খাগড়াছড়ি : সদ্য এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ পাহাড়ি কন্যা থুইম্রাউ মারমা মাত্র উনিশেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন। ২০১৪ সালের ১৪ মে চিংসামং চৌধুরীর সঙ্গে বিয়ে হলো তার। স্বামী মানিকছড়ি কলেজিয়েট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক।
স্বামী আর সংসার নিয়ে মহা আনন্দে দিন কাটছিল তার। ছেলে মানুষী আচরণের জন্য মাঝে মাঝে স্বামী আর শাশুড়ির বকা শুনতে হতো তাকে। অবস্থাটি এমন যে, মাঝেমধ্যে ভুলেই যেত সে বিবাহিত। এখন সে চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পেটে তার অনাগত অতিথি। কয়েক মাস পরেই পৃথিবীতে আগমন ঘটবে যার। তাই ছেলে হলে কি নাম রাখবে, মেয়ে হলে কি নাম হতে পারে- এ নিয়ে স্বামীর সঙ্গে খুনসুটি লেগেই থাকত।
গত ৬ ডিসেম্বর দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন চিংসামং চৌধুরী। ভেঙে যায় থুইম্রাউর স্বপ্নসাধ। মনের ভেতর গড়ে তোলা স্বপ্নের তাজমহল ধুলায় লুটায়। ‘সন্তান হয়তো পৃথিবীতে আসবে কিন্তু বাবা ডাকবে কাকে?’ এই কথা বলতে বলতে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন সদ্য স্বামীহারা থুইম্রাউ মারমা।
কান্নায় কণ্ঠরোধ হয়ে আসা থুইম্রাউ বলেন, ‘চিংসামং চৌধুরী হত্যার ১২ দিন পেরিয়ে গেলেও কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। চরম নিরাপত্তাহীনতায় কাটছে তার সময়।’
থুইম্রাউ প্রশ্ন করেন, ‘আমার গর্ভে তার সন্তান। কি হবে এই সন্তানের? সহজ সরল এই মানুষটি কিছুই রেখে যায়নি। বিবাহিত জীবনের আট মাসের মধ্যে আমি তাকে আমাদের নিয়ে ভাবতে দেখেনি। তার হাতে গড়া মানিকছড়ি কলেজিয়েট হাইস্কুলটি নিয়েই ছিল তার স্বপ্ন।’
থুইম্রাউ বলেন, ‘ সম্পত্তি বলতে এই জীর্ণশীর্ণ ঘরটি ছাড়া তেমন কিছুই নেই। সে মারা যাওয়ার সময় ঘরে কোনো টাকাপয়সা ছিল না, তার সহকর্মীরা হাত খরচের জন্য আমার হাতে ২,০০০ টাকা এনে দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমাকে নিয়ে নাই ভাবলাম, কিন্তু আমার গর্ভের অনাগত সন্তান নিয়ে? কী অপরাধ ছিল আমার স্বামীর। যারা আমকে উনিশ বছরে বয়সে বিধবা করল, আমি তাদের বিচার চাই।’ তিনি দ্রুত দোষীদের গ্রেফতার দাবি করেন।
মানিকছড়ি উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও মানিকছড়ি তিনটহরী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আতাউল ইসলাম বলেন, ‘চিংসামং একজন সরলমনা মানুষ ছিলেন। তার মতো ভালো মানুষ মানিকছড়িতে দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া কষ্টের। তার হত্যার বিচারের দাবিতে মানিকছড়ি উপজেলার সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে।’ ‘যদি শিক্ষক হত্যার বিচার না হয় তাহলে আগামী বছরের প্রথম থেকে তারা বিদ্যালয়ে পাঠদান থেকে বিরত থাকবেন’ জানান তিনি।
উল্লেখ্য, গত ৬ ডিসেম্বর শনিবার সন্ধ্যায় মানিকছড়ি বাজারে একটি চায়ের দোকানের পাশের রুমে বসে চা পান করছিলেন স্থানীয় কলেজিয়েট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক চিংসামং চৌধুরী ও মানিকছড়ি উপজেলা জনসংহতি সমিতির সভাপতি মংসাজাই মারমা ওরফে জাপান। চা খাওয়া অবস্থায় হঠাৎ করে মুখোশ পরা সাত-আটজনের একদল দুর্বৃত্ত তাদের ওপর অতর্কিত গুলি চালায়। গুলিতে ঘটনাস্থলেই মারা যান চিংসামং চৌধুরী, আর গুলিবিদ্ধ মংসাজাই মারমা ওরফে জাপান মৃত্যুর সঙ্গে ১০ দিন লড়ে অবশেষ হেরে যান। মঙ্গলবার বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) মৃত্যুবরণ করেন।
ঘটনায় মামলা হলেও এখনো গ্রেফতার হয়নি কেউ। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে নিহত শিক্ষকের চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী থুইম্রাউ মারমাও। শিক্ষক হত্যার কারণে ফুঁসে উঠে পুরো জেলার মারমা সমাজ ও সুশীল সমাজের লোকজন। প্রতিবাদে টানা তিন দিন পালন করা হয় হরতাল অবরোধ। করা হয় বিক্ষোভ সমাবেশ। জড়িতদের গ্রেফতার ও শাস্তির দাবিতে চলছে নানা কর্মসূচি।
মানিকছড়ি থানার অফিসার অফিসার ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই মামলা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত চলছে। আসামি গ্রেফতারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে।’
রাইজিংবিডি