অর্থনীতির দর্শনের দারিদ্র্য

বাধ ভাঙ্গা মত

pic-10_163860এই সেপ্টেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। এতে সম্মেলন বক্তা ছিলেন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাত। প্রায় ৬০ পৃষ্ঠার একটি বক্তৃতার এক হাজার মুদ্রিত কপি তিনি নিয়ে এসেছিলেন। বক্তৃতার শিরোনাম- ‘অর্থনীতি শাস্ত্রের বিকাশ ও নব্য উদারবাদী মতবাদ : দর্শনের দারিদ্র্য প্রসঙ্গে।’

সম্মেলন বিষয়ে বলার তেমন কিছু নেই। অন্যান্য সম্মেলন যেমন হয়ে থাকে, এটিও তেমনি। তবে আমার মতে, উল্লেখ করার মতো ঘটনা অধ্যাপক বারকাতের উপস্থাপিত অসাধারণ প্রবন্ধটি। প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইত্যাদি না বলে এই ৬০ পৃষ্ঠার রচনাটিকে আমি একটি পুস্তিকা- তাই বা কেন, একটি পুরোদস্তুর পুস্তক বলতেও দ্বিধা করব না। পুস্তক হতে গেলেই তাকে ঢাউস হতে হবে- এমন তো নয়।

দর্শনের দারিদ্র্য সম্পর্কে কার্ল মার্ক্স প্রথম জীবনে একটি বই লিখেছিলেন। এ বিষয়টিকেই তিনি অর্থনীতির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে জানিয়েছেন দর্শনচিন্তা কত পুরনো বলা কঠিন- হয়তো মনুষ্যচিন্তার ঊষালগ্ন থেকেই এই দিক থেকে দর্শনশাস্ত্র অনেক পুরনো। অন্যদিকে প্রথাসিদ্ধ অর্থনীতিশাস্ত্র অর্বাচীন, পাঁচ-ছয় শ বছর হয় কি না সন্দেহ। আলোচনাটির সূত্রপাত এভাবে করে তিনি ধ্রুপদী অর্থনীতি শাস্ত্রের মূল ধারণাগুলোর প্রকৃতি, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে বিশ্লেষণে প্রবেশ করেছেন। বিজ্ঞান ও দর্শনের মতো মৌলিক, ধ্রুব ও চিরন্তন অর্থশাস্ত্রে খুব একটা নেই। সত্য আবিষ্কার, আর সেই সত্য ঘোষণা করতে পারে বিজ্ঞান ও দর্শন এবং তাই উচ্চারণ করতে গিয়ে ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে, সক্রেটিসকে হেমলক বিষ খেয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে; দর্শনের বিরুদ্ধে আর একটি অপরাধ যেন না ঘটতে পারে, যেমন ঘটেছিল সক্রেটিসের বেলায়- এই কথা বলে অ্যারিস্টটল এথেন্স ত্যাগ করেছিলেন। এ কারণে আবুল বারকাত মনে করেন দর্শন শুধু প্রাচীন নয়, তা অমোঘ সত্য উচ্চারণ করে জীবন ও সমাজ সম্পর্কে। অর্থনীতি অত পুরনো নয়, তার উৎপত্তি হয়েছে সমাজ পরিবর্তনের একটি বিশেষ ধাপে, সেই পরিবর্তন সামনে রেখেই এবং সেই পরিবর্তিত সমাজের উপযোগী করে তোলার বিশেষ লক্ষ্য সামনে রেখে চিরকালের চিরপরিবর্তনশীল মানবসমাজের সর্বকালের উপযোগী শাস্ত্র হিসেবে নয়, সর্বমানবের ঐহিক ও কল্যাণের জন্য নয়, সমাজপরিবর্তনের একটি নির্দিষ্ট কালে সেই সময়ের সুবিধাভোগী শোষণকারী মালিক শ্রেণির সুবিধার জন্য। সর্বকালের অর্থশাস্ত্র সেটা নয়, সমগ্র রাষ্ট্র ও সমাজের কল্যাণের জন্যও নয়। এই সর্বজনীনতা না থাকার জন্য ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্র শুরুই হয়েছে শ পাঁচেক বছর আগে বাণিজ্য ও বাজারের সর্বাত্মক উদ্ভবের কালে এবং তারই রকমফের হিসেবে নানা রূপে আজকের এই এক মেরুর পৃথিবীতে চালু আছে। বারকাতের মতে, সর্ব মানবসমাজের কল্যাণ লক্ষ্য না হওয়ায় এবং একটি বিশেষ সমাজব্যবস্থায় মালিক ও শোষক শ্রেণির সেবকে পরিণত হয়ে গিয়েছে, সে কারণেই অর্থনীতিশাস্ত্র দর্শনের দারিদ্র্যে ভুগছে। সর্বকালের সর্ব মানবসমাজের কল্যাণ সাধনের কোনো রকম লক্ষ্য না থাকার জন্য এই শাস্ত্র পক্ষপাতদুষ্ট, অগ্রহণীয় এবং এটিই হচ্ছে তার ভেতরের দর্শনের দারিদ্র্য।

এই দারিদ্র্যের জন্যই বাণিজ্য ও বাজার সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত অর্থশাস্ত্র গড়ে ওঠেনি। মানুষের সমাজকে যে মোটা দাগে চারভাগে ভাগ করা হয়- আদিম সাম্যবাদী সমাজ (এই সমাজের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। সবল আদিম মানুষ দুর্বল আদিম মানুষের খাবার কেড়ে খেত কি না এবং সবল পুরুষদের নারী দখলের মতো ঘটত কি না তার উত্তর নেই), তবে মানবসমাজ বিবর্তনের ইতিহাস তৈরি করতে গেলেই ওই রকম আদিম সাম্যবাদী সমাজের কথা ভাবতেই হয়। তার পরের সমাজব্যবস্থাগুলো ঐতিহাসিক। দাস সমাজ, সামন্তবাদী সমাজ, পুঁজিবাদী সমাজ ও ভবিষ্যৎ সাম্যবাদী সমাজ। সমাজতান্ত্রিক সমাজ নামে সাম্যবাদী সমাজের প্রাথমিক ধাপ সমাজতান্ত্রিক সমাজের কথা সবাই জানি। এখন তার পতন ঘটেছে- পৃথিবী হয়ে গেছে একমেরুর, রাজত্ব করছে পুঁজিবাদী সমাজ, যা এখন সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদে পরিণত হয়েছে।

অর্থনীতি শাস্ত্রের উদ্ভব প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে আবুল বারকাত স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই শাস্ত্র মোটেই মৌলিক নয়। আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাস সমাজ, সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ইত্যাদির জন্য অর্থশাস্ত্রের প্রয়োজনই হয়নি- শোষণ, নির্যাতন, মানুষের ওপর পশুর স্থান নির্ধারণ করা সবই হয়েছে সরাসরি। কোনো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়নি। বাণিজ্য ও বাজারের সৃষ্টি হওয়ার পর সরাসরি শোষণ চক্ষুর অগোচরে রাখা, দেশের মধ্যে সীমিত বাণিজ্য, অবাধ বাণিজ্য চালু করা না-করা ইত্যাদি সমস্যা ঘিরে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে উপযোগবাদ, পজিটিভিজম, বাণিজ্যিক অর্থশাস্ত্র রচিত হওয়ার সূচনা হয়। সমাজ সেই পর্যায় থেকে শিল্পবিপ্লবের পর নতুন সমাজব্যবস্থার উপযোগী ধ্রুপদী অর্থশাস্ত্রের উদ্ভব ঘটে। এর সত্যিকারের বিকাশ হতে থাকে পণ্য ও বাজার সৃষ্টির পর। মুনাফা এবং বাজারই অর্থনীতির মূল আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়। বাজারের অদৃশ্য হাত ক্রমাগত লম্বা হতে থাকে। উৎপাদনের নতুন নতুন উপায় আবিষ্কৃত হতে থাকে। এসব উপায়ই স্থির করে দেয় উৎপাদনের ধরন কী হবে, আর তাকে উৎপাদিকা শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কই কী হবে।

খুবই প্রাঞ্জল ভাষায় পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল প্রত্যয়গুলো- বাণিজ্য, বাজার, উৎপাদনের উপায়গুলোর অধিকার, সামান্য মূল্যে শ্রম ক্রয়, মুনাফার নামে শ্রম চুরি, পণ্য, পণ্য সৃষ্টি, পণ্যে নিযুক্ত শ্রম, পণ্য ও শ্রম, শ্রমের মূল্য, পণ্যের মূল্য বিচার, শোষণমূলক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এবং আজকের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদের উলঙ্গ চেহারাটি বর্ণনা করেছেন অধ্যাপক বারকাত। এই ব্যবস্থাটির দেখভাল করা, এর মধ্যে ক্রমান্বয়ে উদ্ভূত সমস্যাগুলোর সমাধান সন্ধান করা এবং এই পুঁজিবাদকে বৈশ্বিক, অদৃশ্য সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদে উত্তরিত করা- এ সবই হচ্ছে ধ্রুপদী বর্তমান হাল। এ ব্যবস্থাটিকেই অধ্যাপক বারকাত অর্থনীতিতে দর্শনের দারিদ্র্য বলেছেন। দর্শন সর্বজনীন, পুঁজিবাদের সেবাদাসত্ব কখনোই দর্শনের লক্ষ্য হতে পারে না।

অধ্যাপক বারকাতের মতে, এই দারিদ্র্য দূর করতে সক্ষম কার্ল মার্ক্সের তত্ত্ব দর্শন। কার্ল মার্ক্স অনেকটা তরুণ বয়সেই লিখেছিলেন ‘দর্শনের দারিদ্র্য’ (Poverty of Philosophy) নামে একটি নাতিদীর্ঘ গ্রন্থ। এই বইয়ের বক্তব্য থেকেই বারকাত অর্থনীতিতে দর্শনের দারিদ্র্য প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট মত দিতে উৎসাহিত হয়েছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কার্ল মার্ক্সের অর্থশাস্ত্র আলোচনায় ব্যাপৃত হয়েছেন। এখন বোঝা যায় অর্থনীতিতে দর্শনের দারিদ্র্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করার মূল উদ্দেশ্য হলো কার্ল মার্ক্সের সমাজব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, শ্রম মজুরি মুনাফা, তিন খণ্ডে লিখিত ‘পুঁজি’ ইত্যাদি মার্ক্সের সব রচনা পাঠ, অনুধাবন ও গ্রহণ করে মার্ক্সের অর্থশাস্ত্র সংক্ষেপে হাজির করা, চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যে মার্ক্সের অর্থতত্ত্বে দর্শনের দারিদ্র্য নেই বরং এই তত্ত্বেই সর্বজনীনতা, মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক স্বাধীনতার অবাধ বিকাশ ও প্রকাশের নিশ্চয়তা রয়েছে। মার্ক্সের হাতেই অর্থনীতি শাস্ত্রের দর্শনের দারিদ্র্য ঘুচেছে। মানবসমাজের সমগ্রতা নিয়ে বিপ্লবমুখী, কর্মমুখী, সর্বসমাজের মুক্তিকামী অর্থশাস্ত্র গড়ে উঠেছে। আবুল বারকাত মার্ক্সের এই তত্ত্বকেই ধ্রুব বলে গ্রহণ করেছেন এবং একেই আজ একমাত্র কর্মে অনুশীলনের যোগ্য বলে জানিয়েছেন। বারকাত মনে করেন, ধ্রুপদী অর্থনীতি আজ বদলাতে বদলাতে মানুষকে পণ্যনির্ভর করে সর্বনাশের পথে পা দিয়েছে, নব্য উদারবাদী অর্থনৈতিক তত্ত্ব দিয়ে সমগ্র পৃথিবীকে গুটিকয়েক পুঁজিভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী দেশের শেকলে বেঁধে ফেলতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। পুঁজিবাদী দেশগুলোতে সংরক্ষণশীল অর্থতত্ত্ব বজায় রাখবে অথচ তাদের বাজার দেশগুলোকে নব্য উদারবাদী নীতি গ্রহণে ভজাচ্ছে। তার মানে সাপ হয়ে দংশন করে ওঝা হয়ে ঝাড়ছে। সে জন্য এর জায়গায় দর্শনের দারিদ্র্যমুক্ত কল্যাণমুখী মার্ক্সীয় অর্থতত্ত্ব মেনে না নিয়ে আমাদের উপায় নেই।

অধ্যাপক বারকাতের উপসংহার হচ্ছে মার্ক্সীয় কল্যাণ অর্থতত্ত্ব গ্রহণ না করে উপায় নেই। কারণ এরই অনুসরণ করে একদিন এক কল্যাণমুখী পৃথিবী দেখা দেবে। ‘এটি সময়ের ব্যাপার।’ কিভাবে? অধ্যাপক বারকাতের জবাব হচ্ছে, এই লক্ষ্যেই আমাদের অনুশীলন করতে হবে, উৎসাহের সঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। অতি স্পষ্ট জবাব। বিপ্লবের কোনো কথা নেই- তা এতই অসম্ভব ও দূরস্থিত যে অতি বাম মার্ক্সবাদীও এর উচ্চারণ করেন না। আমি দেখেছি এখানে পৌঁছেই থমকে দাঁড়ায় সবাই। কেউ স্তোক বা সান্ত্বনা দেয়, কেউ আবার একটা বড় লণ্ঠন জ্বালিয়ে তুলে ধরেন। তাতে অল্পই জ্বালানি থাকে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক

-কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *