জোরপূর্বক আমাকে মাইক্রোবাসে টানাটানি করে তুলার চেষ্টা করতেছে, ঘটনাটি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সামনে। আমি ভীতিতে চিল্লানোর শক্তি পাচ্ছি না। আম্মু আমাকে মুক্ত করতে আসলে তারা ঠ্যালা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয়। আম্মু রাস্তায় স্খলন হয়ে কেঁদে কেঁদে বলছে – আমার মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে দয়া করে আপনারা উদ্ধার করেন।
ঘটনাটি বাংলা ছবির শুটিং এর মত সবাই চেয়েচেয়ে দেখছে। কেউ আমাদের দিকে সহায়তা করতে আসছে না। জোরে জোরে বস্তার জিনিসের মতো টেনেহিঁচড়ে আমার শরীরের অর্ধেক অংশ মাইক্রোবাসের ভিতরে নিয়ে গেল। এমন সময় মেডিকেল কলেজের একঝাক স্টুডেন্ট ধর সালাদের বলে আমাদের সাহায্য করতে আসলো। তারা ভয়ে মাইক্রোবাসটি ছেড়ে দিল। মাইক্রোবাসটির চাকা আমার পায়ের কিছু অংশ চাপা দিয়ে থেঁতলিয়ে দিয়ে চলে গেল।
ভাগ্যের কী পরিহাস। হাসপাতালে হার্টের রোগী আমার আব্বুকে দেখতে এসে, আমিও পায়ের ফ্র্যাকচার নিয়ে এডমিট হলাম হাসপাতালে। দুই বছর পূর্বে হাসপাতলে আসছিলাম জ্বর নিয়ে। সে সময় কুকুর আমাকে কামড়াতে আসছিল, আমি আতঙ্কে কয়েকদিন জ্বরে পড়েছিলাম। সে থেকে আমি কুকুর প্রচুর ভয় পাই।
আম্মু সারাবেলা আমার আর আব্বুর ওয়ার্ডে ছোটাছুটি করে। পুরুষ ওয়ার্ডে রাতের বেলা মহিলা প্রবেশ নিষেধ, তাই সারা রাত আম্মু আমার কাছেই থাকে। আম্মু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো সবসময়। একদিন ঘুমের ঘোরে বুঝলাম আমার গালে টপটপ করে পানির ফুটা পড়ছে। আম্মু খুব নিরবে চোখের পানি ছেড়ে কাঁদছে। আমি নিজেকে সামলাতে পারলাম না। বেডে শুয়ে থেকেই আম্মুকে বুকে জড়িয়ে নিলাম। আম্মুকে বললাম, আমাকে ক্ষমা করে দাও আম্মু। জীবনে আর কখনোই এমন ভুল হবে না। তোমাদের অবাধ্য হবো না কখনো। আব্বুকে বলো আমাকে যেন মাফ করে দেয়। জীবনে আর কখনো তোমাদের কষ্ট দিব না আম্মু।
কথা গুলো বলে নিজেকে অনেক হালকা ও প্রশান্তি লাগছে। আম্মু নিজের অশ্রু লুকিয়ে, আমার অশ্রু মুছতে মুছতে বললঃ আগামীকাল তোর দুলাভাই আর বোন ঢাকা থেকে আসতেছে। কাল সবাই আমরা বাসায় চলে যাবো। একমাস পরে এসে তোর এই পায়ের প্লাস্টার খুলে নিয়ে যাব। তারপর তুই সুস্থ। আগের মত হয়ে যাবি।
মনে মনে বললাম, আমিতো আর কখনো আগের মতো হতে পারবো না…
মোবাইলের ঐ পাশে চুপ মেরে কানপেতে থাকা মনোযোগী শ্রোতা দ্বীপ বললঃ কেন অদ্রি, তুমি এই কথা বললে কেন? পায়ের ফ্র্যাকচার দু’এক মাসে রেস্ট নিলে ঠিক হয়ে যায়। পায়ের হাড় ফাটা এটা বড় কোন সমস্যা না।
– দ্বীপ সমস্যা শুধু পায়ে না, সমস্যা আমার জীবনের।
– কি বলো?
– মাইক্রোবাসে যে আমাকে কিডন্যাপ করতে আসছিল, সে আমার বয়ফ্রেন্ড ভৈরব। এক বছর আগের কথা, তখন আমি টেনে পড়ি। রং নাম্বারে তার সাথে আমার পরিচয়। প্রতিদিন নিয়ম করে মেপে মেপে তার সাথে আমার ৫-৬ মিনিট কথা হতো। মোবাইলে কথা বলতে বলতে তার প্রতি অনেকটা দুর্বল হয়ে যাই। টাঙ্গাইল থেকে বাইক চালিয়ে, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতী আসে। অনেকগুলো চকলেট নিয়ে এসে আমার সঙ্গে দেখা করে! অনেক মোটা বড় একটা মানুষ। প্রথম দেখে আমার একটুও ভালো লাগেনি। যখন কথা বলা শুরু করে, তখন মনে হয় মোবাইলে কথা বলা ওপারে পরিচিত মানুষটাই তো এ। কথা বলতে বলতে কখন জানি ভুলে যাই, এই মানুষটাকে আমার পছন্দ হয়নি। বাইকে উঠিয়ে আমাদের বাসার কাছাকাছি নামিয়ে চলে যায়। আমার খুব মায়া হলো, এতদুর থেকে আমার জন্য আসলো। বাসা নিয়ে কিছু খেতে দিতে পারলাম না। সেদিন রাতে তার সাথে সারারাত কথা বলছি।
আবার মোবাইলে নিয়ম করে মেপে মেপে কথা চলতে থাকে। আমি সারাদিন কখন কি করি, ভৈরব সব শুনতো। খাওয়া-দাওয়া পড়াশোনা নিয়ে খুব কেয়ার নিতো। আমার এসএসসি পরীক্ষা খুব কাছাকাছি। স্কুলে ক্লাস বন্ধ হয়ে গেছে। স্যারেরা বাধ্যতামূলক কোচিং এর টাকা নিয়েছে ফর্ম ফিলাপের টাকার সাথে। একদিন কোচিং এ যাচ্ছি। এমন সময় ভৈরব বাইক চালিয়ে হঠাৎ আমার সামনে। আমিতো অবাক! ভৈরব হেসে বলল, কি অবাক হলে? তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য আসছি। আজ আমার ছোট বোন ববির বার্থডে। তোমাকেতো কাল বলছি। বাসায় ববিকে বলে আসছি, তকে আজ সারপ্রাইজ দিব। তাই ববির হবু ভাবিকে আজ তাকে দেখাবো, চলো?
– কী বলছেন এসব, আমার কোচিং? তাছাড়া বাসায় আম্মু কে কি বলবো?
– আরে জান তোমাকে তো আমি বিকালে পৌঁছে দিয়ে যাবো। আর আমাদের বাসায় গিয়ে তোমার আম্মুকে ফোন দিবে, তুমি বলবা তোমার বান্ধবীর বার্থডে। তোমার ফিরতে বিকেল হবে, প্রয়োজনে ববি তোমার বান্ধবী সেজে কথা বলবে।
ভৈরব তার হেলমেট আমাকে পরিয়ে দিল। আমার পরিচিত এলাকায় সবার চোখে আমি অপরিচিত হয়ে গেলাম, আমার বাসার পাশ দিয়ে বাইক চলছে। ভৈরবকে দেখিয়ে দিলাম এটা তোমার হবু শশুর বাড়ি। টাঙ্গাইল বৈরফের বাসায় পৌঁছাতেই আমাদের বিকাল হয়ে গেল। চিন্তায় আমার কান্না আসতেছে। ভৈরবদের বাসায় সবার সামনে আমি কাঁদতেও পারছি না। সন্ধ্যা হয়ে গেল আমার বাসায় কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে দিল না, বুঝতে পারলাম এই বাড়িতে আজ কারো বার্থডে না। সন্ধ্যা হয়ে গেল- রাত হয়ে গেল, কেউ আমার হাতে মোবাইল দিল না। তাদের বাসায় সবাই আমাকে আদর করার চেষ্টা করতেছে, আমি ববির রুমে শুয়ে শুয়ে কাঁদতেছি।
রাত ১০টা ভৈরব এসে বললঃ তোমার আম্মুর সঙ্গে ফোনে কথা হয়েছে। বলছি তুমি আমাদের বাসায় কয়েক দিন থাকবে। আর শোনো, ভুলেও এ বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করো না। গেঁটেতো কুকুর দেখছো, গত বছর চোর দেয়াল টপকে বাড়ির ভিতরে ঢুকে গেছিল। কুকুর চোরটাকে কামড়িয়ে মেরে ফেলছে। আর অলটাইম গেট তালা দেয়াই থাকে এলাকার মানুষ সবাই আমার আর আব্বুর কথায় উঠে বসে, মাথায় অন্য কোন চিন্তা যেনো না আসে। জান আমাকে ভুল বুঝনা, তোমাকে পাওয়ার জন্য, আমাদের ভালোবাসা কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এসব করছি। কয়েকদিনের ভিতরে তোমার আব্বুর সঙ্গে কথা বলে বিয়ে ঠিক করে ফেলবো। গুড নাইট জান।
তার পর কি হলো অদ্রি?
– তার পর এক সপ্তাহ দুই সপ্তাহ করে এক মাস হয়ে গেল। আমার বাড়িতে কোন ভাবে যোগাযোগ করতে দিল না। তার আম্মু ছোট বোন আমাকে খুব আদর করত। ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করত সবকিছু। এক মাসে বুঝলাম তাদের অনেক ক্ষমতা, তার বাবা অনেক বড় নেতা। বাসায় ফোন দিব বলে একদিন মোবাইল খুজতেছিলাম খুব গোপনে। ভৈরবের জিন্স প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই, কয়েকটা বড়ি পেলাম। বুঝতে কষ্ট হলো না এগুলো ইয়াবা। এতদিন জানতাম লোকটা অনেক খারাপ, ক্ষমতার দাপটে যেকোন মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করতে পারে। আজ জানলাম সে নেশাখোরও।
যে দিন আমার এসএসসি পরীক্ষা সে দিন নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। খুবি কষ্ট লাগছে যে আমার সহপাঠীরা সবাই পরিক্ষা দিচ্ছে আর আমি দিতে পারছি না। আমি খুব অসম্ভব ভাবে কান্নাকাটি, চিল্লাচিল্লি, জিনিসপত্র ভাঙ্গচুর শুরু করলাম। তারা আমার আহাজারি থামাতে না পেরে বাসায় কথা বলতে দিলো।
আম্মুর কাছে জানতে পারলাম আব্বু আমাকে খুঁজে না পেয়ে স্টোক করছিলো। এ শুনে আমার কান্নাকাটি আরো বেড়ে গেলো।
আব্বু আমাকে নিতে আসলো, ঐ এলাকার কিছু গণ্যমান্য মানুষ নিয়ে বৈঠক বসলো। বৈঠকে আব্বু দাবি করলো আমার মেয়েকে কিডন্যাপ করে নিয়ে আসা হয়ছে। আমার কাছে জানতে চাইলে আমি বললাম না, আমি নিজের ইচ্ছায় এসেছি ।
অদ্রি তোমাকেতো মিথ্যা বলে নিয়ে আসছে, তাছাড়া এ বাড়িতে তোমাকে জোর করে আটকিয়ে রাখা হয়ছে। এটাতো কিডন্যাপ বলা যায়।
– দেখ দ্বীপ, আব্বু ওদের এলাকার যাদের কাছে বিচার আশা করছে তারা সবাই ভৈরবদের চামচা, এখানে ন্যায্য বিচার আশা করা বোকামি। আমি নিজের দোষ মাথাই নিয়ে এ বাসা থেকে চলে যেতে চাই। পরে সিদ্ধান্ত হলো আমার আঠারো বছর হলে ভৈরবের সাথে বিয়ে হবে।
আব্বু যখন দ্বিতীয়বারের মতো হার্টস্টোক করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি। তখন আব্বুকে দেখতে গেলে, মেডিকেল কলেজের সামনে থেকে আমাকে কিডন্যাপ করতে চেষ্টা করে, যে কথা প্রথমে বললাম। সে থেকে আজ পর্যন্ত নিজেকে লুকিয়ে রাখি। এর জন্য ফেসবুকে ছবি পোস্ট করি না এবং তোমাকে ছবি পাঠাই় না। ভৈরবের নামে মামলা করেছি, তা চলতেছে। দ্বীপ জীবনের অনেক কিছু তোমার সঙ্গে শেয়ার করলাম। তুমি অনেকদিনের ফেসবুকের বন্ধু। তুমি প্রেমের প্রপোজ করার জন্যই বিষয়গুলো জানাইলাম। এর মানে এই নয় তুমি আমাকে করুণা করবে। এর মানে এইও নয় যে তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমার জীবনে আমার পছন্দের ভালবাসাকে কখনো স্থায়ীত্ব দিব না।
– অদ্রি তুমি যে পরিস্থিতি পার করে আসছ। তোমার এরকম ভাবাটাই স্বাভাবিক। প্রেম না আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
– আপাতত বিয়ে প্রেম কোনটায় সম্ভব না। কারণ আমি পড়াশোনা করতে চাই। কিন্তু তা করার জন্য ভৈরবের চোখের আড়াল হতে হবে। তাই আমি ঢাকা আপুর বাসায় গিয়ে পড়াশোনা শুরু করব।
– অদ্রি তোমার এই সিদ্ধান্তকে আমি রেসপেক্ট করি। আসলে একদিক থেকে জীবনটা সাপলুডোর খেলার মত। একবার সাপে কাটলে জীবনটাকে থামিয়ে দেয়া যাবে না। তোমার ফেসবুক মেসেঞ্জারের নিকনেম আজ থেকে সাপলুডো দিব। তুমি থেমে যেও না, চলার পথে অনেক মই পাবে। তখন তোমার পিছিয়ে যাওয়াটা পূরণ করে নিতে পারবে। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?
– দ্বীপ তোমার এই প্রশ্নের উত্তর খুব কঠিন আমার জন্য। এক কথায় উত্তর দিয়া সম্ভব না। শুধু এ টুক বলবো, তোমার মত ছেলেকে জীবন সঙ্গি করার জন্য অনেক মেয়ে স্বপ্ন দেখবে। তেমনি ভাবে আমিও স্বপ্নবাজদের দলে এক স্বপ্নচারিনী। কিন্তু বাস্তবতা কে আমি বিশ্বাস করি। বাস্তবতাকে আমি শ্রদ্ধা করি। বাস্তবতার কাছে শিখে বলছি, এমন প্রশ্ন আর কখনো করবেনা দ্বীপ। আজ প্রথম দিনেই ফোনে তোমার সঙ্গে অনেক কথা হলো। এখন রাখি।
দ্বীপ কিছু বলার আগেই মোবাইলের লাইনটা কেটে গেল। ফেসবুকে ভার্চুয়াল লাইফে সাধারণ ভাবেই অপরিচিতদের বিশ্বাস কম থাকে। কিন্তু অদ্রি দ্বীপের প্রতি গভীর বিশ্বাস রেখে সবকিছু আপন মনে শেয়ার করল। এই বিশ্বাসটাই দ্বীপের ভালোবাসা আষ্টেপিষ্টে ধরে ভালোবাসা চিন্তার আরো উন্নয়ন ঘটানো।
মনে প্রানে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার আশা নিয়ে দ্বীপ সম্পর্ক চলমান রাখল। এদিকে অদ্রি দ্বীপের সাথে সারাক্ষণ ফেসবুকে চ্যাটিং, মোবাইলে ফোন আলাপ, কেয়ার নেয়া, শাসন করার সম্পর্কের নাম দিল বন্ধুত্ব। এই দুই রঙের সম্পর্ক চলল অনেক দিন। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দ্বীপ এর পোষ্টিং হয়ে গেল পার্বত্য চট্টগ্রাম। বন বিভাগে চাকরি বন জঙ্গলেই থাকতে হবে। এমন সান্তনা নিয়ে রংপুর থেকে চলে গেল দুর্গম পাহাড়ি এলাকা, রাঙ্গামাটি জেলার কাপ্তাইয়ের প্রত্যন্ত এলাকা । অদ্রি নতুন স্বপ্ন নিয়ে, নিজেকে নতুনভাবে বাঁচার প্রয়াসে, ঢাকা বোনের বাসায় চলে গেল পড়াশোনার উদ্দেশ্যে।
কাঠের ঘর কাঠের মেঝে, কাঠের জানালার ফাঁক দিয়ে তাকালে অপূর্ব দৃশ্য। ঠিক ছবির মত। পাহাড়ের গা কামড়ে ছোট ছোট ঝরনা আঁকাবাঁকা নদীতে জিরানো প্রয়াস করে। কিন্তু না, নদী ঝরনার জলরাশিকে ভয়ে নিয়ে যায় বড় নদীর দিকে। সত্যি সুগন্ধ- মোদিত অপরূপ লীলাভূমি এ পার্বত রাংঙামাটি। চোখ জুড়ানো অন্যরকম এক রহস্যময় রাজ্য।
ভ্রমণ পিপাসী মানুষ এখানে না আসলে তার মনের একটা বৃহৎ অংশ অপূর্ণতায় থেকে যাবে। কিন্তু এমন অপূর্ব দৃশ্য নন্দিত করতে পারে না দ্বীপের মন। দ্বীপের মন সব সময় ব্যাকুল হয়ে থাকে অদ্রির জন্য। এখানে মোবাইলের স্বাভাবিক নেটওয়ার্ক নেই। কথা বলতে হলে একটি পাহাড় পার হয়ে যেতে হয় উঁচু আরেকটি পাহাড়ে। সেখানেও পর্যাপ্ত নেটওয়ার্ক নেই। নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় নেট পাওয়া যায়। সেই জায়গা গুলো বাঁশের টুকরো গেঁড়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাঁশের চোঙ্গা উপর মোবাইল রেখে হেডফোনে কথা বলতে হয়। নেটওয়ার্কের লঙুর কারণে যখন তখন ফোন কেটে যায়। আবার আকাশ খারাপ থাকলে সেদিন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এত প্রতিকূলতার মাঝে অদ্রির সঙ্গে সপ্তাহে দুই তিনবার কথা হয় দ্বীপের।
ফেসবুকে পরিচয়ের একবছর পর আজ দুই জনের দেখা। অদ্রি কালো বোখরায় মুখ ছাড়া সম্পূর্ণ নিজেকে আচ্ছাদিত করে আসছে। মুখের ঝকঝকে তক দেখে মনে হচ্ছে মেঘের আড়াল থেকে ধবল শশী উঁকি দিচ্ছে। এক টেবিলে ৬ জন বসে কিছুক্ষণ লাচ্ছি খাওয়ার সাথে আড্ডা হলো। অদ্রির ৩ বান্ধবী আর দ্বীপের বন্ধু অমিত ভিন্ন ভিন্ন অজুহাতে রেস্টুরেন্ট ছেড়ে বিদায় নিলেন। গল্প করতে করতে দুজনের মাঝখানে ব্যবধান ক্রমেই কমে গেলো। দ্বীপ ইচ্ছা করেই অদ্রির কাঁধে হাত রাখলো। অদ্রি লজ্জায় ভারী হওয়া চোখ জোড়া টেনে টেনে দ্বীপের দিকে তাকানো। এহেন অবস্থায় দ্বীপ কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিচ্ছিলো, এমন সময় অদ্রি দ্বীপের আঙ্গুল টেনে ধরল! সম্মতিসূচক আচরণে দুজনের ভিতর পুলকিত তরঙ্গে স্ফুরিত হলো।
দ্বীপের ছুটি মানে অদ্রির সাথে ঢাকার অলিগলি চুষে বেড়ানো। সময় পরিক্রমায় তাদের সম্পর্কের বয়স আজ তিন বছর। অদ্রি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ সেকেন্ড ইয়ারে। ইতিমধ্যে দ্বীপ অদ্রি কে বিয়ে করার জন্য শুরু থেকেই অনেক প্রপোজ করছে। চলো আমরা গোপনে বিয়ে করে রাখি তোমার পড়াশোনা শেষ হলে তা সবাইকে জানাবো।
কিন্তু অদ্রি কথা, ফ্যামিলির বাইরে কোন কিছু করারতো আমার সম্ভব না, সে গ্রহণযোগ্যতা তো আমি অনেক আগেই হারিয়েছি , তা তো তুমি জানো। কিন্তু তোমাকে ছাড়া অন্য কাউকে জীবনসঙ্গী ভাবতেও পারিনা।
এদিকে দ্বীপের ফ্যামিলি দ্বীপের বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগলো। বিয়ে প্রেম জটিল তত্বে সিক্ত হয়ে, দ্বীপ তার মাকে ঢাকা নিয়ে আসলো অদ্রিকে দেখানোর জন্য।
দ্বীপের মা অদ্রি কে পছন্দ করলেন, কিন্তু অসন্তুষ্ট হলেন প্রশ্ন উত্তরে- দুজন দু’জনকে পছন্দ করো ঠিক আছে। আমরা কবে তোমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাবো? তোমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
অদ্রির উত্তর, বিয়ের প্রস্তাব এখন পাঠানো যাবে না আন্টি, কারণ বাসায় এ বিষয়ে কিছু জানায়নি, পড়াশোনা শেষ করার আগে জানানো যাবে না। আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিবিএ এমবিএ শেষ করে ঢাকা একটা জব করব। আর আপনাদের নিয়ে ঢাকায় থাকবো।
দ্বীপের বাবা রোষ কন্ঠে মেয়ের জামাই মিজান সাহেব কে বলছেন, একটা শিক্ষিত মেয়ে কিভাবে বলছে যে সে ঢাকা সেটেল হবে। আমাদের নিয়ে ঢাকা থাকবে। তারা কি করবে, কোথায় থাকবে এটা কি আমরা বুঝি না? আমরা সিলেটিরা এমনেই অন্য ডিস্টিকে সম্পর্ক করি না। একমাত্র ছেলেকে দূরে বিয়ে করানোর ইচ্ছা কখনো ছিলো না। ছেলের যেহেতু পছন্দ তাই অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মত দিয়ে ছিলাম।
দ্বীপ তার বাবার এমন কথা শুনে পাশের রুমে চলে গেল। মিজান সাহেব বললেন, দেখেন বাবা বিশ্বায়নের এ যুগে পথের দূরত্বটা কোন সমস্যা না। তাছাড়া দুই জন দুই জন কে ভালোবাসে। দ্বীপতো অন্য কারো সাথে সুখি নাও হতে পারে বাবা। দ্বীপ বলছে তাকে ছাড়া সে বাঁচবে না!
– তাকে জন্ম থেকে এ পর্যন্ত যা তার ভালো, যে ভাবে সে সুখী হবে, তাই করেছি। এখন সে কার সাথে সুখী হবে তা আমাদের চেয়ে কেউ ভালো জানেনা। আর সে যদি ঐ মেয়ে ছাড়া না বাঁচে, তাহলে ভিন্ন কথা। আমাদের একমাত্র ছেলে একটা মেয়ের জন্য মৃত্যু হোক তা অবশ্যই আমরা চাইব না। এমন হলে তুমি তার বন্ধুদের সাথে নিয়ে বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসো। আমরা হয়তো আনুষ্ঠানিক ভাবে বা মন থেকে সে মেয়ে কে মেনে নিতে পারব না, কিন্তু অমর্যাদা ও করবো না। তোমরা বিয়ে করিয়ে নিয়ে আসো। না হয় আমরা পাত্রী দেখব।
দ্বীপ কি করবে বুঝতে পারছে না। এতটুকু বুঝতে পারলো, এখনি যখন আব্বু মেনে নিচ্ছেন না। আর অদ্রির শৈশবের ভৈরবে সাথে ঘটনা শুনলে আরো জটিলতা বাড়বে। আমাদের প্রেমে, আব্বুর আধা স্বীকৃতি আছে। কারণ মিজান ভাই আর বন্ধুদের সাথে নিয়ে বিয়ে করতে বলছেন। এ সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। বাসার পরিস্থিতি সব অদ্রির সাথে ফোনে শেয়ার করলো। আর বলল , আমাদের বিয়ে খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। তানা হলে এ দিকে পাত্রী দেখা শুরু করবে। আমার ছুটি ২ দিন আগে শেষ হয়ছে। বেশি দিন ছুটি অনুপস্থিত থাকলে চাকরি সমস্যা হবে। তোমার ডিসিশন কালকের ভিতর দিবে।
একদিন গেল, দুই দিন গেল, এভাবে একসপ্তাহ চলে গেল। এদিকে দ্বীপের চাকরি চলে যাওয়ার উপক্রম। অদ্রি সুনির্দিষ্ট কোনো ডিসিশন নিতে পারছে না। দ্বীপ তার বন্ধু অমিত এবং বোন জামাই মিজান সাহেব কে রাজি করিয়ে বলে রাখছে, খুব তাড়াতাড়ি অদ্রিকে বিয়ে করবো, তোমরা দু’জন আমার সাথে থাকবে। দ্বীপের বাবা পাত্রীর বাবাকে কথা দিয়েছে, দ্বীপ পাত্রী দেখতে যাবে। দ্বীপ তার বাবাকে থামিয়ে রাখছে এ বলে- আমাকে কয়েকটা দিন সময় দেন। দ্বীপ অপেক্ষা করছে কখন অদ্রি ফোন করে বলবে, তুমি ঢাকা আসো আমরা বিয়ে করবো।
এমন সময় মিজান সাহেব অদ্রির সম্পর্কে অপ্রকাশিত বিষয় জেনে গেলেন। অদ্রির ছবি অফিস কলিগ কে দেখিয়ে বললেন, তোমাদের এলাকার এই মেয়ে কে চিনো? এই মেয়ের সঙ্গে আমার শেলকের বিয়ে দিতে চাচ্ছি। অফিস কলিগ চিনে ফেলেন, বললেনঃ এই মেয়েতো তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে অনেকদিন বাসা থেকে উধাও হয়ে গেছিল! এই বিষয়গুলো নিয়ে এখনো মামলা চলতেছে। মিজান সাহেবের কাছে সবকিছু শুনে দ্বীপ চালাকি করলো। দ্বীপ বললো বিষয়গুলো আসলে এমন না। আপনি এই বিষয়গুলো কাউকে বলবেন না প্লিজ। আমি বিস্তারিত আপনাকে জানাচ্ছি কিছুদিন পর।
মিজান সাহেব কে অনুরোধ করে এই বিষয়টিকে তালা দিয়ে রাখলেন। কারণ মিজান সাহেব এ বিষয় নিয়ে অদ্রি কে সরাসরি ফোন দিলে অদ্রি চরম লজ্জায় পড়বে। দ্বীপ চাইনা অদ্রি এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পরুক। মিজান সাহেব অদ্রির কাছে সব শুনলে সেও এই বিয়েতে ভেটো দেবে। তাছাড়া বাসার পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। আগামী পরশু শুক্রবার পাত্রী দেখার সময় ধার্য করা হলো। দ্বীপ এবার কঠিন ভাবে অদ্রি কে বললো, তোমার জন্য সময় আর একদিন এর ভিতর বলবা তুমি আমাকে বিয়ে করবে কি না?
অদ্রি মেসেজ দিলো “তোমার বাবা মা যা ভাল মনে করে তুমি তাই করো”
দ্বীপ জুম্মা নামাজ পড়ে বাসায় এসে দেখে সবাই সাজুগুজু করে আনন্দে সেলফি উটাচ্ছে এবং অমিত আরষ মিজান সাহেব তাদের বাসায়। দ্বীপ পরিস্থিতি বুঝেই বললো আমার আজ খুব খারাপ লাগতেছে। আমি আজ পাত্রী দেখতে যেতে পারবো না। বাসায় আনন্দ রম্য মুহূর্ত বিসাদে পরিণত হল। দ্বীপের বাবা এসে বলে গেলেন। গেটে মাইক্রো বাস দাঁড়িয়ে আছে, আমি বাজারে পান মিষ্টি কিনতে গেলাম। যাওয়ার সময় আমাকে ঐ খান থেকে নিয়ে যেও। সবাই তাড়াতাড়ি বের হও। আমরা যেনো দিনের আলোতেই পাত্রীর মুখ দেখতে পারি।
দ্বীপের চোখের পানি টপ টপ করে পড়ছে। যেন মেঘ ভেঙ্গে বরফের টুকরো মাটিতে পড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। দ্বীপের চোখের পানি মুছে দিয়ে, দ্বীপকে বুকে নিয়ে দ্বীপের মা চোখের পানি ছেড়ে দিল। আরে পাগল কাঁদছিস কেন? আমরা কি তোর ভালো চাইনা বোকা? তোর ভালো মন্দ কি আমরা বুঝি না…
মিজান সাহেব এসে বললেন, এখানে কান্নাকাটির কি আছে? পাত্রী দেখলে কি বিয়ে হয়ে যায়? বিয়ের আগে কত পাত্রী দেখে সবাই। তাড়াতাড়ি চলুন।
পাত্রী জয়াকে নাকফুল আর আংটি পরিয়ে দিলো দ্বীপের মা। জয়ার বাবা দ্বীপকে আংটি পরিয়ে দিলেন। খাওয়া-দাওয়া এঙ্গেজমেন্ট পর্ব শেষ। এবার বিদায় পর্ব। এতক্ষণ বিদায় এর জন্য অপেক্ষা করতেছিলো দ্বীপ। সে কল্পনাও করিনি পাত্রী দেখতে এসে এঙ্গেজমেন্ট হয়ে যাবে। তাকে একবার জিজ্ঞাসা করলো না। পাত্রী পছন্দ হয়েছে কিনা? বিদায় নিয়ে বাড়িতে গিয়ে এর কৈফিয়ত নেয়া হবে, বিয়ে তো দূরের কথা। জীবন আর এই বাড়িতে আসবো না। দ্বীপ রাগে-ক্ষোভে রুম থেকে বাহির হল। দ্বীপের বাবা বলল দ্বীপ কোথায় যাচ্ছে? পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য অমিত দ্বীপের পিছে পিছে বের হতে হতে বলল ওয়াশরুমে যাবে। অন্ধকারে দ্বীপ অনেকক্ষণ চুপ থেকে অমিত কে বলল দোস্ত এসব কি হচ্ছে আমি মনে হয় আর বাঁচবো না । অমিত দ্বীপের কাঁধে হাত রেখে বলল, দোস্ত সময় ও স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। তেমনি জীবন বয়ে চলে জীবনের গতিতে। তুমি যদি এখন ব্যর্থ মনোরথে জীবন থেকে দেবদাসের মতো নিজেকে সরিয়ে নিতে উদ্যত হও, তাহলে পৃথিবীর খুব একটা কিছু আসবে-যাবে না। কিন্তু ভেবে দেখো তোমার চারপাশের মানুষের কি হবে? কোথায় খুঁজবে সান্তনা আমরা? শুধু অদ্রি একমাত্র তোমার প্রিয় মানুষ না বরং তোমার মা-বাবা বোন এবং আমরা বন্ধুবান্ধব সবাই তোমার প্রিয় সো আমাদের বেদনার সাগরে ভাসানোর অধিকার তোমার নেই। বিয়ে তো যে ভাগ্য নির্ধারণ করে তার হাতে। অতএব ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে….
বিদায় মুহূর্তে পাত্রীর জেঠা দাঁড়ালেন। সবাইকে সালাম দিয়ে বললেনঃ এঙ্গেজমেন্ট পর্ব ভালোভাবে শেষ হয়ে গেছে। এর জন্য সবাই আমরা আলহামদুলিল্লাহ বলি। আলহামদুলিল্লাহ। যেহেতু এঙ্গেজমেন্ট হলো সে সুবাদে দ্বীপ আমাদের বাড়ির হবুজামাই। এখন দ্বীপ আমাদের বাসায় আসতে পারে, জয়ার সঙ্গে দেখা করতে পারে, হবুজামাই হিসেবে এই অধিকার সে রাখে। কিন্তু এই আসা যাওয়া নিয়ে সমাজে অনেক মানুষই সমালোচনা করতে পারে। এগুলো আমাদের দুই ফ্যামিলিতে, ফ্যামিলি স্ট্যাটাস নিয়ে সমস্যা হতে পারে। তাই আমি মুরুব্বী হিসেবে প্রস্তাব রাখছি। এক বছরের ভিতর যেহেতু বিয়ে হবে, তাই আজকে মুসলিম শরীয়ত মোতাবেক বিয়েটা পড়িয়ে রাখি। তাহলে তাদের যাওয়া আসাটা সুবিধা হবে। দেখা-সাক্ষাৎ শুদ্ধ হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে, ধুমধাম করে ভালো একটা দিন দেখে বছরখানেকের ভিতরে বিয়ের অনুষ্ঠান হবে। আমি শুধু এটা মুরুব্বী হিসেবে প্রস্তাব রাখলাম। আমার এই প্রস্তাব রাখার জন্য আমি অনুরোধ করবো না। আমার এই প্রস্তাব না মানলেও সমস্যা নেই। আমার দায়িত্ববোধ থেকে আমি বললাম আপনাদের। ভালো লাগলে প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে পারেন।
দ্বীপের বাবা দাঁড়িয়ে বললো- আলহামদুলিল্লাহ!
দ্বীপকে শশুর বাড়িতে রাখার জন্য সবাই জোড়ালো অনুরোধ করলো কিন্তু দ্বীপ থাকলো না। দ্বীপের বাসার সবাই সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বীপকে বলল। হঠাৎ যেভাবে বিয়ে হয়ে গেলো। এটা আত্মীয়-স্বজনকে বোঝানো সম্ভব নয়। তাই সবাইকে বলতে হবে এঙ্গেজমেন্ট হয়েছে। তানাহলে বিয়ের অনুষ্ঠানে অনেকেই রাগ করে আসবে না।
দ্বীপ এঙ্গেজমেন্টের ছবি মেসেঞ্জারে মাইডেতে পোস্ট করল। অদ্রি ছবি গুলো দেখে নিজেকে সামলাতে পারছে না কোন ভাবে। মনে হচ্ছে হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রভূত যন্ত্রণায় শিরা-উপশিরায় এবং হৃদপিন্ডের রক্তনালী কে জানি টেনে টেনে ছিঁড়ছে। খুব ইচ্ছা হচ্ছে চিল্লায় চিল্লায় কান্না করতে। কিন্তু বোনের বাসায় কান্নার স্বাধীনতা নেই কারণ মেয়েদের কান্নার স্বাধীনতা আছে বাপের বাড়িতে। ওয়াশরুমে গিয়ে পানি ছেড়ে দিল। সাথে চোখের অশ্রুধারা। মনে হচ্ছে বুক পুরোটাই খালি হয়ে গেছে। শুন্য বুকে কেমন জানি সাঁসা বিরহমই বাতাস চলতেছে।
অদ্রি দ্বীপকে ফোন দিয়ে বললো, জান তুমি কাল ঢাকা আসো। আমরা বিয়ে করবো, দ্বীপ বলল সরি, তুমি সিদ্ধান্ত নিতে অনেক দেরি করে ফেলেছ।
– কি বলছো তুমি এসব? আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো কেমনে? প্লিজ জান এমন করো না।
– দেখো সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। সে সময় শেষ হয়ে গেলে আর করার কিছুই থাকে না। আমারো তেমনি করার কিছু নেই।
– কেমন কঠিন ভাবে কথা বলছো কেন? আমাকে জান বলতেছনা কেন? প্লিজ জান বলে ডাক। আমি তোমার সাপলুডো। আমাকে সাপলুডো বলে ডাক দাও প্লিজ প্লিজ…..
সবাইকে একদিন এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু সব চলে যাওয়ায় কি এক রকম হয় কেউ কেউ স্বেচ্ছায় বিসর্জন দেন নিজেকে। একরাশ অভিমান নিয়ে চলে যায় ওপারে। দ্বীপ এমনই বিমুঢ়তা সিদ্ধান্তের আগ মুহূর্তে,
বিছানায় বসে ঘুমের বড়ি একটি একটি করে প্যাকেট থেকে খুলে, এক মুঠো বড়ি টেবিলে রাখল। বিছানার সাথে টেবিল আর টেবিলের পাশে জানালা। জানালার পাশে মসজিদ। শীতের ভিতর জানালা খুলে দিলো।
দ্বীপ ভাবছে এখনই কি সবগুলো বড়ি খেয়ে ফেলবো। না এখনই সব গুলো খাওয়া যাবে না। সবগুলো খেলে সুসাইড নোট লিখতে পারব না। তাই দুইটা বড়ি খেয়ে বিছানায় শুয়ে ফেসবুক ওয়ালে ঢুকলো। আচ্ছা কি দিয়ে শুরু করবো? সুইসাইড নোটের কি শিরোনাম হয়? না মাথায় আসতেছে না। উপরে শিরোনামের জায়গা রেখে লেখা শুরু করি।
প্রিয় জান অদ্রি। না এখন আর জান লেখা যাবে না জান শব্দটা মার্ক করে ডিলিট দিল। প্রিয় অদ্রি। না অদ্রির নামও দিয়া যাবে না, কারন আমার মৃত্যু জন্য সবাই তাকে দায় করবে। সে সবার চোখে তখন অপরাধী হবে। অদ্রি নামটাও এডিট করে লেখা শুরু করলো-
প্রিয় সাপলুডো,,
ভালোবাসা পবিত্র। এই পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্বটা আমি নিতে পারছি না। কারণ একজনকে ভালোবাসার দায়িত্ব এই সমাজ আমাকে দিয়েছে, আর মন দায়িত্ব নিয়ে বসে আছে তোমাকে ভালোবাসার। এই দুই ভালোবাসার দায়িত্ব একসাথে পালন করাটাও ভালোবাসার সহিত প্রতারণা। এমন প্রতারক হয়ে জেগে থেকে আমি একটুও স্বস্তি পাচ্ছি না। তাই আমি চিরতরে ঘুমিয়ে গেলাম। মনটা তোমাকে দিয়ে দেহ রেখে আমি জীবন নিয়ে চলে গেলাম। তোমরা আমাকে ক্ষমা করে দিও…
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সারাদেশে ভাইরাল হয়ে গেছে দ্বীপের সুইসাইড স্ট্যাটাস। গভীর থম-থম পরিবেশ, স্বজনদের বিচ্ছেদ ক্রন্দনে। লাশের গোসল চলছে। দ্বীপের মা গগন ভাঙ্গা কান্নার আহাজারি করে দিশেহারা। বাধ মানছে না অশ্রু। পরিবারের একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে কিছুতেই থামছে না মায়ের আহাজারি। বিলাপে বারবার চিৎকার করে মা অভিশাপ দিচ্ছে “আমার কলিজার টুকরা, নাড়িছেঁড়া ধন, যার জন্য মরছে তার বিচার কর খোদা, বিচার কর খোদা।”
দ্বীপের বাবা পাগলের মত বসে আছে। দ্বীপের মোবাইলে রিংটোন বাজছে। বারবার কল হচ্ছে, কলটা কেউ ধরছেনা। মৃত ব্যক্তি কল ধরার আগ্রহ কার একেবারে নাই। ফোনটা এবার রিসিভ করলেন মিজান সাহেব। ঐ পাশ থেকে অদ্রির কান্নাভেজা কণ্ঠে দ্বীপের কি হয়েছে? একই কথা বারবার বলে যাচ্ছে অদ্রি। মিজান সাহেব কোন উত্তর দিচ্ছে না। অদ্রি বলছে আমার দ্বীপ কে দাও। আমি দ্বীপের সাথে কথা বলবো। অদ্রির বুক ফাটা আর্তনাদ, পাগলের মত বিলাপ… মিজান সাব আর নিতে পারছে না। ফোনটা না কেটে দিয়েই মোবাইল রেখে দিল। বাড়তে থাকলো অদ্রির বিলাপ…
জয়া দ্বীপের বোনকে জড়িয়ে কান্নাকাটির করছে। যে বাসায় আনুষ্ঠানিকভাবে বেনারসি শাড়ি পড়ে আসার কথা ছিল, সে বাড়িতে আসতে হল মৃত স্বামীর সংবাদে অশ্রুতে সেজে।জয়ার নিজের প্রতি অজ্ঞাত ঘৃণা আর অপরাধবোধ কাজ করতেছে। বিয়ের কয়েকঘন্টা পর স্বামীর মৃত্যু। একটি মেয়ের এর চেয়ে আর মর্মপীড়া কি হতে পারে?
আজানের ধ্বনিতে প্রকম্পিত ভাবে দ্বীপের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ভাবলো, এ আমি কি স্বপ্ন দেখলাম। তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো এ ভেবে যে এটি দুঃস্বপ্ন ছিলো বাস্তব না। মোবাইলে দেখলো আত্মহত্যা করতে চেয়ে যে স্ট্যাটাস লেখতে লেখতে ঘুমিয়ে পড়েছিল তার সবুজ দার’টি লাফাচ্ছে। লেখাটি পোস্ট না করে ডিলিট করে অদ্রির টাইমলাইনে যেতে চাইলো। বুঝতে পারলো অদ্রি তাকে ব্লক করে দিচ্ছে। অন্য আইডি দিয়ে টাইমলাইনে প্রবেশ করে দেখল দুই ঘন্টা আগে অদ্রির স্ট্যাটাস-
“সম্পদ বলতে আমার কিছুই ছিলোনা। সম্পদ এর আশায় আমি আমার আত্তা পুঁজি রেখে একটি সম্পত্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই সম্পত্তির দলিলটা ছিলো জাল।”
দ্বীপ চোখে ঝাপসা দেখছে, চোখে ভিড় অশ্রু মিছিল। চোখ ঢলে ঢলে মুছল। মোবাইলটা তবু ঝাপসা দেখাচ্ছে। বুঝতে পারল মোবাইলের স্ক্রিন অশ্রুতে ভেজানো। আঙ্গুল দিয়ে স্কিন মুছতে গিয়ে মাত্র আসা একটি মেসেজ ওপেন হল। তাতে লেখা-
প্রিয় প্রীত,,
সু-প্রভাত! আপনাকে নিয়ে রাতে মিষ্টি স্বপ্ন দেখেছি। আমাদের বাসায় আসলে শেয়ার করবো।
কাল সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে চলে গেলেন। বিষয়টি অনেকে অপ্রত্যাশিত ভাবে নিয়েছে।
বিয়ে যেভাবে হটাৎ হয়েছে, এটা আমিও মেনে নিতে পারিনি কিন্তু আপনি আমার স্বামী এটাতো মন থেকে মেনে নিচ্ছি। আশা রাখি অতিশীঘ্রই শশুর বাড়ি এসে সবার অপেক্ষা সংক্ষিপ্ত করবেন। আজান হচ্ছে চলেন নামায পড়ব। ভালোবাসায় ভালো থাকার আরাধনা করি।।
– ইতি
আপনার পিচ্চি বউ
জামালুর থেকে
ওমর অক্ষর