তাবলিগ জামাতের দুই পক্ষের সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা দুই গ্রুপের কারো সাথেই সম্পর্ক রাখবে না বলে আবারো ঘোষণা দিয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার উপমহাদেশে কওমি আলেমদের প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দের মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানি স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ ঘোষণা দেয়া হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে মাদরাসায় তাবলিগের দুই গ্রুপেরই কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠানের বিষয়টি আরো অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। যদিও বিশ্ব ইজতেমার বিষয়ে মতামত জানতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো: আবদুল্লাহর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল আগামী ২৪ অথবা ২৫ জানুয়ারি দেওবন্দ যাচ্ছেন। প্রতিনিধিদলে তাবলিগের দুই গ্রুপের প্রতিনিধি থাকছেন।
দেওবন্দে দ্বিতীয় দফায় তাবলিগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতসংশ্লিষ্টরা। তাবলিগের একাংশের মিডিয়া সমন্বয়কারী মুফতি জহির ইবনে মুসলিম এ বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, আগে থেকেই দেওবন্দে তাবলিগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ আছে। বৃহস্পতিবার ফের যে নোটিশ দেয়া হয়েছে সেটাও সঠিক। তিনি জানান, বিশ্ব ইজতেমার বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে যে প্রতিনিধিদল যাওয়ার বিষয়টি এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। পরিবর্তিত সময়ানুযায়ী ২২ জানুয়ারি প্রতিনিধিদলের দেওবন্দ যাওয়ার কথা রয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে প্রথমবারের মতো দেওবন্দে তাবলিগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা আনোয়ার হোসাইনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাবলিগের দুই পক্ষের সংঘাতের পরিপ্রেক্ষিতে ইজতেমার ব্যাপারে দেওবন্দের অবস্থান জানাটা সরকারের জন্য জরুরি। এ জন্যই ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর নেতৃত্ব প্রতিনিধিদল সেখানে যাবে। দেওবন্দে তাবলিগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও মন্ত্রণালয় অবহিত হয়েছে বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, তাবলিগের জন্য বিশ্ব ইজতেমার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সরকারও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অন্য একটি সূত্র জানিয়েছে, আগামী ২৪ অথবা ২৫ জানুয়ারি ১০ থেকে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভারতের দেওবন্দ সফর করবে। ইতোমধ্যে প্রতিনিধিদলের সব সদস্যের ভিসাসহ ভারত গমনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে সমন্বয় করে এখন প্রতিনিধিদল সেখানে যাবে। সূত্র জানায়, দেওবন্দ থেকে ইজতেমার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত না পেলে এ বছর ইজতেমার আয়োজন করার বিষয়টি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকেই সিদ্ধান্ত হবে। তবে সরকার কোনো পক্ষেই অবস্থান নেবে না।
বাংলাদেশে প্রতিনিধিদল দেওবন্দের মতামতের জন্য গেলেও মূলত তাবলিগের নেতৃত্বের বিষয়ে ফয়সালা হওয়ার আগে দেওবন্দ সংঘাতময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করার সম্ভাবনাই বেশি বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
পয়লা ডিসেম্বর ২০১৮ বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে টঙ্গীতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। ঘটনায় একজন নিহত ও বহু আহত হন। এরপর সরকার উভয়পক্ষের মধ্যে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়। উভয় গ্রুপই আলাদাভাবে ইজতেমা করার ব্যাপারে অটল থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকেই দেওবন্দের মতামত নেয়ার জন্য প্রতিনিধিদল সেখানে যাচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার দেওবন্দের গেটে উর্দু ভাষায় টাঙানো বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘দ্বীনের প্রচার, ইসলামের দাওয়াত আমাদের দায়িত্ব। কিন্তু তাবলিগের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে সৃষ্ট ফিতনা থেকে দারুল উলুমকে রক্ষার জন্য দারুল উলুমের দায়িত্বশীলরা প্রথম থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দারুল উলুমের প্রতিটি ছাত্র উভয়দল (সাদ- শূরা) থেকে সম্পর্কহীন থাকবে। এ জন্য ছাত্ররা দারুল উলুমের অভ্যন্তরে বহিরাগত বা ভেতরগত কোনো তাবলিগি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করবে না।’ দারুল উলুমের ভেতরে মাদরাসা ছাত্র বা বহিরাগত কারোই তাবলিগি কাজ করা যাবে না ঘোষণা দিয়ে এ নির্দেশ অমান্য করলে ছাত্রদের কঠোর শাস্তির হুঁশিয়ারিও দেয়া হয় নোটিশে।
প্রসঙ্গত, তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অংশীদারিত্বের বিষয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বি। তাবলিগের বর্তমান আমির মাওলানা সাদ কান্ধলভির নেতৃত্বের বিরোধিতা করে কয়েকজন মুরব্বি নিজামুদ্দীন মারকাজ ত্যাগ করলে বিভক্তি স্পষ্ট হয়। এরপর সেই সাথে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে বিভক্তি। বাংলাদেশে তাবলিগের প্রধানকেন্দ্র কাকরাইল মসজিদের দায়িত্বশীলদের মধ্যেও মতানৈক্য ছড়িয়ে পড়ে। দখল পাল্টা দখল, সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে কয়েকবার।
এরই মধ্যে ২০১৮ সালে চরম উত্তেজনার মধেই বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হলেও বিরোধীদের বিরোধিতার মুখে মাওলানা সাদ বিশ্ব ইজতেমায় অংশ নিতে পারেননি।
২০১৯ সালের বিশ্ব ইজতেমাকে কেন্দ্র করে গত পয়লা ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর এখন এবারের ইজতেমা অনুষ্ঠানই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। সাদ বিরোধী অংশ আগের ধারাবাহিকতায় ১৮-২০ জানুয়ারি ইজতেমা করতে চেয়েছিল। এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই সরকারের উদ্যোগে দেওবন্দ প্রতিনিধিদল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়।
গত ১৪ জানুয়ারি ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নামও ঘোষণা করা হয়। প্রতিনিধিদলে যাদের নাম রয়েছে তারা হলেন : ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো: আবদুল্লা , ধর্মসচিব মো: আনিছুর রহমান, অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো: মনিরুজ্জামান, যাত্রাবাড়ী মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদুল হাসান, শোলাকিয়া ঈদগাহের ইমাম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, তাবলিগ জামাতের আহলে শূরা মাওলানা রবিউল হক ও সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম, কাকরাইল মসজিদের মুকিম মাওলানা আশরাফ আলী, মোহাম্মদপুর জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহফুজুল হক ও ইকরা মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা সাদরুদ্দন মাকনুন। প্রতিনিধিদলে স্বরাষ্ট্র ও ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আরো দুয়েকজন যুক্ত হতে পারেন বলে জানা গেছে।