হাসানুজ্জামান হাসান,লালমনিরহাট: তালেব আলী নামের এক বাবা আজ থেকে ৩৬বছর আগে উধাও হয়েছিলেন পরিবার-পরিজন রেখে। তিনি বাবার পরিচয়টা সাথে নিয়ে উধাও হয়েছেন সন্তানদের পরিচয় সংকটে ফেলে।
কেন উধাও হয়েছিলেন তিনি তার কোন সদুত্তর দিতে পারছেন না নিজেও। তবে তিনি ফিরে পেয়েছেন তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের;তাই চোখে-মুখে আলোর ঝলকানি।
খুশিতে গদগদ ছেলেদের চোখে-মুখেও আলোর ঝলকানি। তাদের একজন বাবা ছিলেন,এতদিন এই কথাটি শুধু শুনেই এসেছিলেন,।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় কদাচিৎ আন্দোলিতও হয়েছিলেন ছেলেরা। তখন এমনি এক বিব্রতকর অবস্থার সৃষ্টি হত যে,লাজ-লজ্জায় চুপসে যেতেন ছেলেরা।
কারণ,ছেলেদের কাউরেই বাবার কোন স্মৃতি নেই। শরীরি বাবকে তারা দেখেননি। সেই ছোটছোট শিশুরা আজ বড় হয়েছে। সম্ভ্রমবোধ,মর্যাদাবোধ জন্ম নিয়েছে ছেলেদের মধ্যে।
তাই বাবার পরিচয়টা তো চাই-ই তাদের। সেই পরিচয়টা মিলেছে এবার! বাবা আছেন সাক্ষাত আছেন।
তাইতো সবার মুখে আলোর ঝলকানি।
আবেগ,আহ্লাদ আর গর্বের সাথে ছেলেরা বলছেন,আমাদের বাবা ফিরে এসেছেন!ফিরে এসেছেন বহুদিন পর হলেও ৩৬ বছর পর।
তবে স্ত্রী গোলেজানের মুখে অভিমান ও অভিযোগের সুর-‘সেই ছোটছোট সন্তানদের রেখে উনি চলে গেছেন।
আর ফেরার নাম করেননি। কী যে কষ্ট হয়েছে আমার! তারপরও ভাল লাগছে যে,উনি ফিরে এসেছেন।
’ লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বাউরা ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের ডাঙ্গাপাড়ার বাসিন্দা তালেব আলী। ৮০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে লালমনিরহাট জেলার হাতীবান্ধা উপজেলায় অবস্থিত তিস্তা ব্যারাজে কাজ করতে গিয়ে একদিন আর বাড়ি ফেরেননি তালেব আলী।
তিন শিশু সন্তানের জননী গোলেজান দিনের পর দিন,মাসের পর মাস,বছরের পর বছর অপেক্ষা করে আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন স্বামীর।
সেই স্বামী তালেব আলীর আবার আবির্ভাব! তালেব আলীর ৩ ছেলে সন্তান। বড় ছেলে গোলাফফর (৪৩),মেজ ছেলে আলামিন (৪০),ছোট ছেলে সাহিদুল (৩৭)।
এই ৩৬ বছরের অন্তর্ধানে শিশু সন্তান্তানরা একটু একটু করে বড় হয়েছেন,সংসার পেতেছেন,সন্তান-সন্ততির জন্ম দিয়েছেন।
এই ৩৬ বছর বগুড়ার বিভিন্ন স্থানে কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে কাটিয়েছেন বলে জানালেন তালেব আলী।
বয়সের ভারে ন্যূজ, রোগা তালেব আলী জানালেন, তিনি ২২ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার বিকেলে বগুড়ার আক্কেলপুর থানার সন্নিকটে রেলক্রসিং এর নিকেটে একটি চায়ের দোকানে চা খেতে বসলে চায়ের দোকানের বাঁশের খোঁটায় চলন্ত ট্রেনের বারি লাগলে খোঁটাটি এসে তার কপালে লাগে।
তিনি আহত হয়ে ঘটনাস্থলে পড়ে থাকলে স্থানীয় এক সাংবাদিক তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে সুস্থ্য করে তুলে তার নাম-পরিচয় জেনে পাট্রগাম থানায় ও বাউরা ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ বসুনিয়াকে খবর দেন।
পরে থানা পুলিশ ও চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় তার ছেলেরা তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে।
সংবাদ নিতে শনিবার,২৪ নভেম্বর তালেব আলীর বাড়িতে গেলে লক্ষ্য করা গেল তালেব আলীকে নিয়ে সবার আগ্রহ ও উৎসাহ।
স্ত্রীর কন্ঠে অভিমান ও অভিযোগের সুর থাকলেও ছেলেদের চোখে-মুখে বাবকে ফিরে পাওয়ার আনন্দ। বড় ছেলে আনন্দে গদগদ কন্ঠে বললেন,বাবা আমাদের মাঝে ফিরে এসেছেন এটা আনন্দের বিষয়। আমাদের খুবই ভাল লাগছে। স্ত্রী গোলেজান বললেন,‘নাতি-নাতনীরা খুব খুশি হয়েছে। আমিও খুশি হয়েছি।
সেই রেখে যাওয়া শিশু সন্তানদের ঘরে এখন সাত-সাতটি সন্তান।’বড় নাতনী আনন্দের সাথে বললেন,দাদাকে ফিরে পেয়ে আমাদের খুব ভাল লাগছে। আপনি কেন এতদিন পরিবার-পরিজনের খোঁজ নেননি,এমন এক প্রশ্নের উত্তরে মুহূর্তেই নির্বাক বনে যাওয়া তালেব আলী দম ফেলে বললেন,আমার কিছুই মনে ছিল না।
কীভাবে যে কী হয়ে গেছে,কীভাবে এতদিন কাটাইছি আমি নিজেও জানি না। তালেব আলী গ্রামে ফিরে আসায় বিস্ময়াভূত গ্রামবাসী একনজর দেখার জন্য তালেব আলীর বাড়িতে ভির জমাচ্ছেন।