ছোট্ট মেয়ে বৃষ্টি। বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে। এই মেয়েকে ঘিরে বাবার কতই না স্বপ্ন ছিল। নিজের সেই স্বপ্ন পূরণে কঠোর পরিশ্রম করতেন বাবা ইব্রাহিম। প্রতিদিন সকাল হতে না হতেই রিকশা নিয়ে বের হয়ে যেতেন উপার্জনের আশায়। মাঝে মধ্যে দুপুরে বাসায় ফিরলেও দেখা হতো না বৃষ্টির সাথে। রাতে যখন বাবা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত হয়ে বাসায় ফিরতেন। অমনি বাবাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরত ছোট্ট মেয়ে বৃষ্টি। আজ বৃষ্টির বাবা নেই। নেই বাবার আদরও। তাই বৃষ্টি আজ নির্বাক। মেয়েটি সবে মাত্র চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। চুড়িহাট্টার ভয়াবহ আগুন ওর বাবাকে বাঁচতে দিলো না। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন বাবা ইব্রাহিম। এরপর বাবার খোঁজ পেতে সিআইডিতে ডিএনএ নমুনা দিয়েছিল মেয়েটি। তারপর অপেক্ষা। দুই সপ্তাহ অপেক্ষার পরে খোঁজ মিলল বৃষ্টির বাবার। কিন্তু শেষবারের মতো বাবার মুখটিও দেখা হলো না। দেখে যে চেনার উপায়ও নেই। পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া শুধু ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে শনাক্ত বাবার লাশের প্যাকেটের দিকে নির্বাক তাকিয়ে আছে মেয়েটি। এ দিকে স্বামীর অঙ্গার হয়ে যাওয়া লাশ দেখে খালি বিলাপ করছেন বৃষ্টির মা রোকসানা। থেকে থেকে তার চিৎকার আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে মর্গের পরিবেশ। এক সময় জ্ঞান হারান রোকসানা। এ সময় মাকে জড়িয়ে ধরে ছিল ছোট্ট বৃষ্টি। শেষ বিকেলে এক রাশ অনিশ্চয়তা আর মলিন মুখে বাবার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে মায়ের সাথে রওনা হয় বৃষ্টি। এমন অসংখ্য বেদনাবিধুর ঘটনা জড়িয়ে আছে চকবাজার চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডিতে। স্বজন হারাদের এই আর্তনাদ আর আহাজারি কাটিয়ে উঠুক শোক আর শোক হয়ে উঠুক শক্তির আধার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, চুড়িহাট্টার পোড়া লাশের অবশিষ্টাংশ দেখে কোনোভাবেই চেনার উপায় ছিল না কোনটা কার লাশ। তাই লাশগুলো আলাদা করে বিশেষ কোড নাম্বার দিয়ে প্যাকেট করা হয়। সেই প্যাকেট থেকে ডিএনএ নিয়ে লাশের দাবিদার স্বজনদের ডিএনএ মেলানো হয়। যে প্যাকেটের কোড নাম্বারের সাথে স্বজন দাবিদারদের ডিএনএ মিল পাওয়া যায়, সেটাই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
চকবাজার থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মুরাদুল হক বলেন, বুধবার সিআইডির ডিএনএ টেস্টের মাধ্যমে ১১ জনের লাশ শনাক্ত করে। শনাক্ত হওয়া লাশের বিস্তারিত তথ্য তাদের কাছে দেয়া হলে থানা পুলিশ নিহতদের স্বজনদের ফোন করে লাশ নিতে বলে। এর মধ্যে আটজনের পরিবার গত বুধবার লাশ নেয়ার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল মর্গে আসে। বুধবার রাতে আটজনের লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তারা হলো : নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের আহসানুল্লাহ, চকবাজারের জসীমউদ্দিনের মেয়ে ফাতেমাতুজ জোহরা বৃষ্টি, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জের মো: হাসানের ছেলে তানজিল হাসান রোহান, সোহরাব হাওলাদের ছেলে নুরুজ্জামান, চকবাজারের লাল মিয়ার ছেলে সালেহ আলম লিপু, লিপুর স্ত্রী নাসরিন জাহান, এনামুল হক ও শাহিন আহমেদ। বাকি তিনজনের মধ্যে ইব্রাহিম ও নুরুলের লাশ বিকেলে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ ছাড়া দুলাল কর্মকারের লাশও বৃহস্পতিবার রাতেই হস্তান্তরের কথা। তবে রাত ৮টায় এ খবর লেখা পর্যন্ত দুলালের লাশ মর্গে ছিল।
জানা গেছে, পরিবার গত বুধবার দুপুরে সংবাদ পেয়েছে চকবাজারের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হওয়াদের মধ্যে বৃষ্টির বাবা ইব্রাহিমের লাশও রয়েছে। এমন খবরে শরীয়তপুর থেকে বৃষ্টি ও তার মা রোকসানা গতকাল ভোরে ঢাকায় পৌঁছান। লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নেমেই সরাসরি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে চলে আসেন তারা। মর্গে সাদা ব্যাগভর্তি বাবার লাশ নির্বাক তাকিয়ে ছিল বৃষ্টি।
২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বাবা বাসায় না ফিরলে পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে উদ্বিগ্ন হয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকে বৃষ্টিও। লাশ হস্তান্তরের আগে মর্গের লাশ গোসল করানোর ঘর থেকে মুখ দেখানোর জন্য ডাক দেয়া হয় স্ত্রী রোকসানাকে। বৃষ্টি অনেকবার বাবার লাশ দেখতে চাইলেও তাকে যেতে দেয়নি পরিবারের অন্য সদস্যরা। ইব্রাহিমের অঙ্গার লাশ দেখামাত্র জ্ঞান হারান রোকসানা। অবশেষে ইব্রাহিমের লাশ কামরাঙ্গীরচরে তার নিজ বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজা শেষে কবর দেয়া হয় আজিমপুর কবরস্থানে।
গতকাল সকালে শনাক্ত হওয়া দু’টি লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। হস্তান্তর হওয়া অন্য লাশটি নুরুল হকের (৩০)। তার বাবার না আতাব মিয়া। গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। ঢাকায় ইসলামবাগে থাকতেন। স্ত্রী রহিমা আক্তার এক বছর বয়সী শিশু আলামিনকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতেন।
নিহতের ভাই আয়নুল হক জানান, নুরুল হক ওয়াহেদ ম্যানশন সংলগ্ন মসজিদের সামনে সবজির ব্যবসা করতেন। ঘটনার সময় নুরুল হক সেখানেই অবস্থান করছিলেন।
মেয়ের জামাইর লাশ নিতে এসে নুরুল হকের শ^শুর ফজলুল রহমান বলেন, আমার মেয়েটিকে মাত্র দুই বছর আগে বিয়ে দিয়েছি। এখন জামাইয়ের লাশ নিয়ে বাড়ি যেতে হচ্ছে। মেয়ে আর নাতিটাকে নিয়ে কি করব এটাই আমার সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা। তিনি বলেন, লাশ বুঝে পেয়েছি। এখন কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে জামাতার বাড়িতে তার লাশ নিয়ে যাবো । সেখানে আমার নাতি, মেয়ে, জামাতার মা আর সবাই আছেন।
ফজলুর রহমান বলেন, নুরুল হক চকবাজার এলাকায় সবজি বিক্রি করত। ঘটনার দিন রাত ৯টায় তার সাথে শেষ কথা হয়। রাত ১১টায় আগুন লাগার খবর পাই। এর পর থেকে তার ফোন বন্ধ। প্রথমে ২১টা লাশ দেখি কিন্তু তখন তাকে চিনতে পারিনি।
তিনি আরো বলেন, আমাদের নোয়াখালী থেকে ওর বাড়ি অনেক দূর। তাই প্রথমে বিয়ে দিতে চাইনি। মেয়ের মায়ের পছন্দে এই বিয়ে দিই। আজ ছেলেটা চলেই গেল। আমার মেয়ের এখন কি হবে? বলে অঝোরে কাঁদতে থাকেন তিনি।