বন্ধুরা আমায় বদমেজাজি বলে। কিন্তু যে কথাটা শুনলে আমার সত্যিই হেব্বি রাগ হয়, সেটা হল ‘বোল্ড’। দিনরাত শুনি, ফেসবুকে, মেসেজে, কেউ আলাপ করতে চায় কারণ আমি নাকি বোল্ড, সাহসী।
এটা শুনলে আমি যে তাদের মনে মনে খিস্তি করি না, তা নয়৷ কারণ আমার রাগ হয় এই ভেবে যে, তারা আমায় কতটা চেনে? আদৌ কি তারা আমার শরীরের ‘পলিটিক্স’টা নিয়ে ভাবে? কেন আমি উদোম হই কিছু বিশেষ ধরনের সিনেমায়, কিছু বিশেষ ধরনের মানুষের জন্য?
নিজের শরীরের চেতনাবোধ অনেক ছোট বয়সেই এসেছিল৷ তখন বোধহয় আমি চার কি পাঁচ৷ মায়ের হাত ধরে যাচ্ছি পাড়ার দর্জির কাছে নতুন জামার মাপ দিতে৷ দোকানটা ছোট আর রাস্তার উপর৷ প্রাইভেসি বলে কিছু নেই৷ সে দিন প্রথম আমার একটা লজ্জাবোধ হল৷ দর্জি মাপ নিচ্ছে, আর আমি লজ্জা পাচ্ছি৷ মা’কে বললাম, ‘আমি বাড়ি যাব, লজ্জা লাগছে৷’ মা খুব ধমকে বলল, ‘এইটুকু মেয়ে আবার লজ্জা!’
আমার এখানে একটা ‘ডাইকটমি’ মনে হল৷ আমার শরীর চাইছে লজ্জা৷ কিন্তু আমার মা, একজন মেয়ে হয়ে বলছে, লজ্জা কীসের? তাই ভাবলাম, যদি আমি নির্লজ্জ হই, তা হলে কেমন হয়? বাড়ির মদত ছিল৷ ‘চ্যাম্পিয়ন’ মা, মাসিরা এবং আমার ‘কুল-ক্যাট’ মামিমা— সবাই চাইত আমি ‘ফ্রি স্পিরিটেড’ হই৷ হয়তো চাইত আমি অভিনেত্রী হই৷
সালটা ১৯৮৩ বা ১৯৮৪৷ ‘ডিস্কো ডান্সার’ মুক্তি পেয়েছে৷ মামার বাড়িতে কেটেছে ছোটবেলা৷ ছোটমামার একটা টেপ-ডেক-এর দোকান ছিল পাড়ার মোড়ে৷ বিকেল হলেই বাজত ‘ডিস্কো ডান্সার’-এর জিমি জিমি …৷ পাগলের মতো ছুটে যেতাম পাড়ার মোড়ে, আর নাচতাম৷
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে উঠল ‘সারিয়েল’ জগত্, আমার নিজের জগত্, সিনেমা৷ সব অখ্যাত, কুখ্যাত সিনেমা পছন্দ৷ সঙ্গে তাদের হিরোইনদেরও৷ মায়ের কোনও ‘ইনহিবিশন’ ছিল না৷ হয়তো মা আমাকে ছোটবেলা থেকেই ‘অ্যাডাল্ট’ ভাবত৷ আমি যে সময় মডেলিং শুরু করি, সেটা ছিল ২০০২ বা ২০০৩৷ চারধারে তখন অনেক সাহসী মহিলা৷ তাঁরা হয়তো কেউ ‘ফেমাস’ নন৷ কিন্তু সে সময় তাঁদের মধ্যে একটা জোশ ছিল৷ মডেলিংয়ের এই ‘ফ্রি স্পিরিটেড পার্সোনালিটি’ নিয়ে আমি যখন টেলিভিশনে আসি, তখন হয়তো বাংলা টেলিভিশনে ‘ফ্রেশ স্কিন’-এর দরকার ছিল৷ আই মিন, আই কেম উইথ স্মার্টনেস আনইনহিবিটেড ফ্রিডম ফর আদার্স টু গিভ দেম আ পারসপেকটিভ টু লুক অ্যাট আ উওম্যান উইথ লেস ক্লোদস৷ মিলান কুন্ডেরা যেমন লিখেছেন, ‘আই গেভ আ কনসেন্ট টু মেক মাই বডি পাবলিক ইন আ মুভিং ইমেজ৷’ তাতে ইন্ডাস্ট্রিতে আমার নাম হল ‘খোলামেলা ঋ’৷
শরীর দেখাতে গেলে শৃঙ্খলা চাই; সাহস তো পরে আসে৷ শৃঙ্খলা বা নিজের শরীরের উপর আমার অগাধ বিশ্বাস ছিল, আছে এবং থাকবে৷ আমার শরীরের মালিকানা আমার৷ দোকান সাজিয়ে বসেছি৷ বেচতে লজ্জা কীসের৷ আমার শরীরের বাবু আর দালাল আমি নিজেই৷ যাঁরা আমার শরীর দেখে লজ্জা পান, উত্তেজিত হয়ে পড়েন, তাঁরা হোন৷ কিন্তু এই যে প্রতিনিয়ত তাঁদের আদিম সত্তাকে ‘ট্রিগার’ করি, এটাই আমার ‘কানেকশন উইথ মাই অডিয়েন্স’৷
কিউয়ের হাত ধরে আমার ‘অল্টারনেটিভ’ ছবিতে প্রবেশ৷ আঁভা গার্দ, ডকু ফিকশন, আন্ডারগ্রাউন্ড ডেঞ্জারাস ফিল্মস৷ যখন ‘২১ গ্রামস’ দেখি , তখন নাওমি ওয়াটসের সাহসিকতা আমায় চ্যালেঞ্জ জানায়৷ ‘ইররিভার্সিবল’-এর ধর্ষিতা মনিকা বেলুচ্চির চিত্কার আমায় পরবর্তী বড় পদক্ষেপটা নিতে বলে৷ আর সেই সুযোগ করে দেয় কিউ৷ ২০০৬-০৭-এ কিউ বানায় ‘গান্ডু’৷ ও অভিনেতাদের ভয়গুলোকে দেখতে পায়, চ্যালেঞ্জ জানায়৷ ‘শেমলেস’ হওয়ার দিকে নিয়ে যায়৷ ওর গার্লফ্রেন্ড বলেই বলছি৷
‘গান্ডু’র এক্সট্রিম সিন করতে গিয়ে আমার বা অনুব্রতর প্রায় জীবন বেরিয়ে গিয়েছিল৷ কিন্তু আমি যে বিশ্বাসী কিছু চলচ্চিত্র নির্মাতাকে দেখতে পাই৷ তাদের ‘সেক্সুয়ালিটি’ আমি বুঝতে পারি৷ সে জন্যই ‘কসমিক সেক্স’ বা ‘গান্ডু’র প্রয়োজন ছিল আমার জীবনে৷ তবে সত্যি বলতে এত কিছু ভাবার নেই৷ শরীরটা তোমার; কিছু হারাবার ভয় নেই৷ মেয়ে বলেই বলছি।
পার্নো মিত্র
আমার মনে হয় না যে, টলিউডে সাহসী ছবি হঠাত্ বেড়ে গিয়েছে৷ আগেও তো ‘পরমা ‘ বা ‘উত্সব ‘ বা ‘অসুখ ‘-এর মতো ছবি হয়েছে৷ ঋতুদিও (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) নানা সাহসী ছবি করেছেন৷ দশ বছর আগে যেগুলোকে সাহসী ছবি বলা হতো, সেগুলোর বেশিরভাগ বানাতেন ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেন, গৌতম ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তরা৷ এগুলোকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছবি বলা হত না৷ এখন বাণিজ্যিক আর সমান্তরাল ছবির বিভাজন খানিকটা হলেও ঝাপসা হয়েছে৷ এটা পুরোটাই সম্ভব হয়েছে সৃজিত মুখোপাধ্যায় বা মৈনাক ভৌমিকের মতো পরিচালকের জন্য৷ এঁদের ছবির সঙ্গে কলেজের ছেলে-মেয়েরা যেমন আইডেন্টিফাই করতে পারে তেমন পঞ্চাশোর্ধ্ব পুরুষ-মহিলারাও পারেন৷ যদিও এই প্রজন্মেরই গল্প বলেন এই পরিচালকরা৷ যেমন সৃজিতের পরের ছবি ‘রাজকাহিনি’-তে আমি যৌনকর্মীর ভূমিকায় অভিনয় করছি৷ সৃজিতের ছবিকে পুরোপুরি বাণিজ্যিক যেমন বলা যায় না, তেমন সমান্তরালও বলা যায় না৷ মৈনাকের ছবিও তাই৷ সেখানে তো ‘বোল্ডনেস’ বারবার এসেছে৷ বিষয়ের ভাবনা আর প্রয়োগ থেকেই এসেছে৷
আর দেখতে গেলে পুরোপুরি বাণিজ্যিক ছবি কোনও সময়েই ‘সাহসী’ ছিল না৷ এখনও নয়৷ শুধু আগে যেটা কঠোর ভাবে সমান্তরাল ছিল এখন সেটা অনেকটাই ‘বাণিজ্যিক’ হয়েছে— মৌলিকতাকে বিসর্জন না দিয়ে৷ সেখানে ‘বোল্ডনেস’ এসেছে বিষয়ের তাগিদেই।