি তাঁকে জানতে হবে। বিষয়টি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার বলতে পারবেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘ডিএমপি একটি বড় সংগঠন। প্রতিদিন অসংখ্য ঘটনা ঘটে, অসংখ্য মামলা হয়, তদন্ত হয়। আপনি সংশ্লিষ্ট এলাকায় খোঁজ নেন।’
পরে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় ধানমন্ডি থানায়। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল লতিফ বলেন, ‘সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে কেউ আমাদের অভিযোগ করেনি। তাহলে আমরা মামলা করব কী করে?’ আপনারা কি ভিডিও ফুটেজ দেখেননি, সেখানে তো স্পষ্ট ছিল কারা হামলা চালিয়েছিল, এই প্রশ্নের জবাবে ওসি বলেন, ‘বিষয়টি জটিল, এ ছাড়া এটা অনেক বড় বিষয়, বোঝেনই তো। তবে আমাদের কাছে পুলিশের গাড়িতে যারা আগুন লাগিয়েছিল (নয়াপল্টনে গত বছরের ১৪ নভেম্বর বিএনপির নেতা–কর্মীরা পুলিশের ওপর হামলা করে ও পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেন, হামলাকারীদের অনেকে হেলমেট পরা ছিলেন), তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা ছিল।’
নয়াপল্টনের হেলমেটধারী হামলাকারীদের এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রেপ্তার করে নিজেদের সক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল পুলিশ। নিজেদের সফলতার কথা জানাতে গত বছরের ২০ নভেম্বর ডিএমপি সংবাদ সম্মেলনও করেছিল। ওই সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হামলাকারী হেলমেটধারীদের কেউ শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হয়েছে? এর জবাবে পুলিশ বলেছিল, অপরাধকে পুলিশ অপরাধ হিসেবেই দেখে। ওই ঘটনার তদন্ত চলছে। দায়ীদের ছাড় দেওয়া হবে না। কিন্তু গত এক বছরে পুলিশ আসলে কিছুই করেনি।
নয়াপল্টনে ছাত্রদলের হামলা ও ধানমন্ডিতে ছাত্রলীগের হামলায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ‘নয়াপল্টনে পুলিশ সফল, ধানমন্ডিতে নীরব’ শিরোনামে গত বছরের ২৮ নভেম্বর প্রথম আলোয় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
হামলার শিকার ভুক্তভোগীরা মনে করেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ এখন পুরো বিষয়টি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলে গেছে। হামলাকারী হেলমেটধারীরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী হওয়ায় সরকার বা পুলিশ এ ক্ষেত্রে নীরব রয়েছে।
বর্তমানে তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন হাছান মাহমুদ। এ বিষয়ে তিনি কোনো পদক্ষেপ নেবেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কেন মামলা হয়নি, তা জানতে আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করব। মামলা হওয়াটা সমীচীন ছিল। মামলা হলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যেত অপরাধীদের বিরুদ্ধে। স্বরাস্ট্রমন্ত্রী সঙ্গে আমি কথা বলব, যাতে তাঁরা সাংবাদিকদের এমন নির্মমভাবে পেটানোর ঘটনায় দোষীদের বিচারের আওতায় আনেন।’
ঘটনার দিন সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে মারধরের শিকার হন প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমেদ দীপ্ত। সে এলাকাতেই আরও মারধরের শিকার হন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) ফটোসাংবাদিক এ এম আহাদ, দৈনিক বণিক বার্তার পলাশ শিকদার ও ফ্রিল্যান্স ফটোসাংবাদিক রাহাত করিম। তাঁরা সবাই এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
রাহাত করিম এখনো স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারেন না। গত শনিবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভয় এখনো কাটেনি। এখনো হামলাকারীরা আমার তোলা ছবি চেয়ে হুমকি দেয়। পুলিশ কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ায় তারা এই সুযোগ পাচ্ছে।’
ছবি, ভিডিও ফুটেজ থাকার পরও তাঁদের একজনকেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাংবাদিকনেতারা। তাঁরা বলছেন, নয়াপল্টনের ঘটনায় হামলাকারীদের যদি এক সপ্তাহের মধ্যে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়, তাহলে শিক্ষার্থী-সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারী হেলমেট বাহিনীকে গ্রেপ্তার করতে বাধা কোথায়? এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহসভাপতি সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা হতাশা প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভেবেছিলাম তথ্যমন্ত্রীর অনুরোধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যবস্থা নেবেন। পুলিশ স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করবে। শেষ পর্যন্ত যা হলো, তাতে আমরা আশাহত, ব্যথিত, দুঃখিত, ক্ষুব্ধ।’
সৌজন্যে প্রথম আলো