সৌরবিদ্যুতেও পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি

কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি জাতীয়

download-1সৌরবিদ্যুৎ। সবুজ প্রযুক্তির বিকল্প জ্বালানি। উন্নত ও উন্নয়নশীল— সব দেশেই দ্রুত হারে বাড়ছে এর ব্যবহার। পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। এরই মধ্যে সারা দেশে প্রায় অর্ধকোটি সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। আগামী তিন বছরে আরো ৩০ লাখ পরিবারকে এর আওতায় আনার লক্ষ্য ধরা হয়েছে। যদিও সোলার হোম সিস্টেমের মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যাটারির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কোনো নীতিমালা দেশে নেই। সাধারণ বর্জ্যের মতো ব্যবস্থাপনার কারণে পরিবেশ দূষণের নতুন ঝুঁকি হয়ে উঠছে এসব ব্যাটারি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যবস্থাপনার সঠিক পন্থা অনুসরণ না করায় মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যাটারির সিসা ও অন্যান্য রাসায়নিক সরাসরি পরিবেশের সঙ্গে মিশছে। শ্বাস-প্রশ্বাস ও খাদ্যচক্রের মাধ্যমে পরে তা ঢুকে পড়ছে মানবদেহে। সুযোগ করে দিচ্ছে স্নায়ুতন্ত্র, ফুসফুস ও কিডনির জটিল সব রোগের।

পরিস্থিতিটি বেশ আতঙ্কজনক— এমন অভিমত ব্যক্ত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান বলেন, নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে সিসা। এমনকি এ থেকে ক্যান্সার পর্যন্তও হতে পারে। আর শিশুদের জন্য তা আরো বেশি বিপজ্জনক।

দেশে ক্যান্সারের রোগী আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার কথা বলছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটির হিসাবে, বর্তমানে সারা দেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। প্রতি বছর দুই লাখ মানুষ নতুন করে রোগটিতে আক্রান্ত হচ্ছে। আর মারা যাচ্ছে দেড় লাখ করে।

যদিও বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের সম্প্রসারণকে অসামান্য সাফল্য হিসেবে দেখছে জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে এরই মধ্যে সারা দেশে ৪৫ লাখের মতো সোলার প্যানেল ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। এ সংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। প্রতিটি ইউনিটের সঙ্গে রয়েছে একটি করে লেড এসিড ব্যাটারি। উপাদান হিসেবে এসব ব্যাটারিতে আছে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সিসা ও সালফিউরিক এসিড। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি নিয়ে সোলার প্যানেল স্থাপনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েছে। দেশে সোলার প্যানেল বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশ গ্রামীণ শক্তির দখলে।

গ্রামীণ শক্তির কনসালট্যান্ট আবদুল গোফরান বলেন, ‘ব্যাটারি অকার্যকর হয়ে গেলে ডিসপোজ করা যায় না। এটা একটা সমস্যা। তবে আমাদের কাছে পুরনো ব্যাটারি নিয়ে এলে তা সংগ্রহ করে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে ফেরত দিই আমরা।’

পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ২০০১ সালে ‘লেড ব্যাটারি ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড হ্যান্ডলিং’ শীর্ষক বিধি প্রণয়ন করে। নতুন ব্যাটারি বিক্রি ও পুরনো ব্যাটারি ফেরত নেয়া এবং রিসাইক্লিং সম্পর্কে নিয়ম-কানুন সুনির্দিষ্ট করে দেয়া আছে তাতে। সে অনুযায়ী নতুন লেড এসিড ব্যাটারি বিক্রির বিপরীতে উৎপাদক ও আমদানিকারকদের নির্দিষ্ট সংখ্যক পুরনো ব্যাটারি সংগ্রহ করতে হয়। ছয় মাস অন্তর এ-সংক্রান্ত তথ্য সংশ্লিষ্ট দফতরে জানানোরও বিধান রয়েছে। আর সংগৃহীত এসব পুরনো ব্যাটারি পাঠাতে হয় নিবন্ধিত রিসাইক্লিং কারখানায়। বাংলাদেশে সৌরবিদ্যুতের ব্যবহার বাড়লেও পুরনো ব্যাটারির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত কোনো নীতিমালা এখনো তৈরি হয়নি। মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর ভাঙ্গারি হিসেবে তা বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে। পরে তা উচ্চতাপে গলিয়ে সিসা সংগ্রহ করা হয়। এসব সিসা বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। আর সালফিউরিক এসিডসহ অন্যান্য রাসায়নিক ফেলে দেয়া হয় মাটি ও পানিতে।

যোগাযোগ করা হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এনার্জির পরিচালক অধ্যাপক ড. সাইফুল হক বলেন, লেড এসিড ব্যাটারি ভেঙে গেলে বা নষ্ট করে ফেললে তা খুবই বিপজ্জনক। অনেক প্রতিষ্ঠানই পরিবেশ দূষণের বিষয়টি চিন্তা করে না। সিসা কুড়িয়ে বাকি কেমিক্যাল মাটিতে ফেলে দেয়। তাই ব্যাটারির ব্যবস্থাপনা নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন। শুধু সৌরবিদ্যুতই নয়, গাড়ির ব্যাটারিতেও পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এ বিষয়টিও নীতিমালায় থাকা প্রয়োজন।

তবে সিসা ও পারদ দূষণ বন্ধে পরিবেশ অধিদফতর কাজ করছে বলে জানান সংস্থাটির পরিচালক (বায়ুমান) মাহমুদ হোসেন খান। তিনি বলেন, সোলার প্যানেলের মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যাটারি যেখানে সেখানে পুড়িয়ে সিসা বের করা হচ্ছে। অন্যান্য বর্জ্যও সরাসরি মাটি ও পানিতে ফেলে

দেয়া হচ্ছে। এগুলোর ব্যবস্থাপনা কী পন্থায় হবে, তা ঠিক করতে সরকারের উচ্চপর্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে পরিবেশ অধিদফতর।

জানা গেছে, অধিকাংশ সৌরবিদ্যুৎ ইউনিটে ব্যাটারির ওয়ারেন্টি দেয়া হয় পাঁচ বছর পর্যন্ত। তবে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর এসব ব্যাটারির ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সঠিক ধারণা নেই এ খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিদ্যুৎ মেলায় মেয়াদোত্তীর্ণ লেড এসিড ব্যাটারির বিষয়ে জানতে চাইলে সুপার স্টার সোলার ও জেটিএস গ্রুপের কর্মকর্তারা জানান, ব্যাটারিতে প্রচুর সিসা থাকে। মেয়াদ পেরিয়ে গেলে এসব ব্যাটারি ভাঙ্গারির দোকানে ভালো দামে বিক্রি করা যাবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে এভাবে ব্যাটারি ভাঙলে ৫০ ডলার পর্যন্ত জরিমানার বিধান রয়েছে দেশটিতে।- বণিক বার্তা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *