গ্রাম বাংলা ডেস্ক: বাংলাদেশ মনে করে চীন কাউকে বিরক্ত করে না। তাই চীনের দেখানো পথেই হাঁটবে বাংলাদেশ। গত ২৭শে মে শাংহাই ডেইলি ডটকমে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই মনোভাবই ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্তমানে চীন সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রয়েছেন। চীনা সাংবাদিক লি চিনরানের যে প্রশ্নের উত্তরে তিনি ওই মনোভাব দেখিয়েছেন, সেখানে প্রকারান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই ইঙ্গিত করা হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। কারণ দক্ষিণ চীন সমুদ্র নিয়ে সাম্প্রতিককালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। প্রায় মাঝেমধ্যেই তিন দেশের পক্ষ থেকে একে অপরকে লক্ষ্য করে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে দেখা যাচ্ছে।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর মোর্চা জি-৭ চার দিন আগে এক বিবৃতিতে দক্ষিণ ও পূর্ব চীন সমুদ্রে উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে। রয়টার্স বলেছে, চীন তেল ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দক্ষিণ চীন সমুদ্রের বেশির ভাগ এলাকাকেই নিজের বলে মনে করে। এই এলাকার ওপর তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, ব্রুনাই, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার দাবি তারা প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। অন্যদিকে পূর্ব চীন সমুদ্রের এলাকা নিয়ে চীনের সঙ্গে জাপানের বিরোধ চলছে। সম্প্রতি ভিয়েতনামের দাবিকৃত জলসীমায় চীন একটি অয়েল রিগ স্থাপনের উদ্যোগ নিলে পুরো অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। চীনা রণতরী থেকে ভিয়েতনামি জাহাজে জলকামান দাগানোর ঘটনাও ঘটেছে। ফিলিপাইন বলেছে, চীন এই এলাকায় একটি এয়ারস্ট্রিপ প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
গত ২৮শে মে এএফপি’র খবরে বলা হয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা চীনের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, দক্ষিণ চীন সমুদ্রে চীন আগ্রাসন চালাচ্ছে। এর মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত।
বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে ‘এশিয়া মহাদেশে অনেক বিরোধের ঘটনা ঘটছে যা কিনা এশিয়ার বাইরের শক্তি উস্কে দিচ্ছে? এশীয় জনগণ সেইসব শক্তির উস্কানি ও নাক গলানো কি করে মোকাবিলা করতে পারে? কারণ যেখানে বাইরের শক্তি এশিয়াকে শক্তিশালী দেখতে চায় না?
এর উত্তরে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা মনে করি, আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য আমাদের শান্তিপূর্ণভাবে সহযোগিতা করতে হবে, চীন যেভাবে তার উন্নয়ন লক্ষ্যকে সামনে এগোনোর পথ দেখাচ্ছে সেভাবেই। যাই হোক, চীন কাউকে বিরক্ত করে না। এবং সে কেবল উপরের দিকে, উপরের দিকেই যাচ্ছে। এবং আজ তারা এক নম্বর অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এবং এটা এমন কিছু যাকে আমরা সমর্থন করতে আগ্রহী।’
প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর শেষ মুহূর্তে টানাপড়েন
আমাদের কূটনৈতিক রিপোর্টার মিজানুর রহমান জানান, বাংলাদেশ আগাগোড়াই ইতিবাচক ছিল। শুরুর দিকে চীনেরও গ্রীন সিগন্যাল ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে কি যেন ঘটলো। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন তখন থেকেই টানাপড়েনের শুরু। প্রস্তাবিত অনেক ইস্যুতেই আপত্তি জানিয়ে বার্তা আসে বেইজিং থেকে। আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয় ঢাকার কর্মকর্তাদের। চীনের বাজারে বাংলাদেশী পণ্য প্রবেশে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রস্তাব ছিল চীনের প্রধানমন্ত্রীর। বাংলাদেশ এটি কেবল সাদরে গ্রহণ নয়, রীতিমতো সেলিব্রেট করার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু সেই প্রস্তাবও যখন চীন ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ দেয় তখন পেশাদারদের আর বুঝতে বাকি থাকেনি কি ঘটতে যাচ্ছে। সফর প্রস্তুতির সবকিছু তখন চূড়ান্ত। কেবল বিমানে ওঠার অপেক্ষা। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করা হয় ঢাকার তরফে। চীনকে রাজি করানোর চেষ্টায় শেষ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন উপদেষ্টা যুক্ত হন। সফর শুরুর আগের দিনসহ ৫ দিনের প্রচেষ্টায় কিছুটা সফলতা আসে। কিন্তু তা প্রত্যাশার তুলনায় কতটুকু? ৬টি মেগা প্রজেক্ট- কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ (জয়েন্ট ভেঞ্চার), কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে বহু লেনবিশিষ্ট টানেল নির্মাণ, রাজশাহীতে পানি শোধনাগার নির্মাণ, চট্টগ্রামের কালুরঘাটে দ্বিতীয় রেলসেতু নির্মাণ ও চট্টগ্রাম-রামু-কক্সবাজার এবং রামু-গুনদুম (বাংলাদেশ-মিয়ানমার বর্ডার) ব্রডগেজ রেললাইন নির্মাণে চীনা সহায়তার প্রস্তাব করেছিল ঢাকা। গতকাল বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব পিপলস-এ চীনের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা এবং এ সংক্রান্ত সম্মতিপত্রে সই হওয়ার কথা ছিল। চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খেছিয়াং-এর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শীর্ষ বৈঠকটি হয়েছে গতকাল। সেখানে দু’টি চুক্তি, দু’টি বিনিময়পত্র এবং একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। কিন্তু মেগা ৬ প্রজেক্টের মধ্যে কেবলমাত্র কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তিতে উপনীত হতে পেরেছে দু’দেশ। বাকি ৫ প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ নিয়ে জানতে চাইলে শীর্ষ বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক বলেছেন- চীন এ নিয়ে আলোচনার জন্য আরও সময় নিতে চায়। তারা এখনই কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চায় না। সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের বিষয়টি আলোচনা হয়েছে বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ চুক্তিটির বাইরে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও কৌশলগত সহযোগিতা বিষয়ে আরেকটি চুক্তি সই হয়েছে। সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে বাংলাদেশে চীনের জন্য একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার বিষয়ে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে গবেষণা এবং দুর্যোগে উদ্ধার কার্যক্রমের সরঞ্জাম সহযোগিতার বিষয়েও পৃথক বিনিময়পত্র দু’টি সই হয়েছে। ঢাকা ও বেইজিং সম্পর্কের সমন্বিত অংশীদারিত্ব বা কমিপ্রহেনসিভ পার্টনারশিপের বিভিন্ন বিষয় সংযুক্ত করে দুই প্রধানমন্ত্রী একটি যৌথ ঘোষণায় সই করার কথা ছিল। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত এটির বিভিন্ন ধারার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারেনি ঢাকা ও বেইজিং। ঢাকার এক প্রতিবেদককে পররাষ্ট্র সচিবও অবশ্য জানিয়েছেন তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এটি সইয়ের চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত ঢাকায় যে সব খবর এসেছে তাতে জানা গেছে, চীন এখনও অনেক ইস্যুতে রাজি হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মধ্য দিয়ে দেশটিতে জনশক্তি রপ্তানির দরজা উন্মুক্তকরণ, দেশ দু’টির জনগণের পর্যায়ে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় ভ্রমণ বা অন্যান্য ভিসা সহজ করা এবং চীনের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশীদের মেধাবৃত্তি বৃদ্ধির প্রস্তাব ছিল ঢাকার। একটি বড় অনুদান প্রাপ্তি এবং দু’দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক ফোরাম প্রতিষ্ঠারও আলোচনা ছিল। কিন্তু না, সে বিষয়ে গতকালের শীর্ষ বৈঠক কোন সুখবর দিতে পারেনি।
‘চীন সফর একটি বিরাট সাফল্য’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চীনে তার সফরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার এবং অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সহযোগিতার এক নতুন পথ উন্মোচিত হবে। তিনি বলেন, ‘আমার চীন সফর একটি বিরাট সাফল্য।’ এখন থেকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় অতীতের চেয়ে আরও বেশি গুরুত্ব পাবে। গতকাল বেইজিংয়ে ‘সামপ্রতিক বছরে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক সাফল্য এবং চীনের সঙ্গে অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক সেমিনারে চীনের বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। চায়না ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ (সিআইআইএস) বেইজিংয়ে তার নিজস্ব কার্যালয়ে এ সেমিনারের আয়োজন করে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ-ভারত-চীন-মিয়ানমার (বিআইসিএম) অর্থনৈতিক করিডোর প্রতিষ্ঠায় চীনের প্রস্তাবের প্রতি বাংলাদেশ সমর্থন জানিয়েছে। এক সময়ের জনপ্রিয় ‘সিল্ক রুট’ হিসেবে পরিচিত এই করিডোরের ফলে নেপাল ও ভুটানসহ এ অঞ্চলের সব দেশের জনগণ লাভবান হবে। স্বল্প সময়ে চীনের দ্রুত অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতির প্রশংসা করে শেখ হাসিনা বলেন, চীনের সামপ্রতিক উন্নয়নে তিনি অভিভূত। চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক কিছু শেখার রয়েছে। এসময় সিআইআইএস-এর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাবেক কূটনীতিক রুয়ান চংচে তার স্বাগত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরেন এবং তার নেতৃত্বে বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে সাফল্যের বর্ণনা দেন।
রুয়ান বাংলাদেশকে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকারের জন্য তার প্রশংসা করেন। এ প্রশ্নোত্তরপর্বে পিপলস ডেইলি ও শেনচেন টেলিভিশনের সাংবাদিক এবং চায়না কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটির (সিসিইউ) ফ্যাকাল্টির সদস্যসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অগ্রগতি এবং বাণিজ্য, বিনিয়োগ, যোগাযোগ এবং জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগসহ চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কোন্নয়নের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। এসময় সিআইআইএস সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে বাংলা ভাষার বিপুল সংখ্যক সাবেক ছাত্রছাত্রী এবং উভয় দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা ও চীনা ভাষায় অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
চীনকে সহযোগিতার অংশীদার হিসেবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোন আদর্শিক ও আঞ্চলিক পক্ষপাত ছাড়াই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার হয়েছে। বাংলাদেশ ও চীন উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর স্বার্থে কার্যকর যে কোন ইস্যুকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে আসছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি সমপ্রীতির সমাজ গড়ার চীনের নীতির প্রতি পুরোপুরি সমর্থন দিয়ে আসছে। জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে গভীরভাবে আগ্রহী।