রাজধানীর চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের আগুন নিভে গেলেও হৃদয় বিদারক ঘটনার যেন সমাপ্তি হচ্ছে না। একের পর এক বেরিয়ে আসছে মর্মান্তিক ঘটনার গল্পগুলো।
মায়ের কোলে শিশুর মৃত্যু, দুই ভায়ের বুকে নিহত ৩ বছরের শিশু, গর্ভবতী স্ত্রীর সঙ্গে স্বামীর মৃত্যু। অগ্নিকাণ্ডে এমন অনেক ঘটনাই জানা গেছে।
এবার প্রকাশে এল আরও একটি মর্মান্তিক ঘটনা।
বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে ওই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।
ঠিক তার আধা ঘণ্টা আগে, রাত ১০টার দিকে চা খেয়ে, পানি নিয়ে বাবাকে বাড়ি ফিরতে বলেছিলেন দুই ছেলে। এ জন্য বাবাকে কিছু টাকাও দেন ছেলেরা। বাবাও ছেলেদের বলেন, ‘দোকান বন্ধ করে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে আসতে। ’
বাবা মো. শাহবুল্লাহ বাড়ি ফিরলেও দুই ছেলে মাসুদ রানা (৩৫) ও মাহবুর রহমান রাজু (২৮) আর বাড়ি ফেরেনি। কথাবার্তা শেষে রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা বাজারে ছেলেদের দোকান এস আর টেলিকম থেকে অল্প দূরে যেতেই বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় দুই ছেলের।
দুর্ঘটনা থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কে বি রুদ্র রোডের ১৮/২০ নম্বর বাসায় ফিরে আসা বাবা মো. শাহবুল্লাহর কান্না আর থামছে না। তার এই বাসায় ফেরার স্বাদ যেন মিটে গেছে।
তাই বারবার বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার ছেলেগো আমি দেশে নিয়া যামু, তাগো লগে আমি শুমু। তাগো লগে শুওনের লেইগা উপরে (সৃষ্টিকর্তার কাছে) অর্ডার দিমু। ’
বাসায় আসা আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন শাহবুল্লাহকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাও যেন হারিয়েছে। বাবা নিজেই ছেলে হারানোর গল্প বলে চলছিলেন সবাইকে। শাহবুল্লাহ বলেন, ‘দোকান থেকে বেরিয়ে অল্প একটু আসতেই শব্দ শুনেছি। আমি আর ওইদিকে যাইতে পারি নাই। পুরা রাস্তায় আগুন। আমার বাবারা আগুনে…। ’
প্রত্যক্ষদর্শী মো. শাহীদ মিয়া নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা ছাদ থেকে রানা আর রাজুকে দোকানের শাটার নামিয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকে যেতে দেখেছি। ওইখানেই তাদের মৃত্যু হয়। ’
মাসুদ রানার একমাত্র সন্তান বাবা হারা হয়েছে। গত ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠান করে বিয়ে করা রাজুর স্ত্রীর মুখেও কোনো কথা নেই। রাজু-রানার বাড়ি লোকে পূর্ণ, কিন্তু কান্নার সুর ছাড়া এখন আর সেখানে কিছু নেই। বাড়ির একপাশে রানা-রাজুর মা, তাদের স্ত্রী ও সন্তানের কান্না; অন্যপাশে বাবার আহাজারি।
অনবরত বিলাপ করে চলা মো. শাহবুল্লাহর কণ্ঠে যেন এই কথাগুলোই ঘুরে ফিরে আসছিল- ‘বাবা, আমার দুই ছেলে নাই। বাবা, বাবারে…। রানা, রানারে? রাজু, রাজুরে? বাবারে… (হাউমাউ করে কান্না)। বাবারে, আমার চন্দ্র-সূর্য হারাইয়া ফেলাইছি। আমার চন্দ্রও ডুবে গেছে, সূর্যও ডুবে গেছে (হাউ মাউ করে কান্না)। আমি অন্ধ হয়ে গেছি। আল্লাহরে আমি অন্ধ হইলাম ক্যারে?’
বিস্ফোরণের আগুনে কর্মজীবী দুই ছেলের মৃত্যুর পর পড়ুয়া ছোট ছেলে খলিলুর রহমান মিরাজই এখন পরিবারের একমাত্র সম্বল। কিন্তু তারাতো কেমিক্যাল বিক্রির সঙ্গে ছিলেন না। এই প্রশ্ন যেন বাবার মনেও বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল। তাই ক্ষণে ক্ষণেই বিলাপ করে উঠছিলেন, ‘আমার ছেলে তো কোনো কেমিক্যাল বিক্রি করে না। আল্লাহরে…। ’