ঢাকা: পুলিশ ও প্রশাসনের কিছু দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ‘গুরুতর’ অভিযোগ তুলছে বিএনপি। দলটি বলছে, নৌকার প্রার্থীদের বিজয়ী করতে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের প্রতিনিয়ত গোপন বৈঠক চলছে। প্রশাসন এবং পুলিশের ‘বিতর্কিত ও দলবাজ’ কর্মকর্তারা জনসমর্থনহীন আওয়ামী লীগকে ফের ক্ষমতায় বসানোর জন্য নানা চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে।
আজ শনিবার সকালে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে এসব অভিযোগ তোলেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
বিএনপির দাবি, গত ২০ নভেম্বর মঙ্গলবার রাতে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের চার তলার পেছনের কনফারেন্স রুমে এক গোপন মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিব সাজ্জাদুল হাসান, জনপ্রশাসন সচিব ফয়েজ আহমদ, নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালউদ্দীন আহমদ, পানিসম্পদ সচিব (শেখ হাসিনার অফিসের প্রাক্তন ডিজি) কবির বিন আনোয়ার, বেসামরিক বিমান পরিবহন সচিব মহিবুল হক, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও মহানগরী রিটার্নিং অফিসার) সদস্যসচিব আলী আজম, প্রধানমন্ত্রীর এপিএস-১ (বিচারক কাজী গোলাম রসুলের মেয়ে) কাজী নিশাত রসুল। এছাড়াও পুলিশের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন র্যাব, ডিএমপি ও কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা। রাত সাড়ে ৭টা থেকে আড়াই ঘণ্টা ধরে চলা এ মিটিংয়ে সারা দেশের ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং সেট-আপ ও প্ল্যান রিভিউ’ করা হয়। ওই বৈঠকে পুলিশের একজন ডিআইজি হাবিব বলেন, পুলিশ সূত্রের খবর অনুযায়ী ৩৩টি সিট নৌকার কনফার্ম আছে এবং ৬০-৬৫ টিতে কনটেস্ট হবে, বাকি আর কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই সাংঘাতিক কিছু করা ছাড়া এটি উৎরানো যাবে না।
সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ওই বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা শেষে মূল সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, নির্বাচন কমিশন থেকে বিএনপি-ঐক্যফ্রন্টকে চরম অসহযোগিতা করা হবে, যতই চাপ দেওয়া হোক প্রশাসনে হাত দেওয়া যাবে না, ধরপাকড় বাড়ানো হবে, প্রার্থী গুম খুন করে এমন অবস্থা তৈরি করা হবে যাতে তারা নির্বাচন থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হয়। সেটির আলামত ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে যশোর জেলা বিএনপি’র সহ-সভাপতি ও বিএনপি’র মনোনয়ন প্রত্যাশী আবু বকর আবুকে তুলে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে।
বৈঠকে আরও বলা হয়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যদি শেষ পর্যন্ত ভোটে থেকে যায় তাহলে ভোটের দিন পর্যন্ত ধরপাকড়ের তাণ্ডব চালানো হবে নির্দয়ভাবে, যেন ভোট কেন্দ্রে কেউ হাজির হতে সাহস না করে। আর যদি ধানের শীষের অনুকূলে ভোটের হাওয়া ঠেকানো না যায়, তবে মিডিয়া ক্যু করে নৌকাকে জিতানো হবে, বিটিভির মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণা করে সব মিডিয়াতে তা রিলে করার ব্যবস্থা করা হবে। একবার ফল ঘোষণা করতে পারলে তারপরে নির্মমভাবে সব ঠান্ডা করা হবে।
বিএনপি নেতা রিজভী বলেন, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় এরপর থেকে এ ধরনের সভা খুব বেশি করা যাবে না, তবে পরামর্শ করে কাজ করা হবে। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্প তদারকির নামে আসন্ন একাদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষে ৮ জন আওয়ামী দলীয় কর্মকর্তা দিয়ে মনিটরিং সেল গঠন করে পুলিশ সদর দপ্তর। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান ৪৫ জন সিনিয়র কর্মকর্তাকে ৬৪ জেলার উপদেষ্টা (মেনটর) নিয়োগ করে একটি নজিরবিহীন সরকারি আদেশ জারি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ নিয়ে বিএনপির লিখিত আপত্তির প্রেক্ষিতে তা বাতিল করতে বাধ্য হয়। কিন্তু গোপনে ওই সব কর্মকর্তারা জেলায় জেলায় মনিটরিংয়ের কাজ এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। এর বাইরে সারা দেশের ভোট ইঞ্জিনিয়ারিং করার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা প্রথম তালিকার ৬ জন সচিবকে নিয়ে একটি গুপ্ত কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা অফিসার্স ক্লাবে। মূলত: এখানে সব ধরনের অফিসারদের গমনাগমণ ঘটে থাকে, তাই বিরোধী পক্ষের চোখ এড়ানো সহজ হবে মনে করে অফিসার্স ক্লাবে গুরুত্বপূর্ণ এই সভাটি বসে।
রিজভীর অভিযোগ, ক্ষমতাসীনরা আসন্ন ভোট নিয়ে কি ভয়ংকর পরিকল্পনায় মেতে উঠেছে। উপরিউক্ত দলবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও কর্মকাণ্ড সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচন কমিশনকে লিখিত আকারে জানানো হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে সরকারের এজেন্ডা নির্বাচন কমিশন কখনো প্রকাশ্যে কখনো নীরবে-নিভৃতে বাস্তবায়ন করছে-এই অভিযোগ এখন সর্বত্র ভূরি ভূরি। কিন্তু নির্বাচন কমিশন তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিরসন করতে সক্ষম হয়নি। মোদ্দাকথা তফসিল ঘোষণার পরও আওয়ামী প্রশাসনিক দাপটের ছবিটা মোটেও বদলায়নি। কিন্তু কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে কতিপয় কমিশনার তাদের স্বপদে বহাল রাখতে তৎপর। নির্বাচন কমিশন ক্ষমতাসীনদের স্বার্থে কাজ করছে বলেই এই অভিযোগগুলো থেকে ছিটকে আসা কাদা তারা ঠেকাতে পারে না। বিতর্কিত নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নির্বাচনী কর্মকাণ্ড থেকে সরাতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে তাদের প্রত্যাহার করতে হবে।
বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস কাদের চৌধুরীর প্রসঙ্গ টেনে রিজভী বলেন, গিয়াস কাদের চৌধুরী সাবেক সংসদ সদস্য। এজন্য তিনি কারাগারে কারাবিধি অনুযায়ী তিনি ডিভিশন পাওয়ার যোগ্য। কিন্তু তাকে আটক করার পর প্রথমে ডিভিশন দেওয়া হলেও গতকাল তা বাতিল করে সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে আমদানি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে। কারাগারেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নির্যাতনের মুখে রাখতে হবে, এটাই হচ্ছে এই সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। সেই কারণে মানসিক ও শারীরিকভাবে যন্ত্রণা দিতেই কারাগারে গিয়াস কাদের চৌধুরীর ডিভিশন বাতিল করা হয়েছে।
জাতীয়তাবাদী যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে নির্বাচন থেকে দুরে রাখার জন্যই আইনি প্রক্রিয়ার নামে বারবার হয়রানি করা হচ্ছে। হাইকোর্ট থেকে জামিন লাভ করার পরও সেই আদেশের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করেছে সরকার পক্ষ। উদ্দেশ্য টুকুকে আটকিয়ে রাখা, যাতে সে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারে।
রমনা থানা ছাত্রদল নেতা মো. জুয়েল রানাকে গত ২১ নভেম্বর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ, এখনো তার কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি। তার পরিবারসহ দলের নেতা কর্মীরা চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। অবিলম্বে তাকে জনসম্মুখে হাজির করে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছি। খিলক্ষেত থানাধীন ৪৮নং ওয়ার্ড বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হক ভূঁইয়াকে গতকাল সকালে গ্রেপ্তার করেছে খিলক্ষেত থানা-পুলিশ।