ভারতকে ‘হিন্দু’ রাষ্ট্র করতে আরএসএসের ধর্মান্তরকরণ কর্মসূচি : আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু

বাধ ভাঙ্গা মত

image_110857_0উগ্র হিন্দুদের দিয়ে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময় আমি দিল্লিতে অবস্থান করছিলাম। কমনওয়েলথ টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামের অধীনে ছয় মাসব্যাপী এক ফেলোশিপে ভারতীয় পার্লমেন্টের ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশন অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজের সাথে যুক্ত ছিলাম। বিভিন্ন কমনওয়েলথ দেশের পার্লামেন্টের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ছাড়াও বেশ ক’জন সাংবাদিকসহ ১৫ জন ফেলো ছিলেন এ কর্মসূচিতে। বাংলাদেশ থেকে আমার সাথে ছিলেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন প্রটোকল অফিসার রুহুল আমিন। আমাদের কাজ ছিল লোকসভা, রাজ্যসভা ও আইন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক, আইন ও সংবিধানবিষয়ক বিশেষজ্ঞদের লেকচার শোনা ও পার্লামেন্টের বিভিন্ন সেকশনে কাজ করা। ১৯৯২ সালের ১৬ নভেম্বর আমাদের কাস শুরু হয়। উগ্র হিন্দু সংগঠন ভারতীয় জনতা পার্টি, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস), শিবসেনা ও বজরং দল অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ এলাকায় রাম মন্দিরের ‘শিলান্যাস’ বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য দিন নির্ধারণ করেছিল ৬ ডিসেম্বর। উত্তর প্রদেশজুড়ে এসব সংগঠন অযোধ্যা অভিযানের জোর প্রস্তুতি চালাচ্ছিল। দিল্লি থেকে অযোধ্যার দূরত্ব ৩৩০ কিলোমিটার এবং ভারতে রাজধানী দিল্লি ইউনিয়ন টেরিটরি হলেও সেখানেও উগ্রপন্থীরা চুপচাপ বসে ছিল না। দেয়াল লিখনও অশুভ ইঙ্গিত দিচ্ছিল। ঝড়ের আগে গুমোট অবস্থার মতো। আমরা দুই বাংলাদেশী ছাড়া ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আর কোনো মুসলিম ছিল না। আমাদের কর্মস্থল ‘ইনস্টিটিউট অব কনস্টিটিউশন অ্যান্ড পার্লামেন্টারি স্টাডিজে ডাইরেক্টর থেকে সুইপার পর্যন্ত অফিসার ও কর্মচারীদের কোনো পদে একজন মুসলিমও ছিল না। পার্লামেন্টের মূল ভবন এবং সড়কের ওপারে বহুতলবিশিষ্ট নতুন অ্যানেক্স ভবনসহ পুরো পার্লামেন্টের বিশাল স্থাপনায় মুসলমানদের আধিক্য দেখেছিলাম শুধু পার্লামেন্টের ক্যান্টিনে। কিন্তু ক্যান্টিনে কর্মরতরাও আসলে পার্লামেন্টের কর্মচারী ছিলেন না। ক্যান্টিন চালাত ইন্ডিয়ান রেলওয়ে এবং সর্বত্র হিন্দু প্রাধান্য সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে দিল্লিতে রেলওয়ের ক্যাটারিং সার্ভিস তখন ছিল মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে।

আমরা দু’জন ইনস্টিটিউটের এক্সিকিউটিভ সেক্রেটারি শিখ ধর্মাবলম্বী মনোহর লাল দংয়ের উজিরপুরের বাড়ির তিনতলায় একটি রুম ভাড়া নিয়ে থাকতাম। ইনস্টিটিউট থেকে বাসে এক ঘণ্টার দূরত্ব। এলাকাটি হিন্দুপ্রধান হলেও মিশ্র ধর্মাবলম্বীদের বসবাস ছিল। কাছেই বড় একটি মাঠের এক প্রান্তে পাশাপাশি মসজিদ, মন্দির ও গুরুদুয়ারা। এ সহাবস্থান দৃশ্যত চমৎকার ছিল। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর যত ঘনিয়ে আসছিল, অযোধ্যা নিয়ে মাতামাতি ও উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে চলছিল। মনোহর লালকে তত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছিল। প্রায়ই তিনি বলতেন যে, ‘পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়াচ্ছে। আমাদের এলাকা নিরাপদ হলেও কখন কী হয় বলা যায় না। সন্ধ্যার পর তোমরা বাইরে যেও না।’ আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করতাম সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরতে। তবু কখনো দেরি হয়ে যেত। ৬ ডিসেম্বরও ফিরতে দেরি হয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যার আগেই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয় এবং টেলিভিশনে তা বারবার দেখানো হচ্ছিল। আমরা দু’জন নিজেদের স্বাভাবিক রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম। দোতলায় মনোহর লালের বাসায় টিভি দেখে ওপরে রুমে গিয়ে আমি ও রুহুল আমিন ভাই চুপচাপ যার যার বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মসজিদে এশার আজান ধ্বনিত হলো না। সেদিন দিল্লিতে কোনো অঘটন ঘটেছে বলে কোনো খবর প্রচারিত হয়নি। ভোরে মসজিদের মাইকে ফজরের আজানও শোনা গেল না। পরদিন সকালে আমরা যথারীতি ইনস্টিটিউটে গেলাম। অন্যান্য ফেলো আমাদের সমবেদনা জানালেন। হিন্দু ফেলোরাও আমাদের সান্ত্বনা দিলেন যে, এসব রাজনীতিবিদের খেলা, যার বলি হচ্ছে হিন্দু ও মুসলমানেরা।

ইনস্টিটিউটের পাশেই কনস্টিটিউশন কাব। সন্ধ্যায় কাস শেষ হতেই ভিড় দেখে কনস্টিটিউশন কাবের সামনে গেলাম। বিজেপির সমাবেশ চলছিল। বক্তৃতা দিচ্ছিলেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং। তার ওপর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ছিল বাবরি মসজিদ রক্ষা করার। আর তা করতে তিনি যদি ব্যর্থ হন, তাহলে তা হবে কনটেম্পট অব কোর্ট। কল্যাণ সিং বলছিলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আমাকে বলেছে, আমি যদি বাবরি মসজিদ রক্ষায় ব্যর্থ হই তাহলে আমাকে কনটেম্পট অব কোর্টের মুখোমুখি হতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট তো মানুষের তৈরি আদালত। আমার ওপর ভগবানের নির্দেশ রয়েছে হিন্দু ধর্মকে রক্ষার। ভগবানের নির্দেশ না মানলে তা হবে কনটেম্পট অব গড। আমি কি মানুষের আদালত অবমাননাকে বড় করে দেখব, না ভগবানকে অবমাননা না করার কথা ভাবব? একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু হিসেবে আমি ভগবানকে অবমাননা করতে পারি না।’ একজন খাঁটি হিন্দু হিসেবে তার কথা যথার্থ।

বিজেপির তখনকার লোকসভা সদস্য উমা ভারতী বাবরি মসজিদ ধ্বংস না হওয়া পর্যন্ত মাথা ন্যাড়া করে এক বস্ত্র অর্থাৎ কোনো অন্তর্বাস ছাড়া শুধু গেরুয়া রঙের শাড়ি পরে থাকার শপথ নিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সাথে রাজনীতির সম্পর্ক নেই, এর সাথে হিন্দুদের বিশ্বাসের সম্পর্ক জড়িত। ভারতে বিদেশী শাসনের কলঙ্ক মোচন হয়েছে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে।’ অতএব হিন্দুধর্ম বিশ্বাসে যারা কট্টর তাদের ইচ্ছায় ও মদদে বাবরি মসজিদ ধ্বংস হয়েছে। কল্যাণ সিং ভগবানকে অপমানিত হতে দেননি। উমা ভারতীর শপথ পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। বাবরি মসজিদের অদূরে স্থাপিত মঞ্চে লালকৃষ্ণ আদভানি, মুরলি মনোহর যোশি,  বিনয় কাটিয়ারের সাথে তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দৃশ্য আনন্দচিত্তে দেখেছেন। পরবর্তী কয়েক দিনে দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় বিচ্ছিন্ন ঘটনায় মাত্র আটজন মুসলিম নিহত হলেও মহারাষ্ট্র, গুজরাট, বিহার, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও কেরালায় উদ্ভূত দাঙ্গায় দুই হাজারের অধিক মুসলিম নিহত হয়েছে। পরে গঠিত লিবারহ্যান তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, উগ্র হিন্দু দাঙ্গাকারীদের হাতে নয়, বেশির ভাগই নিহত হয়েছে  পুলিশের গুলিতে।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে ভারতের কলঙ্ক মোচন হয়েছে বলে উগ্র হিন্দু সংগঠনের নেতারা তখন সন্তোষ প্রকাশ করলেও আসলে একটি মাত্র মসজিদ ধ্বংস করে ভারতের কলঙ্ক মোচন হয়েছে বলে কি তারা বিশ্বাস করেন? ২০০২ সালে গুজরাটে সংঘটিত দাঙ্গায় প্রায় দেড় হাজার মুসলিম নিহত হয়েছে এবং ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের গঠন করা তদন্ত কমিটি গুজরাট দাঙ্গাকে উসকানি দেয়া ও দাঙ্গা থামাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেয়ায় গুজরাটের তখনকার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, যিনি বর্তমানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী, তাকে দায়ী করলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তার নেতৃত্বে বিজেপি এখন ভারতের শাসন ক্ষমতায় এবং তাকে আশ্রয় করে উগ্র হিন্দু দলগুলো, বিশেষ করে আরএসএস ও বজরং দল তাদের ‘ধর্ম জাগরণ সমন্বয় বিভাগ’-এর নামে ভারতীয় মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তারা এ কর্মসূচির নাম দিয়েছে ‘পুরুখো কা ঘর ওয়াপসি’ অর্থাৎ ‘পূর্বপুরুষের ঘরে ফিরে আসা’। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে উগ্র হিন্দুরা গত সপ্তাহে আগ্রার এক বস্তির ৫৭টি মুসলিম পরিবারের প্রায় ৩০০ সদস্যকে মন্ত্র পাঠ করিয়ে কপালে সিঁদুর দিয়ে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করেছে। নবদীক্ষিতদের হিন্দু নাম দেয়া হয়েছে, তাদের হিন্দুধর্মে আসার প্রমাণ হিসেবে তাদের দিয়ে  হিন্দু দেবদেবীর পা ধোয়ানো হয়েছে। বজরং দল তাদের নতুন নামের তালিকা করেছে ভোটার আইডি কার্ড ও রেশন কার্ড দেয়ার জন্য। বজরং দল নেতা বিনয় কাটিয়ার তাদের উদ্যোগের সপক্ষে বলেছেন, ‘মানুষকে তাদের ধর্ম বেছে নেয়ার স্বাধীনতা দেয়া উচিত। তারা যদি আবার হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে তাতে কোনো ক্ষতি নেই।’

একটি ঘটনার মধ্য দিয়ে উগ্রপন্থীদের হিন্দু ভারত প্রতিষ্ঠা শেষ হবে এমন মনে করার কারণ নেই। তাদের পরিকল্পনা সুদূরপ্রসারী এবং বিজেপি ক্ষমতায় আসায় তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজতর হয়েছে। আরএসএস নেতারা ইতোমধ্যে আগামী ২৫ ডিসেম্বর আলীগড় মহেশ্বরী কলেজে পাঁচ হাজার মুসলিম ও খ্রিষ্টানকে হিন্দু বানানোর কর্মসূচি প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া প্রতি মাসে গড়ে এক হাজার জনকে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত করতে দশ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে বলে আরএসএস নেতারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। আরএসএস সূত্র আরো দাবি করেছে, তারা উত্তর প্রদেশের ৬০টি গির্জার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এসব গির্জা ভেঙে ফেলা হবে এবং ভারত শুধু হিন্দুদের থাকবে।

বিজেপির অধীনে আগামী বছরগুলোতে ভারতে ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে ১২৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশটির ১৫ শতাংশ মুসলিম সংখ্যালঘুর অবস্থা কী দাঁড়াতে পারে তা সহজে অনুমান করা যায়। বর্তমান সরকারের সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রী ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা ও স্বাধীন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদের নাতনী নাজমা হেপতুল্লাহ গত জুন মাসে দাবি করেছেন, মুসলমানেরা ভারতে সংখ্যালঘু নয়। তার মতে, এত বিপুল জনগোষ্ঠী কোনো দেশে সংখ্যালঘু হতে পারে না। কিন্তু জনসংখ্যা অনুপাতে আর্থসামাজিক অবস্থার বিচারে ভারতে মুসলমানেরা, এমনকি দলিতদের চেয়েও খারাপ। তিনি তার মন্ত্রণালয়কে মুসলিমবিষয়ক নয়, সংখ্যালঘুবিষয়ক বলে জোর দিয়ে বলেছেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, সংখ্যালঘু শুধু সংখ্যার স্বল্পতার কারণে নয়, বরং সামর্থ্যরে দিক থেকে দুর্বল ও সংখ্যালঘুর নিরন্তর বৈষম্যের শিকার কোনো সম্প্রদায়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের আগে সংখ্যালঘুর যে সংজ্ঞা ছিল, মুসলমানদের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয় তাদের ক্ষমতাহীন করে রাখার সুচতুর কৌশলের অংশ হিসেবে। ভারতে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত গণপরিষদই এ কাজটি করেছিল ১৯৫০ সালে এবং রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সম্প্রদায়গত সংখ্যালঘুদের রাজনৈতিক ও সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ নস্যাৎ করে দিয়েছিল। ভারতীয় মুসলমান, যারা পাকিস্তান হওয়ার পরও ভারতকেই নিজেদের আবাস হিসেবে বেছে নিয়েছিল,  স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু সেই মুসলমানদের জন্য ‘সংখ্যালঘুর অধিকার’ দেয়ার প্রস্তাব করেন। জাতীয়তাবাদের নামে সংখ্যাগুরুর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল মুসলমানদের ওপর, যার খেসারত আজো তাদের দিতে হচ্ছে।

ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা অনুপাতে সরকারি চাকরিতে অংশীদারিত্ব অতি নগণ্য। ২০০৯-১০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের সব পর্যায়ের চাকরিতে মুসলিম পাঁচ শতাংশের নিচে। রাজ্য সরকারের চাকরিতে মুসলিম কর্মচারী মাত্র ৯ শতাংশ। ভারতে জাতীয় শিক্ষা হার যেখানে ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ সেখানে মুসলমানদের শিক্ষার হার যেকোনো ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে কমÑ ৫৯ দশমিক ১ শতাংশ। হিন্দুদের শিক্ষা হার ৬৫ দশমিক ১ শতাংশ, খ্রিষ্টানদের ৮০ দশমিক ৩ শতাংশ, শিখদের ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং জৈনদের শিক্ষা হার সর্বোচ্চ ৯৪ দশমিক ১ শতাংশ। মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্র থেকে ঝরে পড়া ছাত্রের সংখ্যা হিন্দুদের চেয়ে বেশি এবং উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অবস্থা আরো করুণ। প্রতি এক হাজার হিন্দু ছাত্রের মধ্যে যদি ৩০ জন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট পর্যায়ে পড়ার সুযোগ পায়, তাহলে প্রতি হাজার মুসলিমের মধ্যে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পর্যায়ে যেতে পারে মাত্র ১০ জন। এমনকি পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্য, যেখানে জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলিম, সেখানে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পর্যায়ে প্রতি হাজারে মাত্র পাঁচজন সুযোগ লাভ করে। চাকরি ক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলামানদের পিছিয়ে থাকার কারণ সম্পর্কে নয়াদিল্লিভিত্তিক ‘সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ডিবেটস ইন ডেভেলপমেন্ট পলিসি’র এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘মুসলমানেরা যে শুধু যোগ্যতার অভাবের কারণে চাকরি পায় না, তা নয়, নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের মনোভাবের কারণেও তারা চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়।’

ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে দারিদ্র্যও সবচেয়ে বেশি। পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৩ সালের সালের এক জরিপ অনুযায়ী, ভারতে একজন মুসলমানের দৈনিক ব্যয় ৩২ দশমিক ৭ রুপি। একজন হিন্দুর মাথাপিছু দৈনিক ব্যয় ৩৭ দশমিক ৫ রুপি, একজন শিখের ৫৫ দশমিক ৩ রুপি এবং একজন খ্রিষ্টানের ক্ষেত্রে ৫১ দশমিক ৪ রুপি। মাসিক আয়ের ক্ষেত্রেও মুসলমানের মাথাপিছু আয় সর্বনিম্ন। গ্রামে বসবাসকারী একজন ভারতীয় মুসলিম গড়ে মাসিক ৯৮০ রুপি আয় করে। সেখানে একজন হিন্দু আয় করে ১১২৫ রুপি, একজন শিখ আয় করে ১৬৫৯ রুপি এবং একজন খ্রিষ্টানের আয় ১৫৪৩ রুপি। শহরে বসবাসকারী মুসলমানের আয় আরো কম।

ভারতে মুসলিম, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও জৈনদের ধর্মীয় সংখ্যালঘু ঘোষণা করা হলেও জৈনরা নিজেদের সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিত হতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। অনেকের মতে, ‘সংখ্যালঘু’ শব্দটি মানবাধিকারের ঘাতক। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের এক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ‘ধর্মীয় গ্রুপগুলোকে ‘সংখ্যালঘু সম্প্রদায়’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার চর্চাকে নিরুৎসাহিত করা উচিত এবং ক্রমে এ তালিকা পরিহার করা উচিত। কারণ এতে জাতিকে দুর্বল করার মতো বিভাজনমূলক প্রবণতাকে প্রশ্রয় দেয়া হয়।’ প্রধান বিচারপতি আর সি লাহোতি, বিচারপতি ডিএম ধর্মাধিকারী ও বিচারপতি পি কে বালাসুব্রামনিয়াম সমন্বয়ে গঠিত সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের গঠিত সংখ্যালঘু কমিশনগুলোকে এই মর্মে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ‘সংবিধানের লক্ষ্য হচ্ছে এমন এক সামাজিক অবস্থার সৃষ্টি করা, যেখানে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণের জন্য পৃথক কোনো ঢালের প্রয়োজন পড়বে না। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবিকে উৎসাহিত করার পরিবর্তে কমিশনগুলোর উচিত বিদ্যমান আইন অনুযায়ী এমন সামাজিক অবস্থা সৃষ্টিতে সহায়তা করতে উপায় ও পদ্ধতির সুপারিশ করা, যাতে সংখ্যালঘু হিসেবে চিহ্নিতদের তালিকা ক্রমেই হ্রাস পায় এবং এক সময়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়।’ পর্যবেক্ষণে আরো উল্লেখ করা হয়, ‘বিদ্যমান জাত প্রথা পূর্ণ ভারতীয় সমাজে জনগোষ্ঠীর কোনো অংশ বা সুনির্দিষ্ট কোনো গ্রুপ নিজেদের সংখ্যাগুরু বলে দাবি করতে পারে না। হিন্দুদের মধ্যে সবাই সংখ্যালঘু। অনেকে তাদের সংখ্যার কারণে এ ধরনের দাবি করে এবং তারা পশ্চাৎপদ অবস্থায় আছে দাবি করে রাষ্ট্রের কাছ থেকে সংরক্ষণ ব্যবস্থা আশা করে। যদি প্রতিটি সংখ্যালঘু গ্রুপ অন্য গ্রুপের কাছ থেকে শঙ্কা বোধ করে, তাহলে পারস্পরিক ভীতি ও অবিশ্বাসের এক পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যা জাতির অখণ্ডতার প্রতি গুরুতর হুমকির সৃষ্টি এবং বহুজাতিবাদের বীজ বপন করবে। এ ধরনের ত্রুটিপূর্ণ প্রবণতাকে উৎসাহিত করলে তা সাংবিধানিক গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর গুরুতর বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলবে। আমাদের দেশকে বহুজাতিবাদভিত্তিক ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার বিরুদ্ধে আমাদের অবস্থান নেয়া উচিত।’

কিন্তু ভারতের হিন্দু বাস্তবতা ভিন্ন। আরএসএস প্রধান মোহন ভগত গত আগস্ট মাসে মহারাষ্ট্রের কটকে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘ভারত একটি হিন্দু দেশ এবং এর পরিচিতি হিন্দুত্ব। হিন্দুবাদের মধ্যেই সব ধর্মকে সমন্বিত করা সম্ভব।’ তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, ইংল্যান্ডের অধিবাসীরা যদি ‘ইংলিশ’, জার্মানির অধিবাসীরা ‘জার্মান’ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অধিবাসীরা ‘আমেরিকান’ হিসেবে পরিচিত হতে পারে, তাহলে হিন্দুস্থানের অধিবাসীরা ‘হিন্দু’ হিসেবে পরিচিত হতে পারবে না কেন? হিন্দুত্বই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রাখার একমাত্র ভিত্তি। তিনি আগামী পাঁচ বছরে হিন্দুদের সমতা বিধানের লক্ষ্যে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মসূচির উল্লেখ করে আরো বলেছেন, এই সংগঠন হিন্দুদের মধ্যে সমতা নিশ্চিত করবে। সব হিন্দু এক স্থানে পানি পান করবে। এক স্থানে খেলাধুলা করবে এবং মৃত্যুর পর তাদের দেহ এক স্থানে দাহ করা হবে। একই অনুষ্ঠানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ প্রধান প্রাভীন টোগাডিয়া বলেছেন, অযোধ্যায় যেকোনো মূল্যে একটি বিশাল রাম মন্দির নির্মাণ করা হবে। মন্দির নির্মিত না হওয়া পর্যন্ত এটি আমাদের এজেন্ডার শীর্ষে থাকবে।

প্রায় দুই যুগ আগে ভারতীয় মুসলমানদের চরম ক্রান্তিলগ্নে দিল্লিতে অবস্থান করে আমি উগ্র হিন্দুদের যে মানসিকতা প্রত্যক্ষ করেছি, তা থেকে তারা এক চুলও সরে আসেনি। বরং তারা মুসলমানদের হিন্দুত্বের নাগপাশে আবদ্ধ করার লক্ষ্যে এক দিকে তাদের মুসলিম পরিচিতি বিসর্জন দিতে বাধ্য করার চক্রান্ত চালাচ্ছে, অন্য দিকে চরম দুর্দশাগ্রস্তদের প্রলোভন ও হুমকি দিয়ে ধর্মান্তরকরণের মাধ্যমে মুসলমানদের ওপর স্থায়ী চাপ সৃষ্টি করে রাখতে চাইছে। অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হিন্দুত্ববাদীদের জন্য কোনো সমস্যা নয়, মুসলমানেরা তাদের কাছে বড় সমস্যা। এ সমস্যা লাঘব করতে তারা বিজেপি সরকারের ওপর সওয়ার হয়ে তাদের মুসলিম বিদ্বেষী কার্যক্রম জোরদার করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *