কেউ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কেউ বা শারীরিক প্রতিবন্ধী, আবার কেউ বাক প্রতিবন্ধী। কারও নেই বাবা, কারো বা নেই মা, তারা সবাই অনাথ। তাই ওদের আশ্রয় হয়েছে দেশের বিভিন্ন সরকারি আশ্রমে। আর এসব অসহায় অনাথ শিশুদের নিয়ে অন্যরকম দিন কাটল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাফারী পার্কে।
অন্যান্য দিনের মতো দেশের বিভিন্ন এলাকার দর্শনার্থীদের আগমনে পার্কটি মুখরিত থাকলেও শনিবার ছিল শুধুই অনাথ শিশু-কিশোরদের। অন্তত ১ হাজার অনাথ শিশু-কিশোর মিলে আনন্দ-হাসি আর উল্লাসে মেতে উঠে। ছিল বিনে পয়সায় পার্কের সকল ইভেন্ট ঘুরে দেখার সুযোগও।
শনিবার সকাল থেকেই সমাজ সেবা অধিদপ্তরের আয়োজনে ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার ২৯টি সরকারি আশ্রমের
সহস্রাধিক শিশুদের উল্লাসে মুখরিত ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক।
টাঙ্গাইল সরকারি শিশু সদনের ১০বছর বয়সী শিশু আঞ্জুমান আরা। জন্মের পরই বাবা মারা যান, মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর তার আশ্রয় হয় জেলা শহরের সরকারি আশ্রমে। আগে সরকারিভাবে বিভিন্ন সময় বিনোদনের চাহিদা পূরণ হলেও এবারটা ভিন্ন, কারণ সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আনা বাঘ ও সিংহ দেখতে পেয়েছে সে।
ঢাকার মিরপুরের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সোহেল চৌধুরীর (১৪) বাড়ি মাদারীপুরের শিবচরে হলেও প্রায় ৭বৎসর ধরে সরকারি আশ্রমে রয়েছেন। সাফারী পার্কে আসতে পেরে সেও উচ্ছ্বাসিত। চোখে দেখতে না পারলেও বিভিন্ন প্রাণীর ডাক ও চিৎকার চেচামেচিতে আনন্দ পেয়েছে বলে জানায় সে।
ভাল গান গাইতে পারে অন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মফিজুল হক (১২)। আনন্দ-উল্লাসে শরীরে সামান্য ক্লান্তি আসায় সে গাছের ছায়ায় বসে গান ধরেছেন ‘নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, সকল বাঁধা পেড়িয়ে…. আর অন্যান্যরা মনোযোগ দিয়ে তার গান শুনছেন।
গান শেষ হলে তিনি জানান, তিনি এসেছেন ফরিদপুর থেকে, একজন প্রতিবন্ধী হয়েও এতদূর আসতে পেরেছেন এ জন্য উদ্যোগ গ্রহণকারীদের ধন্যবাদ জানান।
ময়মনসিংহের অনাথ কিশোরী রোজিনা আক্তার (১৩) জানান, বিভিন্ন জনের কাছে সে গাজীপুরের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্কের কথা শুনেছেন। এবার এটি দেখার সুযোগ পেয়েছেন। তিনি সবার সাথে সকাল থেকেই ঘুরে দেখছেন, এটাই যেন তার আনন্দ।
টাঙ্গাইল সরকারি শিশু সদনের (বালক) উপ-তত্বাবধায়ক নূরে লাইলা ৫০ জন অনাথ শিশু কিশোর নিয়ে এসেছেন। তিনি জানান, এরা সবাই অসহায় হলেও সরকার এসব শিশু কিশোরদের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাদের বাবা ও মায়ের অভার পূরণ করা না গেলেও তাদের অন্যান্য সবকিছুই সরকার পূরণ করে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় এই সাফারী পার্কে শিশুরা আসতে পেরে খুবই উল্লাসিত। এবার বিনোদনে তারা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
কিশোরগঞ্জের সরকারি শিশু পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের সাবিতা আলম তার কেন্দ্রের ৪২জন অনাথ শিশু কিশোর নিয়ে বিভিন্ন ইভেন্ট দেখছেন সকাল থেকেই।
তিনি জানান, প্রথমবারের মত সাফারী পার্কে অনাথরা আসতে পেরে খুবই আনন্দিত। তারা একটি নির্দিষ্ট গন্ডির ভেতর থেকেই বড় হচ্ছে। তবে এত বড় পরিসরে সকল অনাথরা একসাথে চিত্তবিনোদনের সুযোগ পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
গাজীপুর জেলা সমাজসেবা বিভাগের উপ-পরিচালক এসএম আনুয়ারুল করিম জানান, গত ২৮ই ও ২৯ই মার্চ গাজীপুরের কোণাবাড়িতে অবস্থিত দুস্থ শিশু প্রশিক্ষণ ও পূনর্বাসন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়েছে বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা। এতে ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলার ২৯টি সরকারি শিশু পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রের প্রায় এক হাজারের বেশি অনাথ শিশু, কিশোর ও প্রতিবন্ধীরা অংশগ্রহণ করেন। তবে দূর-দূরান্ত থেকে এসব অনাথরা একসাথে হওয়ায় তাদের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক পরিদর্শনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অনাথ শিশুদের চিত্তবিনোদনের ভিন্ন মাত্রা দেয়ার বিষয়ে মূল উদ্যোক্তা ছিল গাজীপুরের জেলা প্রশাসনের।
জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, অনাথ শিশুদের কথা বিবেচনা করেই সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারী পার্ক দর্শনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এসব অনাথদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
সাফারী পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী বন সংরক্ষক তাবিবুর রহমান জানান, সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রায় এক হাজার অনাথ শিশুদের বিনামূল্যে প্রবেশসহ সকল ইভেন্টই বিনামূল্যে পরিদর্শনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। অনাথদের আগমনে সকাল থেকেই পার্কটি হৈ হুল্লোড় ও উল্লাসে মুখরিত ছিল।