ঢাকা: পান্না খাতুন। বয়স ২৮ বছর। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বোর্ডমিল এলাকার পারভেজের বাড়িতে ভাড়া থেকে পশ্চিম চান্দরার মন্ডলপাড়ায় অবস্থিত ‘আগামী ফ্যাশন লিমিটেড’ পোশাক কারখানায় অপারেটর পদে চাকরি করতেন। বেতন কম তাই ভাল চাকরির খোঁজ করতেন মাধ্যমিকের গণ্ডি টপকাতে ব্যর্থ এই তরুণী।
উপজেলার শরীফপুরের রতনপুর এলাকার ‘করনী নীট কম্পোজিট লিমিটেড’ পোশাক কারখানা কর্তৃপক্ষ প্রতি মাসের প্রথম দিন থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে থাকে।
গত ১৩ মার্চ সকাল আটটার পর এই কারখানায় চাকরির সন্ধানে যান পান্না খাতুন। সেখানকার অপরিচিত সুপারভাইজার মো. শামীম হোসেন রিপন (২৮) কারখানায় প্রবেশের রেজিস্ট্রি খাতাতে পান্নার নাম লিপিবদ্ধ করে তাকে নিয়ে কারখানায় প্রবেশ করেন। রিপন তার সঙ্গে থাকা কাগজপত্র ঘেঁটে বলেন চাকরি পেতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবে। যেটি পান্নার নেই। দুজনের মধ্যে ফোন নম্বর আদান-প্রদানের পর অল্প সময়ের মধ্যেই ওই কারখানা ত্যাগ করেন এই নারী।
“পান্নার ‘বিশেষ একটা চাকরি’ প্রয়োজনের কথা একই দিন দুপুরে প্রথমবার ফোনে রিপনকে জানালে তিনি বলেন, চাকরি পেতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র লাগবেই। তখন ফোনে তাদের ১৪ মিনিটের বেশি কথা হয়। নকল পরিচয়পত্র বানাতে পান্নাকে পরামর্শ দেন রিপন। কোথা থেকে নকল পরিচয়পত্র বানানো যাবে পান্না জানতে চাইলে রিপন জানায়, সফিপুরে একটি দোকানে গেলে এটি বানানো যাবে। কথামত একইদিন বিকেলে পান্না যথাস্থানে যান এবং রিপনকে ফোনে ডাকেন। রিপন এসে দেখেন কাঙ্খিত দোকানটি বন্ধ। এরপর দুজনে চান্দরা জেপি টাওয়ারের একটি কম্পিউটারের দোকানে যায়। সেখানে গিয়ে দেখেন দোকানের লোক অন্য কাজে ব্যস্ত। ‘নকল জাতীয় পরিচয়পত্র’ বানানো যাবে কি-না রিপন জানতে চাইলে দোকানি জানায়, বানাতে চার শ টাকা লাগবে। একটু সময়ও দিতে হবে। তখন পান্নাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রিপন। পান্না চন্দ্রার পাশেই ডানকিনি রসূলপুর যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। সেখান থেকে তারা নন্দনপার্কসহ বিভিন্ন স্থান ঘুরে রাত আটটার দিকে দোকানে ফেরে নকল পরিচয়পত্র নিতে। তখন তারা দোকানটি বন্ধ পায়।”
“এরপর পান্নাকে নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিবে বলে বাড়ইপাড়া রোডের নর্দান গার্মেন্টসের পেছন দিয়ে হেঁটে পল্লী বিদ্যুৎ নামক স্থানে রওনা হয় রিপন। মাঝপথে একটি গজারি বনের নির্জনস্থানে পান্নাকে জড়িয়ে ধরে ‘যৌন মিলনের’ প্রস্তাব দেন রিপন। জোরপূর্বক অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও পান্নাকে বশে আনতে ব্যর্থ হয়ে পেছন থেকে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ধরে রিপন। তখন বাঁচার চেষ্টা করলে শরীরের দুপাশে দু-পা রেখে পান্নার বুকের উপর চড়ে বসেন রিপন। এরপর গলায় ওড়না দিয়ে গিট দিলে পান্নার মুখ দিয়ে লালা বের হতে থাকে। মৃত্যু নিশ্চিত করে ‘পান্নার গলায় থাকা একটি সোনার চেইন, নাকে থাকা সোনার ফুল ও পার্সে থাকা মোবাইল নিয়ে’ দ্রুত পালিয়ে যান রিপন।
পরদিন ১৪ মার্চ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে উপজেলার পশ্চিম চান্দরা মন্ডলপাড়া এলাকার আইয়ুব মন্ডলের পুকুরের দক্ষিণ পাশের ওই গজারি বনে পান্নার লাশ দেখতে পায় স্থানীয়রা।
“একই দিন সকাল নয়টায় উপজেলার চান্দরা পল্লী বিদ্যুৎ কল্যাণপাড়া এলাকার ভুট্টুর বাড়ির ভাড়াটিয়া রিপন; বাসা থেকে বের হয়ে দুপুরের দিকে কালিয়াকৈর বাজারে অবস্থিত ‘বাঁধন জুয়েলার্সে’ চেইন ও নাকফুল ১১ হাজার ২ শ টাকায় বিক্রি করেন।”
লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে পান্নার বাবা সিরাজগঞ্জের সলংগা থানার চর বাগধা গ্রামের বাসিন্দা গোলবার হোসেন ছেলে আবু তাহের ও প্রতিবেশী আব্দুল হান্নানকে নিয়ে গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে যান।
মেয়ের লাশ সনাক্তের পর একই দিন টাঙ্গাইলের কালিহাতির বাসিন্দা নিরীহ নূর আলমকে (২৪) একমাত্র আসামি করে কালিয়াকৈর থানায় হত্যা মামলা (নম্বর ৩৮) করেন।
মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান ওই থানার পরিদর্শক (তদন্ত) খান মো. আবুল কাশেম। তিনি কল লিস্টের সূত্রধরে আগামী ফ্যাশন লিমিটেড-এ কর্মরত পান্নার সহকর্মী লতিফুর রহমানকে আটকের পর গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠান।
খান মো. আবুল কাশেম সোমবার (২০ মে) রাত সাড়ে ১১টার দিকে যোগফলের কাছে দাবি করেন, “পান্না দেহ ব্যবসা করত। লতিফকে গ্রেপ্তারের পর নূর আলমের পুরো পরিচয় পেয়েছেন। তদন্তে লতিফ ছাড়াও সুজন, নূরে আলমসহ একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে পান্নার অবৈধ সম্পর্কের প্রমাণ মিলেছে; যারা পান্নাকে ভোগ করত। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় পান্না ভাড়া বাসায় স্ত্রী পরিচয়ে থাকত। পোশাক কারখানায় সে মাসে ১৫ দিনও যেত না।”
তিনি বলেন, মামলার একমাত্র আসামি নূরে আলমের পুরো পরিচয় এজাহারে ছিল না। লতিফের কাছে তার ঠিকানা পেয়ে ৩-৪ দিন আগে টাঙ্গাইলের কালিহাতির নিজ বাড়ি থেকে নূরে আলমকে গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাকে অধিকতর জিঞ্জাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদনও করা হয়েছে।
“তবে আমার তদন্তে নূরে আলম ও লতিফ অপরাধী নয়।”- বলেন এই তদন্তকর্মকর্তা।
তিনি মামলাটি ঠিক পথে এগিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় দুদিন আগে (১৭ মে) এটি তদন্তের দায়িত্ব পায় গাজীপুর জেলার ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি)।
ডিবি পুলিশের ওসি আফজাল হোসেন সোমবার রাতে যোগফলকে বলেন, কল লিস্টের সূত্রধরে ঘাতক শামীম হোসেন রিপন পর্যন্ত পৌঁছাই। টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি থানার কদমতলী এলাকার মো. আব্দুল মজিদের ছেলে রিপনের সঙ্গে ঘটনার দিন সকালেই চাকরির জন্য এসে খুন হওয়া পান্না খাতুনের পরিচয় হয়। তারা ঘটনার দিন ১৪ বার ফোনে কথা বলেছে। শেষ কলের স্থায়িত্ব ছিল দুই সেকেন্ড। এরপর থেকে দুজনের লোকেশন একই স্থানে ছিল হত্যাকাণ্ডের সময় পর্যন্ত।
“দয়িত্ব পাওয়ার মাত্র দুদিনে ডিবি মামলার রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছে। এসপি শামসুন্নাহারের নির্দেশ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপরাধ) গোলাম সবুরের তদারকি ও ওসির তত্ত্বাবধানে এত দ্রুত মামলাটির রহস্য উন্মোচন হয়েছে। এতে ডিবির এসআই সারোয়ার ও এএসআই আনোয়ার হোসেন সহযোগীতা করেছেন।”
সোমবার (২০ মে) দুপুরে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী নিতে রিপনকে গাজীপুরের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে হাজির করা হয়।
আদালতের বিচারক মো. শরিফুল ইসলাম অভিযুক্তের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী গ্রহণের পর তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
নির্দোষ দুজন কারাগারে রয়েছেন। তাদের মামলা থেকে অব্যাহতি দিতে সুপারিশ করা হবে বলেও জানান ডিবির ওসি আফজাল হোসেন।