হাফিজুল ইসলাম লস্কর, সিলেট :: গত ১৫ মার্চ নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে আল-নুর মসজিদে জুমআর নামাজরত মুসল্লিদের উপর উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী হামলায় ৫০ জন নিহত হয়। নিহতদের মাধ্যে ছিলেন হোসনে আরাসহ বাংলাদেশী ৫ জন। বর্বরোচিত এই হামলায় নিহত সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীপাশা ইউনিয়নের জাঙ্গালহাটা গ্রামের মৃত নুর উদ্দিনের মেয়ে হুসনে আরা পারভীন। তার এমন বেদনাদায়ক মৃত্যুতে শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে গোলাপগঞ্জ। হোসনে আরা হত্যাকেন্ডের ১৫দিন পেরিয়ে গেলেও আজো কান্না থামেনি গোলাপগঞ্জ উপজেলার মানুষের। সেই শোকের মাত্রা আরো শতগুন বেশী গোলাপগঞ্জের জাঙালহাটা গ্রামে। শুধু গোলাপগঞ্জ বা সিলেট নয় নৃশংস হামলায় অর্ধশত মানুষের মৃত্যুর ঘটনায় গোটা বিশ্বই শোকাহত। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বকে বেশি আঘাত করেছে এই জঙ্গি হামলা।
মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া অসুস্থ স্বামীকে উদ্ধার করতে গিয়ে ঘাতকের বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছে হোসনে আরা’র বুক। মুহুর্তেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। তার মৃত্যুতে শোকাহত গোলাপগঞ্জবাসীসহ তাহার পরিবারের শান্তনা একটাই স্বামীর জন্য জীবন বিলিয়ে দেওয়া হোসনে আরা শহীদ হয়েছেন।
হুসনে আরা পারভীনের স্বামী ফরিদ উদ্দিন আহমদের বাড়ি সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার উত্তর মিরেরচক গ্রামে। কয়েকবছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে তিনি দুটি পা হারিয়েছিলেন। এরপর থেকে তাকে চলতে হতো হুইল চেয়ারে। আর হোসনে আরা পারভিনের একমাত্র সন্তান শিপা আহমদ (১৪) মোটামুটি স্বাভাবিক। মা নেই, এই সত্যটি মেয়েটি বুঝতে পারলেও আত্মীয়স্বজন সবসময় ঘিরে রাখায় সে এখন শান্তই আছে। এদিকে তার স্বামী ফরিদ আহমদও শোকের ধাক্কা সমালে উঠে স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ফেরার চেষ্ট করছেন। এদিকে দেশে থাকা হোসনে আরার ভাই ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনও শোকের দখল সামলে উঠেছেন বলে জানিয়েছেন তার ভাইপো মনিরুজ্জামান। তারপরও হোসনে আরা খুনের ঘটনায় বিশেষ করে তার বাবার বাড়ি গোলাপগঞ্জ উপজেলা এবং বিশ্বনাথ উপজেলায় শোকের আবহ এখনো বিরাজ করছে। উপজেলার যাকে হোসনে আরার কথা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে সেই আবেগে অশ্রূশ্রজল হয়ে যাচ্ছে।
হোসনে আরা পারভিনের ভাই নাজিম উদ্দিন (৬০) এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারছেন না। আত্মীয় স্বজন এলে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে প্রায়ই ভেঙে পড়েন। অন্যান্যদের অবস্থাও তাই। সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হোসনে আরার গ্রামের মুরব্বিরা আসছেন, কাঁদছেন শান্তনা দিচ্ছেন এই বলে যে, নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে আল-নুর মসজিদে জুমআর নামাজরত মুসল্লিদের উপর উগ্রপন্থী সন্ত্রাসী হামলায় নিহত সকলেই শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন। তারা সবাই সরাসরি জান্নাতবাসী হবেন এটাই আমাদের শান্তনা।
গোলাপগঞ্জের স্বেচ্ছা-সেবকলীগের সাবেক সভাপতি সামছুল ইসলাম লস্কর বলেন, হুসনে আরা পারভীনের এমন মৃত্যু কখনোই কাম্য ছিল না। এমন নৃশংসতার তীব্র নিন্দা জানাই আমি। সেই সাথে আমি বলতে চাই মুসলিমরা সন্তান নয় বরং তারা শান্তিকামী।
গোলাপগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর সাথে হোসনে আরা সম্পর্কে আলোচনা করতেই তিনি আবেগে অশ্রূশ্বজল হয়ে ওঠেন। এবং বলেন আল্লাহ হোসনে আরা’কে জান্নাতের সু-উচ্চ মাকাম দান করুন। এবং সন্ত্রাস-বাদের প্রতি নিন্দা জানিয়ে সন্ত্রাসী সর্বোচ্চ শাস্তি দাবী করেন।
জানা গেছে, ১৯৯৪ সালে ফরিদ উদ্দিন আহমদের সাথে হুসনে আরা পারভীন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের কয়েক বছর পরই তারা নিউজিল্যান্ডে যান। সর্বশেষ ২০০৯ সালে দেশে বেড়াতে এসেছিলেন এই দম্পতি। স্বামী, একমাত্র মেয়ে ও দুই ভাইবোনের সাথেই ক্রাইস্টচার্চে বসবাস করছিলেন হুসনে আরা পারভীন। ১৫ মার্চ ২০১৯ শুক্রবার স্বামীর সাথে জুমআ’র নামাজ আদায় করতে ক্রাইস্টচার্চের একটি মসজিদে গিয়েছিলেন পারভীন। মসজিদের পুরুষ অংশে স্বামীকে রেখে নিজে মহিলা অংশে নামাজ আদায় করতে গিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যেই গোলাগুলির শব্দ শুনে স্বামীর খোঁজ করতে যান তিনি। ওই সময় সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।