ঢাকা: সোনালী ব্যাংকের অর্থ জালিয়াতির অভিযোগে দুদকের করা সব মামলা থেকে নিরীহ জাহালমকে অব্যাহতি দিয়ে আজই মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, ‘এক নির্দোষ লোককে এক মিনিটও কারাগারে রাখার পক্ষে আমরা না।’
আজ রোববার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন। একই সঙ্গে আদালত এই ভুল তদন্তের সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। না হলে আদালত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে বলে জানান।
সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেকের বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা হয়। এর মধ্যে ২৬টিতে জাহালমকে আসামি আবু সালেক চিহ্নিত করে অভিযোগপত্র দেয় দুদক। চিঠি পাওয়ার পর দুদক কার্যালয়ে হাজির হয়ে পাঁচ বছর আগে জাহালম বলেছিলেন, তিনি সালেক নন। বাংলায় লিখতে পারলেও ইংরেজিতে লিখতে জানেন না। কিন্তু নিরীহ পাটকলশ্রমিক জাহালমের কথা সেদিন দুদকের কেউ বিশ্বাস করেননি।
এরপর ২০১৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের এসব মামলায় জাহালম গ্রেপ্তার হন। তিনি জেল খাটছেন, আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন।
গত ৩০ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। শুনানি নিয়ে আদালত জাহালমের আটকাদেশ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারি করেন। একই সঙ্গে নিরীহ জাহালমের গ্রেপ্তারের ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি, মামলার বাদী দুদক কর্মকর্তা, স্বরাষ্ট্রসচিবের প্রতিনিধি ও আইনসচিবের প্রতিনিধিকে ৩ ফেব্রুয়ারি (আজ) সকাল ১০টায় সশরীরে আদালতে হাজির থাকার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।
এরই ধারাবাহিকতায় আজ দুদক চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হিসেবে দুদকের মহাপরিচালক (তদন্ত) , মামলার বাদী আব্দুল্লাহ আল জাহিদ, স্বরাষ্ট্রসচিবের (সুরক্ষা) প্রতিনিধি যুগ্ম সচিব সৈয়দ বেলাল হোসেন এবং আইন সচিবের প্রতিনিধি সৈয়দ মুশফিকুল ইসলাম আদালতে হাজির হন।
শুনানির শুরুতে দুদক চেয়ারম্যানের পক্ষে আদালতে বক্তব্য দেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি আদালতকে জানান, জাহালমের বিরুদ্ধে ২৬টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরে এসব মামলায় বিচারিক আদালতে বিচার শুরু হয়। তবে গত বছর দুদকের নজরে আসে জাহালম প্রকৃত আসামি আবু সালেক নন। মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকেও বিষয়টি জানানো হয়। তখন দুদকের অধিকতর তদন্ত ওঠে আসে জাহালম নির্দোষ। আসল আবু সালেকের ঠিকানা খোঁজে বের করা হয়। তখন দুদকের পক্ষ থেকে জাহালমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের জন্য বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়।
এ সময় আদালত দুদকের আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘দুদকের ফলস ইনভেস্টিগেশনের সুযোগ কোথায়, দুদক যদি প্রোপারলি কাজ করে তাহলে এ দেশে যে উন্নয়ন হচ্ছে তা স্থায়ী রূপ নেবে। আদালত আরও বলেন, ‘এখানে একটি সিন্ডিকেট আছে। এখানে কোনো জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়েছে কি না, এই জাহালমকে মিথ্যাভাবে মামলায় অভিযুক্ত করার পেছনে দায়ী কে ? আপনার অফিসের কেউ আছে কিনা, আমরা দেখতে চাই দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। ’
শুনানির পুরোটা সময় জুড়ে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আদালতকে বলতে থাকেন, জাহালমের বিষয়টি যখনই আমাদের নজরে এসেছে তখনই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়েছে। আদালত এই আইনজীবীর উদ্দেশে বলেন, ‘একটা নির্দোষ লোক যখন আপনার বুঝতে পারলেন, তখন আপনারা কী করেছেন? একদিনের জন্যও আপনারা তাঁকে রাখতে পারেন না। কেন আপনারা তাঁর মুক্তির ব্যবস্থা করলেন না?’ তখন দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, দুদকের অধিকতর তদন্তে জাহালমের নির্দোষ বিষয়টি জানার পরই দুদকের পিপিরা জাহালমের জামিনে কোনো আপত্তি করেননি। ইতিমধ্যে চারটি মামলা থেকে জাহালমের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয়েছে।
আদালত তখন জানতে চান, এই মামলায় যে তদন্তকারীরা জাহালমের নামে ভুলভাবে অভিযোগপত্র দিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধ দুদক কী ব্যবস্থা নিয়েছে? জবাবে দুদকের আইনজীবী বলেন, জাহালমকে সব মামলা থেকে অব্যাহতি দিলে দুদকের কোনো আপত্তি থাকবে না।
আদালত বলেন, ‘জাহালমের কারাগারের মেয়াদ একদিন বাড়বে, তো আপনার (দুদক) ওপর কপপেনসেশন বাড়বে। কপপেনসেশন করতে হবে। দুদক করেন বা ব্যাংক করেন।’
আদালত এই আইনজীবীর উদ্দেশে একাধিকবার বলেছেন, ‘দুদক একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। সুস্থ তদন্ত হলে জাহালমের বিষয়টি এ পর্যায়ে আসত না। দুদকের ফলস ইনভেস্টিগেশনের কোনো সুযোগ নেই। দুদককে অবশ্যই স্বচ্ছ হতে হবে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের অভ্যন্তরীণভাবে চিহ্নিত করেন। তাহলে আমাদের ইন্টারফেয়ার করার সুযোগ থাকবে না। যদি না হয় তাহলে কিন্তু আমরা করব।
শুনানির শেষ পর্যায়ে আদালতে উপস্থিত এক উপ-কারামহাপরিদর্শকে আদালত বলেন,‘ আপনারা আজই জাহালমকে রিলিজ করে দেবেন। দুদক এর খরচ দেবে।’