‘প্রি-কনসেপ্ট’ বলে একটি তত্ত্ব পড়েছিলাম। বাস্তব জীবনেও নানাভাবে প্রি-কনসেপ্টের প্রয়োগ দেখি। দেখি বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে। উচ্চশিক্ষিত, শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, অশিক্ষিত, গণ্ডমূর্খ প্রায় সবার মধ্যেই। খুব সহজেই পূর্ব ধারণায় আক্রান্ত হই আমরা। বিচার করি না, বিশ্লেষণে যাই না, খেলো যুক্তি, আতশ কাচের নিচে এসে দাঁড়াতে, দাঁড় করাতে ভয় পাই। এই অভ্যেস রীতিমতো অভ্যস্ততায় পরিণত। ফলে যে কোনও ঘটনা ভালো ভাবে শুনবার, বুঝবার, দেখবার, জানবার আগেই মন্তব্য করি। মন্তব্য করি প্রচলিত ধারণা থেকে, বেরুতে পারি না প্রচলিত ধারণা থেকে। প্রচলিত ধারণাই, পূর্ব ধারণার জন্ম দেয় মূলত।
গত ক’দিন ধরেই আমার বেশ কিছু অতি উৎসাহী বন্ধু ফোন করছে। ‘তুমি হ্যাপির জন্য কিছু লিখলে না! হ্যাপির পাশে দাঁড়ালে না! কেমন ফেমিনিস্ট তুমি! একটা মেয়ে সাফার করছে! ও একটা মেয়ে!’
ফেমিনিজম সম্পর্কে এখানে লোকের ধারণা খুব সীমিত। ক্লিশেও কখনও কখনও। ফেমিনিজম মানেই ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, নৈতিক-অনৈতিকতার ন্যূনতম সীমাটিও সবক্ষেত্রে অতিক্রম করে যাবে, এমনটি নয়। ফেমিনিজম বরং অনেক বেশি হিউম্যানিজম। অনেক বেশি মানবিক
আমি যে কোনও কিছুই একটু সময় নিয়ে বুঝবার চেষ্টা করি। চাই গভীরে যেতে, ঘটনার। এক পাশ নয়, একদিক নয়, বিভিন্ন দিক থেকে দেখবার আন্তরিক চেষ্টাটি আমার বারবারই অব্যাহত। ফেমিনিজম সম্পর্কে এখানে লোকের ধারণা খুব সীমিত। ক্লিশেও কখনও কখনও। ফেমিনিজম মানেই ন্যায়-অন্যায়, উচিত-অনুচিত, নৈতিক-অনৈতিকতার ন্যূনতম সীমাটিও সবক্ষেত্রে অতিক্রম করে যাবে, এমনটি নয়। ফেমিনিজম বরং অনেক বেশি হিউম্যানিজম। অনেক বেশি মানবিক। মানুষকে মানুষ হিসাবে দেখা। নারী বা পুরুষ হিসেবে আলাদা করে দেখা নয় বরং আলাদা করে দেখার যে অসাম্য, বৈষম্য, অন্যায় সুযোগ নেবার প্রবণতা, প্রবঞ্চনা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। তবেই তা ফেমিনিজম। আর আমি নিজে নারী ও পুরুষকে আলাদা ভাবে দেখি না অনেক কাল, একথাটিও অনেকের জানা থাকবার কথা।
ক্রিকেটার রুবেল ও ফিল্ম অ্যাকট্রেস হ্যাপির প্রায় সবগুলো খবর পড়ি। খবরের কাগজে, অনলাইনে। ফেসবুকেও চোখ যায়। নিউজ ক্লিপও বাদ যায় না, টেলিভিশনের। ঘটনা কেমন যেন খাপছাড়া, মেলাতে পারি না। পরের কথার সঙ্গে আগের কথা, আগের কথার সঙ্গে পরের কথার মিল নেই হ্যাপির। কেমন যেন! ফাঁক, ফোকর কেন জানি বরাবরই আমার বড্ড চোখে পড়ে। এ আমার পুরোনো অভ্যেস। ফলে প্রায় সবাই সহজভাবে দেখলেও আমি খুব সহজভাবে দেখি না কোনও ঘটনাকে। যে কোনও ঘটনার তিনটি পক্ষ থাকে, একটি আমার, একটি আপনার, আরেকটি সত্যের। আমি সত্যের পক্ষটি বুঝবার চেষ্টা করি বরাবরই। এক্ষেত্রেও কিছু প্রশ্ন তৈরি হয়। প্রশ্ন আরও প্রশ্নের জন্ম দেয়। আরও আরও আরও।
ক্রিকেটার রুবেল ও ফিল্ম অ্যাকট্রেস হ্যাপির প্রায় সবগুলো খবর পড়ি। ঘটনা কেমন যেন খাপছাড়া, মেলাতে পারি না। পরের কথার সঙ্গে আগের কথা, আগের কথার সঙ্গে পরের কথার মিল নেই হ্যাপির
রুবেল ভালো। রুবেল মন্দ। হ্যাপি ভালো। হ্যাপি মন্দ। আমি কারও ভালো মন্দ বিচার করতে যাচ্ছি না। কোনও একটি মাত্র ঘটনা দিয়ে মানুষের ভালো মন্দ বিচার করাও যায় না। জগতে অ্যাবসিলিউট বলে কিছু নেউ, কেউ নেই। কোনও মানুষ, শতভাগ ফেরেস্তা নয়, আবার শতভাগ শয়তানও নয়। মানুষ মানুষই। মানুষের ভালো থাকবে, থাকবে মন্দ। মানুষ মন্দ-ভালো মিলিয়েই।
প্রেম কী কোনও প্রলোভনে হয়, প্রলোভন হলে কী তা প্রেম থাকে, খুব জানতে ইচ্ছে করছে। প্রেমের আর প্রলোভন কী? প্রেম তো প্রেমই। প্রেম হলেই বিয়ে হতে হবে এ তো ষোড়শ শতাব্দীরও পুরোনো ধারণা। আর যাই হোক জগতে শর্ত দিয়ে কখনও প্রেম হয় না। হলে, তা আর যাই হোক প্রেম নয়
কিন্তু হ্যাপির কথা আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না। হ্যাপি রুবেলের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। ধর্ষণ মামলা। আবার বিয়ে করলে হ্যাপি ধর্ষণ মামলা তুলে নেবেন, এমন কথাও এসেছে কাগজে, অনলাইনে, টেলিভিশনে। রুবেলের সঙ্গে হ্যাপির প্রেম হয় বছর খানেক আগে। রুবেল বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে হ্যাপির সঙ্গে প্রেম করেছেন এমন মন্তব্য হ্যাপির। প্রেম কী কোনও প্রলোভনে হয়, প্রলোভন হলে কী তা প্রেম থাকে, খুব জানতে ইচ্ছে করছে। প্রেমের আর প্রলোভন কী? প্রেম তো প্রেমই। প্রেম হলেই বিয়ে হতে হবে এ তো ষোড়শ শতাব্দীরও পুরোনো ধারণা। আর যাই হোক জগতে শর্ত দিয়ে কখনও প্রেম হয় না। হলে, তা আর যাই হোক প্রেম নয়। জগতে কত মানুষ আছে, যারা ভালোবাসে আজও ভালোবাসে সেই মানুষটিকে যাকে একদিন ভালোবেসেছিল। বলেছিল ভালোবাসি তোমাকে, ভালোবাসা মানেই বিয়ে এ কথাটিই বা কে বলল হ্যাপিকে? হ্যাপি বলেছেন, রুবেল এখন আর তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কটি রাখতে চাইছেন না। জানি না হ্যাপি-রুবেলের আদৌ প্রেম ছিল কি না। থাকলেও তা ভাঙতে পারে। আবার গড়তে পারে। প্রেম থেকে অপ্রেম, অপ্রেম থেকে প্রেম–এটাই তো জগত ও জীবন। আবার প্রেম কোনও শর্ত বস্তু নয় যে, সারাজীবন তা একই ব্যক্তি বা একই স্রোতধারায় বইবে। সম্পর্ক নিজেই নানা মাত্রা ও রূপ লাভ করে, গন্তব্যে পৌঁছায়। সিদ্ধান্ত দেয় আবার দেয় না। এটাই তো প্রেম, এটাই তো ভালোবাসা। জীবন যেমন বহতা নদীর মতো, মানুষে মানুষে সম্পর্কও তা-ই। ভাঙে আবার গড়ে, গড়ে আবার ভাঙে। আবার কিছু সম্পর্ক কিছুই তৈরি করে না, না প্রেম, না গভীরতা।
‘বিয়ের প্রলোভনে’র কথা বলেছেন হ্যাপি। বিয়ে কী কোনও লোভের বস্তু? লোভের কারণে কি বিয়ে হয়? তবে লোভটা কিসের? সম্পর্কের নাকি সম্পদের, ব্যক্তির না অর্থের? সম্পর্ক তো গড়ে উঠার বিষয়, গাছের ফল নয়, লোভের বস্তু নয়। প্রেমে বিয়ের প্রলোভন বলে কিছু নেই, প্রতিশ্রুতি আছে। কেউ বিয়ের কথা বললেই কি আমাকে শুয়ে পড়তে হবে? আর শোবই যদি সেই সিদ্ধান্ত, দায়িত্ব, দায় নেবার যোগ্যতাও আমার থাকা জরুরি।
জানি না হ্যাপি-রুবেলের আদৌ প্রেম ছিল কি না। থাকলেও তা ভাঙতে পারে। আবার গড়তে পারে। প্রেম থেকে অপ্রেম, অপ্রেম থেকে প্রেম–এটাই তো জগত ও জীবন। আবার প্রেম কোনও শর্ত বস্তু নয় যে, সারাজীবন তা একই ব্যক্তি বা একই স্রোতধারায় বইবে। সম্পর্ক নিজেই নানা মাত্রা ও রূপ লাভ করে, গন্তব্যে পৌঁছায়। সিদ্ধান্ত দেয় আবার দেয় না। এটাই তো প্রেম, এটাই তো ভালোবাসা
বিয়ে করলে ধর্ষণ মামলা তুলে নেবেন–সবচেয়ে ভয়াবহ মনে হয়েছে এই মন্তব্যটি। রুবেলের সঙ্গে একাধিকবার শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছেন হ্যাপি। রুবেল তাকে প্রায়ই ধর্ষণ করতেন তাহলে। ধর্ষণে কি প্রেম থাকে? প্রেমিক কি ধর্ষক হতে পারে, বুঝতে পারছি না আমি। ধর্ষণ একবার হতে পারে, জোর পূর্বক হতে পারে। হ্যাপি একাধিকবার শারীরিক সম্পর্কের কথা, সঙ্গমের কথা, রতিক্রিয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। রুবেল তো জোর করেননি, বাধ্য করেননি, হ্যাপি নিজেই গিয়েছেন। তাহলে সেখানে গিয়ে বারবার ধর্ষিতই বা হচ্ছিলেন কেন হ্যাপি? খুব জানতে ইচ্ছে করে। কী অদ্ভুত স্যাডিজম। ধর্ষিত হতেও ভালো লাগে! অনেক পুরুষ ও নারী আছে, যাদের রতিক্রিয়ার সময় না চড়ালে, না কামড়ালে তারা উত্তেজনা বোধ করতে পারে না। এক ধরনের যৌন শীতলতা পেয়ে বসে। আর সবচেয়ে বড় কথা যে লোকটি ধর্ষক তাকে কেন বিয়ে করতে হবে? কিসের আশায়, কিসের নেশায়? ধর্ষণের বিনিময়েও কি পেতে চাইছেন তার কাছ থেকে? সে যদি ভালোই না বাসে তাহলে কি পাবার আছে তার কাছ থেকে?
মানবাধিকারের দিক থেকে কেউ ভিন্ন নয়। না নারী, না পুরুষ। বিয়ে করলে যদি ধর্ষণ মামলা তুলে নেওয়া হয়, তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না কিংবা এটি সহজে বোঝা উচিত, হ্যাপি নিজেও একটি ফাঁদ পেতেছেন। যৌন ফাঁদ। বিয়ের ফাঁদ। এই মামলাটি তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে হ্যাপি নিজে আরেকটি মামলায় জড়াবেন, সেটি মিথ্যে মামলার ফাঁদ
আমি প্রচণ্ড সমতায় বিশ্বাস করা মানুষ। আমার কাছে অধিকারের দিক থেকে, মানবাধিকারের দিক থেকে কেউ ভিন্ন নয়। না নারী, না পুরুষ। বিয়ে করলে যদি ধর্ষণ মামলা তুলে নেওয়া হয়, তাহলে বুঝতে বাকি থাকে না কিংবা এটি সহজে বোঝা উচিত, হ্যাপি নিজেও একটি ফাঁদ পেতেছেন। যৌন ফাঁদ। বিয়ের ফাঁদ। এই মামলাটি তুলে নেবার সঙ্গে সঙ্গে হ্যাপি নিজে আরেকটি মামলায় জড়াবেন, সেটি মিথ্যে মামলার ফাঁদ। নারীদের জন্য, নারীদের অসহায়ত্বের জন্য কিছু বাড়তি আইন আছে বলে, আমি পুরুষকে তা দিয়ে হয়রানি করব, অপব্যবহার করব, তা আর যাই হোক কোনোভাবেই নারীবাদ নয়। নারীর অধিকার তো নয়ই। শুধু নারী বা পুরুষ নয়, কোনো মানুষকে হয়রানি কখনোই পারে না কোনো সত্য মানুষের কাজ হতে।
এই লিখতে লিখতে অনলাইনে চোখ যায়। হ্যাপির নতুন মন্তব্য ‘রুবেলকে বিয়ে করবো না, মামলা চলবে, বিচার চাই আমি।’ হ্যাপি বিচার চান ভালো কথা, কিন্তু কিসের বিচার? এখন তো আবার বিয়েও চাইছেন না তিনি। বলছেন, প্রতারণা। কিসের প্রতারণা? কেউ কি তাকে জোর করেছে, বাধ্য করেছে সঙ্গমে?
রুবেল-হ্যাপির এই ঘটনায় আমার শুধু একটিই বলবার, যে কারও সঙ্গে শোবার আগে, যে কাউকে ছোবার আগে, একটু ভেবে দেখা জরুরি।
নারী কিংবা পুরুষ যেই হোন আপনি।
লেখক: সদস্য, ফেমিনিস্ট ডট কম, যুক্তরাষ্ট্র
পরিচালক, বাংলাদেশ সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশন
সম্পাদক সাপ্তাহিক কাগজ ও মিডিয়াওয়াচ।