ঢাকা: নুসরাত জাহান রাফি হত্যাকাণ্ড কাঁপিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশকে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ তীব্র হয়ে উঠেছে। প্রায় ১৬ কোটি মানুষের মুসলিম রক্ষণশীল এই দেশটিতে নারী ও বালিকাদের দুর্ভোগের বিষয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, যেখানে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থেকে যায় আড়ালে। নির্যাততকে ভীতি প্রদর্শন করা হয়। আইনগত প্রতিকারের পথ দীর্ঘ। অনেকেই পুলিশের কাছে রিপোর্ট করেন না। কারণ, সামাজিক মান মর্যাদার ভয়। নুসরাত হত্যাকাণ্ড ও তার প্রতিবাদ নিয়ে এমন রিপোর্ট করেছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।
বিশ্বের প্রায় সব মিডিয়ায় এ খবরটি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। কোনো কোনো গণমাধ্যম নুসরাত ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মধ্যকার কথোপকথনের ফাঁস হওয়া ভিডিও প্রকাশ করেছে।
বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন প্রকাশ করেছে বার্তা সংস্থা এপির রিপোর্ট। এতে বলা হয়েছে, ফেনির একটি মাদ্রাসার প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে আনা যৌন হয়রানির মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় বাংলাদেশে নুসরাতকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যার প্রতিবাদে ও ন্যায় বিচারের দাবিতে রাজধানী ঢাকায় শুক্রবার বিক্ষোভ করেছেন বিপুল সংখ্যক মানুষ। রিপোর্টে ওই হত্যাকান্ডের বিবরণ রয়েছে। শুক্রবারের বিক্ষোভে যোগ দিয়েছিলেন মডেল ও অভিনেত্রী আলিশা প্রধান। তিনি বলেছেন, আমরা ন্যায়বিচার চাই। আমাদের মেয়েদের নিরাপদ ও মর্যাদার সঙ্গে অবশ্যই বড় হতে দিতে হবে। আমরা নারীর ওপর যেকোনো রকম সহিংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই এবং কর্তৃপক্ষের অবশ্যই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
ওই রিপোর্টে বলা হয়, ফেনিতে নুসরাতের দাফন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন হাজার হাজার মানুষ। নুসরাতের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এই হত্যায় দোষীদের শাস্তি হবে। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেছেন, এ ঘটনায় শিক্ষার্থী সহ কমপক্ষে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
পুলিশ বলেছে, গ্রেপ্তারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, নুসরাতের ওপর ওই হামলা পরিকল্পিত এবং জেলখানা থেকে এর নির্দেশ দিয়েছেন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল। তার সঙ্গে তার লোকজন সাক্ষাত করতে গেলে তিনি এ নির্দেশ দেন। নুসরাতকে হত্যার জন্য দিনের বেলা বেছে নেয়া হয়, যাতে ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে মনে হয়।
ওদিকে মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, নুসরাতের পরিবার বলেছে মামলা প্রত্যাহার না করলে তাদেরকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়। এখন নুসরাতের এই মামলাটিকে জরুরি বা আর্জেন্ট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ার আগে তা করা হয় নি।
নুসরাত যখন ২৭ মার্চ থানায় মামলা করতে যান তখন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে তার কথোপকথনের একটি ভিডিও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নুসরাতকে বলছেন, এটা বড় কোনো বিষয় না। পরে দায়িত্বে অবহেলার দায়ে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ওই থাকা থেকে সরিয়ে দেয়া হয়।
এতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশী নারীদের জন্য এমন সব স্পর্শকাতর বিষয়ে পুলিশে মামলা করা অতোটা সহজ নয়। এসব ক্ষেত্রে নির্যাতিতারা আরো হয়রানি ও অপমানের শিকার হন। এসব মামলা তদন্তেও মাঝে মাঝে পুলিশ অনিচ্ছা প্রকাশ করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় রাজনীতিক অথবা ঘুষের কাছে প্রভাবিত হয়ে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। তবে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, বিশেষ করে যৌন হয়রানি ও অপমানের বিষয়ে কণ্ঠ ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।
অনলাইন এসবিএস লিখেছে, নুসরাতকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের দাবিতে ঢাকায় বিক্ষোভ হয়েছে। এ মাধ্যমটিও এপির রিপোর্ট অনুসরণ করেছে। ওদিকে নিউজিল্যান্ড হেরাল্ড বৃটেনের অনলাইন ডেইলি টেলিগ্রাফের রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করায় জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে নুসরাতকে। এটা এক বেদনাতুর ঘটনা। এতে বাংলাদেশে বিক্ষোভ তুঙ্গে। নুসরাত যখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিল, তার শরীরের ৮০ ভাগ এলাকা পুড়ে গিয়েছিল, তখন তিনি ভাইয়ের মোবাইল ফোনে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে গিয়েছেন। বলেছেন, ওই শিক্ষক আমাকে স্পর্শ করেছেন। শেষ নিশ্বাস থাকা অবধি এই অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবো।
এতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলির বিবৃতি তুলে ধরা হয়। তিনি বলেছেন, একজন সাহসী মেয়েকে ভয়াবহভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন। এতেই ফুটে ওঠে যৌন নির্যাতনের বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার কত বাজেভাবে ব্যর্থ। নুসরাতের মৃত্যু এটাই বড় করে তুলে ধরেছে যে, যৌন নির্যাতনের শিকারদের বিষয় কতটা সিরিয়াসলি নেয়া উচিত বাংলাদেশ সরকারের এবং এটা নিশ্চিত করা যে, তারা যেন আইনগত প্রতিকার পান নিরাপদে এবং প্রতিশোধের হাত থেকে যেন তারা সুরক্ষিত থাকেন।
পুলিশ এ ঘটনাকে যেভাবে ‘হ্যান্ডেলিং’ করেছে তাতে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এতে থানার ভিতরে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে নুসরাতের কথোপকথনের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়েছে।
লন্ডনের অনলাইন দ্য মেইল প্রকাশিত ভিডিওর ওপর জোর দিয়েছে। তারা ওই ভিডিও প্রকাশ করেছে। তাতে নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার আগে পুলিশের সঙ্গে তার ধর্ষণ প্রচেষ্টার অভিযোগ নিয়ে কথোপকথনের দৃশ্য রয়েছে। এতে পুলশের কাছে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ কান্নাজড়িত নুসরাতকে বলতে বাধ্য করা হয়। তিনি ফেনির সংশ্লিষ্ট থানায় ওই অভিযোগ করতে গিয়েছিলেন প্রিন্সিপাল এসএম সিরাজ উদৌলার বিরুদ্ধে। তখন তার বর্ণনা ভিডিওতে ধারণ করে পুলিশ কর্মকর্তারা। ওই ভিডিও পরে অনলাইনে ফাঁস করে দেয়া হয়। এতে নুসরাতকে কিভাবে অবমাননা করা হয়েছে তার প্রকাশ পেয়েছে। তাকে মাদ্রাসার ছাদে নিয়ে বোরকা পরা ব্যক্তিরা কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে হত্যা করেছে।
ওই মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল সিরাজ উদৌলার যৌন হয়রানির ইতিহাস আছে। কিছু শিক্ষার্থী এ অভিযোগ করলেও তা অবজ্ঞা করা হয়েছে। স্থানীয় একটি সংবাদ মাধ্যমকে একজন স্টাফ বলেছেন, ওই প্রিন্সিপাল গত বছর অক্টোবরে একজন ছাত্রীকে যৌন অবমাননা করেছেন। ওই ছাত্রী অভিযোগ করেছিলেন। তাকে সমর্থন করেছিলেন তিনজন শিক্ষক। তারা ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ কোনো তদন্তই করে নি। উল্টো মাদ্রাসার বসের বিরুদ্ধে ওই শিক্ষকদের কথা বলা বন্ধ করানো হয়। এ ছাড়া ওই প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ থাকার কারণে তাকে একটি রাজনৈতিক দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।