মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক সুমনঃ উত্তরা প্রতিনিধিঃ
অভিনব প্রতারণার গল্প সাজিয়ে প্রতারণামূলক বহু বিবাহ করাই ছিল মহিলা প্রতারক শাহনুর রহমান সিক্ত ওরফে সিক্ত খন্দকার ওরফে তাহামিনা আক্তার পলি ওরফে তামিমা আক্তার পলির একমাত্র কাজ। স্মার্ট চলাফেরা আর মৌখিক ইংরেজি সুনিপুন ভাবে রপ্ত করে অভিজাত চলাফেরা দিয়ে ভদ্র পুরুষ সাধারণকে প্রতারণার জালে আটকানোই ছিল তার মূল লক্ষ্য। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ ব্যাচ ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী এবং ৩৬ তম বি সি এস এর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পরিচয় দিয়ে উত্তরায় জনৈক ব্যাক্তিকে প্রতারণামূলক বিবাহ করে ধরা পড়ে এখন জেল হাজতে। গত ০২/০২/২০১৯ ( মামলা নং ৩(২)১৯) তারিখে উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ মামলার এযাহার সুত্রে তাকে আটক করে।
উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ প্রতারক মহিলাকে আটক করার পর চাঞ্চল্যকর প্রতারণার সব তথ্য বেরিয়ে আসে। প্রায় ড’জন খানেক স্বামীর সন্ধান পাওয়া যেতে থাকে। প্রতারক শাহনুর রহমান সিক্ত’র মোবাইল থেকেই ফেইসবুকের মাধ্যমে তার পূর্বের চলমান স্বামীর মেসেজ থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে আসতে থাকে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়য়ের জনৈক ছাত্রনেতা যার সঙ্গে ২ বছর আগে এমন অভিনব গল্প সাজিয়ে বিবাহ করে, এই প্রতারক মহিলা। বি পি এ টি সির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন বেশ কয়েক বছর আগে এই সিক্ত খন্দকার নিজেকে ডাক্তার পরিচয় দিয়ে সাভারের স্থানীয় এক যুবককে বিয়ে করে। কিছুদিন পর তার আসল পরিচয় জানা গেলে ঐ যুবক পি এ টি সি তে অভিযোগ করলে প্রতারক মহিলাকে পি এ টি সি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এখানেই থামেনি সিক্ত’র প্রতারণা বরং কৌশলও নিপুনতাকে বাড়িয়ে সে অভিনব প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে আরও একের পর এক বিভিন্ন নামে সে প্রতারণামূলক বিবাহ করে এবং বিভিন্ন সরকারী চাকুরীর লবিং করিয়ে দেবার নামে এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি করিয়ে দেবার নামে কোটি টাকা এবং স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায় প্রথমে তার ফুফাতো ভাই শেখ শাহীন উল্লাহ এর সঙ্গে সিক্ত’র বিয়ে হয়। এবং শাহীন উল্লাহর ওরসে তানজানুল ইয়াফ রাফি (ডাক নাম মাহিন) নামে ১৪ বছরের একটি ছেলে আছে যে বি পি এ টি সি স্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়াশোনা করে। অথচ প্রত্যেক বিবাহের সময়ই সে নিজেকে কুমারী পরিচয়ে ভিন্ন ভিন্ন নামে বিবাহ করেছে। গভীর অনুসন্ধানে জানা যায় প্রতারক সিক্ত খন্দকার নিজেকে সমাজের অতি উচ্চ শ্রেণির সম্ভ্রান্ত পরিবারের একজন উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী তরুণী অফিসার হিসেবে নিজেকে সবার কাছে গ্রহনযোগ্য করে তোলার কৌশল রপ্ত করেছে ১০-১২ বছর ধরে। তার পরিচয়ের নমুনা এমন- মা আনোয়ারা বেগম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩য় ব্যাচ অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন, বর্তমানে পি এ টি সির ট্রেনিং ডিরেক্টর, ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ পাশ করে বর্তমান বি পি এ টি সির ফিজিকাল ইন্সট্রাক্টার, বড়বোন পি জি হাসপাতালের গাইনি বিভাগের বড় ডাক্তার। দুলাভাই ইঞ্জিনিয়ার, একমাত্র চাচা আর্মির ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, এবং সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান তার আপন মামা। আর নিজের চারটি ফার্স্ট ক্লাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮ ব্যাচ ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্রী। প্রকৃত অর্থে তার মা বি পি এ টি সির ডরমেটরির আয়া, বাবা ছিলেন পি এ টি সির ড্রাইভার রুপাই বেপারী। রুপাই বেপারী অকালে মারা গেলে পি এ টি সির কর্তৃপক্ষ তার মা কে আয়ার চাকুরীটা দেয়। বাকী চাচা মামার সব পরিচয়ই ভূয়া। এবং নিজে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্তই লেখাপড়া করেছে মাত্র । ৬ষ্ঠ শ্রেণী থেকে ঐ স্কুল তাকে বহিষ্কার করে । পি এ টি সির কর্মচারী কোয়ার্টারে মায়ের সঙ্গে থাকার সুবাদে বি সি এস ক্যাডারদের ট্রেনিং কালে কৌশলে তাদের সঙ্গে পরিচয় সুত্র ধরে আয়ত্ত্ব করে ফেলে বি সি এস এর প্রথম শ্রেনীর চাকুরীর সব বিষয়াদি পদ-পদমর্যাদা প্রভৃতি।
অন্যদিকে পি এ টি সির খুব কাছেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হওয়ায় সে গড়ে তোলে আরেক প্রতারণার সফল ক্ষেত্র। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ছাত্রদের সঙ্গে নিজেকে মাননসই করে রপ্ত করে ফেলে সে ইংরেজি বিভাগের ৩৮ ব্যাচের অনার্স-মাস্টার্সের ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। জাবির ভিসি প্রোভিসি থেকে শুরু করে শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাত্রনেতা-নেত্রীর প্রায় সবাইকে নানা কৌশলে চিনে ফেলে এবং ফেইসবুকে জাবিয়ানদের কাছে সে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত শিক্ষার্থীর মতোই পরিচিত হয়ে ওঠে। জাবি’র বিভিন্ন ব্যাচের রি-ইউনিয়নে সে সরব উপস্থিত থাকে। সে ফেইসবুকে জাবি’র ৩/৪ হাজার মিউচুয়াল ফ্রেন্ড গড়ে তোলে। এভাবে সর্ব শেষ প্রতারণামূলক বিবাহ করে জনৈক লেখক গবেষক ও শিক্ষক যিনি নিজে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন, যাকে বিবাহের নামে তার আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে চাকুরি পাইয়ে দেবার নামে সাড়ে সাত লক্ষ টাকা এবং ১০ লক্ষ টাকার স্বর্ণ অলংকার হাতিয়ে নেয়।এমনকি বাদির ছেলেকে ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করানোর নামে হাতিয়ে নিয়েছে অনেক টাকা। এখন তিনি সর্বশান্ত প্রায়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বিশ্বাসেই প্রথম আস্থা অর্জন করে নেয় প্রতারক মহিলা। এমন কি যে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট শাহনুর রহমান এর রোল কে ব্যাবহার করেছে প্রতারক মহিলা তিনিও জাবির ৩৮ ব্যাচ গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে দিনাজপুরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।
পি জি হাসপাতালের জনৈক বি সি এস ডাক্তার এবং রাউজানের জনৈক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কে বিবাহের আসর থেকে পালিয়ে এসে জাবিয়ান (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে) বিবাহ করা, প্রেম করা, তার পেশা ও নেশা হয়ে ওঠে। ইতোমধ্যে জাবির ৩৫ ব্যাচ ইতিহাস বিভাগের জনৈক ব্যাবসায়ীকে বিয়ে করে সর্বশান্ত করেছে। ঢাকা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে তিনিও আরেকটি প্রতারণার মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং ৪৯(২)১৯ তারিখ ১০/০২/২০১৯ ইং। যেখানে আসামির সহযোগী বড় দুলাভাইও গ্রেফতার হয়ে জেল-হাজতে আছে। বিষয়টি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দের মাঝে প্রচন্ড হতাশাও ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে । জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী নতুন পুরাতন সবার সঙ্গে সবার রয়েছে মধুর বন্ধন। এ বন্ধন এখন সন্দেহের মধ্যে নিপতিত হলো। মামলার বাদী জানায়, এ মামলায় জাবির আরও
অনেকের সর্বনাশের তথ্য প্রমাণ আসছে, সূক্ষ্ম পরিকল্পনা করে একটা প্রতারক চক্র এটি করছে। খুব দ্রুত প্রতারক চক্রকে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ( এস, আই, মোঃ জিন্নাত খান) এর সাথে মুঠোফোনে যোগযোগ করলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, মামলা তদন্ত কালে অনেক গুরুত্বপূর্ন তথ্য পাওয়া গেছে যা, তদন্তের সার্থে এখন প্রকাশ সম্ভব না।