মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেও পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশন ও সংলগ্ন এলাকা ছিল মানুষে ভরপুর। হই চই, অসংখ্য মানুষের আনাগোনা, মালামাল ওঠানো-নামানো, গাড়ি-রিকশার জটলা। সেই এলাকায় এখনো সবই আছে। তবে শুধু কঙ্কালসার চেহারা সবকিছুর। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে জনাকীর্ণ ওই এলাকা যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। সেই ওয়াহিদ ম্যানশনজুড়ে ক্ষতচিহ্ন। কোনো তলার দেয়াল ভাঙা, বেরিয়ে আছে শুধু কংক্রিটের পিলার। কোনো তলায় খসে পড়েছে সব প্লাস্টার, গ্রিল বাঁকাচোরা, ভেতরে যে কিছু ছিল সেটা বোঝার উপায় নেই।
যেন কোনো যুদ্ধের আলামত।
জীবন কুমার বাবু (৫০) ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার স্থান থেকে প্রায় ৫০ গজ দূরে ৮ নম্বর ভবনের নিচে একটি সেলুনের মালিক। প্রায় ৩০ বছর ধরে এ স্থানে সেলুন চালাচ্ছেন। সেই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। জানান, প্রতিদিনই সেলুন বন্ধ করতে রাত ১১টা থেকে ১২টা বেজে যায়। বুধবার রাত তখন আনুমানিক সোয়া ১০টা। সেলুনে কাজ করছিলেন। সরু রাস্তায় তখন প্রচণ্ড ভিড়। রিকশা, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন আটকে আছে। হঠাৎ বিকট শব্দে আঁতকে ওঠেন। মুহূর্তেই বাইরে বের হয়ে দেখেন চুড়িহাট্টা মসজিদের সামনে রাস্তায় দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।
রাস্তায় ছিটকে পড়ে আছেন অসংখ্য লোকজন। তারা ছটফট করছেন আর বাঁচার জন্য চিৎকার করছেন। একই সাথে রাস্তায় কয়েকটি গাড়ি উল্টে তাতে আগুন জ্বলছে। দ্রুত সেলুনের লোকজন বের করে দিয়ে সাটার বন্ধ করে নিরাপদে সরে যান। এরপর চিৎকার করে তিনি লোকজনকে জড়ো করার চেষ্টা করছিলেন। লোকজনের সহায়তায় ফায়ার সার্ভিসে ফোন করে আগুনের সংবাদ দেন। জীবন জানান, কয়েক মিনিটের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ভবন, রাস্তার পাশের হোটেল ও দোকানে। তিনি বলেন, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না, অন্যদের মতো তিনিও অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে আগুন প্রত্যক্ষ করছিলেন। এরই মধ্যে শুরু হয় ভয়াবহতা। শুধু বিস্ফোরণ আর বিস্ফোরণ। পিকআপে থাকা সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে প্রথমে আগুন ধরে। পরে আগুনের তাপে হোটেলের সিলিন্ডারটির বিস্ফোরণ ঘটে। একপর্যায় তা ছড়িয়ে পড়ে ওয়াহিদ ম্যানশনে। ওই ভবনে গোডাউনে রাখা স্প্রের বোতলগুলো বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে একের পর এক। মনে হচ্ছিল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। মানুষগুলো বাঁচার আকুতি করছিল। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের রক্ষা করা গেল না।
জীবন জানান, আগুন লাগার আধাঘণ্টা পরে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ছুটে আসে। রাস্তা সরু থাকায় তারা গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করতে পারছিলেন না। একপর্যায়ে বিভিন্ন উপায়ে তারা আগুন নেভানোর কাজ শুরু করেন। কিন্তু কোনোভাবেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না। শেষ রাতের দিকে আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। কিন্তু ততক্ষণে সবই শেষ হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা জাভেদ জানান, চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের উত্তর পাশে তাদের বাসা। হঠাৎ বিস্ফোরণে এলাকা কেঁপে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যে রাস্তায় বের হয়ে দেখেন, মসজিদের সামনের রাস্তায় কয়েকটি গাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন জলছে। মুহূর্তেই আরো কয়েকটি বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের ভবনে। তিনি জানান, এ অবস্থার মধ্যে তার এক বোন জামাই মোজাফফর তাকে ফোন করে কেঁদে ফেলেন। মোজাফফর একটি দোকানে আটকা পড়েছেন বলে জানান। তিনি ওয়াহিদ ম্যানশন ভবনের পাশের মার্কেটের একটি দোকানে চাকরি করেন। বহু চেষ্টার পর মোজাফফর আহত অবস্থায় দোকান থেকে বের হয়ে আসেন।
জাভেদ বলেন, আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিস ছুটে এলেও সরু রাস্তার কারণে কাজ করতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় তাদের। ৩৭টি ইউনিট সাড়ে চারঘণ্টার মতো কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।