স্বকৃত নোমান: বিশ্বজুড়ে ‘মি টু’ আন্দোলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। নিপীড়িত নারীসমাজ পুরুষদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে মুখ খুলছে― সভ্যতার জন্য এটি একটি বড় ঘটনা। নারীর অগ্রগতির এটি একটি অন্যতম ধাপ। বাংলাদেশেও এর অভিঘাত পড়েছে। যৌন নিপীড়নের শিকার বেশ কয়েকজন নারী এরই মধ্যে তাদের বেদনার কথা লিখেছে। পুরুষতন্ত্রের মুখোশ খুলে দিয়েছে। ভদ্রতার মুখোশধারী পুরুষদের চিহ্নিত করে দিয়েছে। বাংলাদেশের নারী সমাজের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় ঘটনা।
তারই ধারাবাহিকতায় জনৈক মুশফিকা লাইজু গতকাল প্রয়াত নাট্যকার সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলে ফেসবুকে একটা পোস্ট দিয়েছেন। সেই লেখাটি একটি অনলাইন পোর্টালেও প্রকাশিত হয়েছে। মুশফিকা লাইজু তার পোস্টে অভিযোগ করেছেন, ৩১ বছর আগে, তিনি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্রী ছিলেন, একদিন তিনি ‘ইলিয়াড’ ও ‘ওডিসি’ বই দুটি সংগ্রহের জন্য বিভাগের শিক্ষক সেলিম আল দীনের বাসায় যান। সেলিম আল দীন নানা কথার পর একপর্যায়ে জোর করে তাকে চুমু খান এবং তার বিশেষ অঙ্গে হাত দেয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। লাইজু কোনোরকমে ছুটে বাসা থেকে বেরিয়ে যান… ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা বলছি না, সেলিম আল দীন শাস্ত্রপ্রোক্ত দেবদূত ছিলেন। তিনি মানুষ ছিলেন। মানুষ হিসেবে তার ভুলভ্রান্তি থাকলেও থাকতে পারে। আমরা জানি না মুশফিকা লাইজুর সঙ্গে তিনি ঘটনাটি আদৌ ঘটিয়েছিলেন কিনা। এই ঘটনার কোনো সাক্ষী-প্রমাণ নেই। মুশফিকা নিজেই লিখেছেন, তখন বাসায় আর কেউ ছিল না। সুতরাং তার কথা অনুযায়ী, এই ঘটনার কোনো সাক্ষী-প্রমাণ নেই। মুশফিকার লেখার পক্ষে এখনও কেউ সাক্ষ্য দেবে কিনা, এই ব্যাপারে আমরা সন্দিহান। মুশফিকা আরো লিখেছেন, সেলিম আল দীনের বাসায় যাওয়ার সময় তিনি তার প্রেমিককে পথে দাঁড় করিয়ে রেখে তারপর গিয়েছেন। আমাদের প্রশ্ন, প্রেমিককে পথে দাঁড় করিয়ে আপনি একা কেন সেলিম আল দীনের বাসায় গেলেন? প্রেমিককে কি নিয়ে যেতে পারতেন না?
সেলিম আল দীন সত্যি যদি মুশফিকা লাইজুর সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটিয়ে থাকেন, ৩১ বছর ধরে মুশফিকা চুপ করে ছিলেন কেন? কেন তখন তিনি আইনের আশ্রয় নিলেন না? কেন তিনি সাংবাদিক সম্মেলন করে সবাইকে জানালেন না? কেন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষক বা উপাচার্য বা সিন্ডিকেটের গোচরে আনলেন না? কেন সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করলেন না? বাংলা নাটকের প্রাণপুরুষ, জ্ঞানবৃক্ষ সেলিম আল দীন প্রয়াত হয়েছেন ২০০৮ সালে। তার মৃত্যুর দশ বছর পর ৩১ বছর আগের একটি ঘটনাকে কোন উদ্দেশ্যে প্রচার করছেন মুশফিকা লাইজু? জীবিত মানুষের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ আনলে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থাকে। সেলিম আল দীন মৃত। তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ নেই। তাকে কেউ ধর্ষক বললেও তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারবেন না। তাহলে আমরা কোন যুক্তিতে, কোন প্রমাণে, মুশফিকা লাইজুর এই অভিযোগকে সত্যি বলে ধরে নেব?
কোনো একজন নারী বলে দিলেন রবীন্দ্রনাথ লম্পট ছিলেন, নজরুল চরিত্রহীন ছিলেন, জীবনানন্দ আমাকে জোর করে চুমু খেয়েছেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আমাকে ধর্ষণ করেছেন, তারাশঙ্কর আমার বিশেষ অঙ্গে হাত দিয়েছেন, আর আমনি আমরা নারীটিকে বাহবা দিতে শুরু করব, তাকে সাহসী উপাধি দিতে থাকব― বিষয়টা কি এত সহজ? সাক্ষী-প্রমাণ ছাড়া একটা অভিযোগ করে দিলেই হয়ে গেল? নির্বিচারে আমরা তা বিশ্বাস করে নেব?
শুধু চুমুর ব্যাপারটি নয়, সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে মুশফিকা লাইজু আরো অভিযোগ করেছেন যে, সেলিম আল দীন তাকে নাকি ক্লাস থেকে বের করে দিতেন এবং যতগুলো অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়া ছিল সবগুলোতে ২০-এর মধ্যে ০ এবং ৯ নম্বর দিয়ে মুখের উপর ছুঁড়ে দিতেন। তার ওপর এই অবিচার দেখেও তার ১১ জন সহপাঠী নাকি চুপ করে থাকতেন। কারণ সেলিম আল দীন নাকি সবাইকে প্রথম শ্রেণি দেয়ার প্রলোভন দিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম শ্রেণি পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের চাকরি হবে― এই কারণে নাকি তারা চুপ করে থাকতেন। অর্থাৎ মুশফিকা লাইজু শুধু সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধেই অভিযোগ করলেন না, একই সঙ্গে তার ১১ জন সতীর্থকেও দোষী সাব্যস্ত করলেন, তাদেরকে লোভি সাব্যস্ত করলেন।
যারা সেলিম আল দীনের ছাত্র, যারা তার ভক্ত-শিষ্য, তারা জানেন, সেলিম আল দীন তার ছাত্রদের কতটা স্নেহ করতেন, কতটা ভালোবাসতেন। ছাত্রবৎসল এই শিক্ষক কাউকে ক্লাস থেকে বের করে দিতে পারেন, এই কথা তার কোনো ছাত্র-ছাত্রী বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। এই শিক্ষাগুরু ব্যক্তিগত বিদ্বেষবশত কোনো ছাত্র-ছাত্রীকে অ্যাসাইনমেন্টে নম্বর কম দেবেন, এই কথা কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না। এবং সেলিম আল দীনের শত্রুও এই কথা বিশ্বাস করবে কিনা সন্দেহ। কারণ সেলিম আল দীনের ছাত্রবৎসল্যের কথা সর্বজনবিদিত।
সেলিম আল দীনের কাছে অনেকে যেতেন। কেউ যেতেন স্রেফ তাকে ভালোবেসে। কেউ যেতেন তার ভালোবাসা পেতে। কেউ যেতেন তার কাছ থেকে শিখতে। তার কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করতে। তাদের কেউ সেলিম আল দীনের বিরুদ্ধে আনীত এই অভিযোগ বিশ্বাস করবেন না। কারণ এটি বিশ্বাস করার মতো ঘটনা নয়। সেলিম আল দীনকে যারা জানেন, তারা কোনোদিন এমন অভিযোগ বিশ্বাস করবেন না। আমরা ধারণা করছি, মুশফিকা লাইজু এমন কোনো দাবি নিয়ে সেলিম আল দীনের কাছে গিয়েছিলেন, সেলিম আল দীন যা পূরণ করতে ব্যর্থ হন। সেই কারণে ক্ষুব্ধ হন মুশফিকা লাইজু। সেই ক্ষুব্ধতা তিনি এতদিন গোপন করে রেখেছেন। ‘মি টু’ আন্দোলনের সুবাদে এখন তিনি কাল্পনিক অভিযোগ এনে মূলত সেই ক্ষুব্ধতারই শোধ নিতে চাচ্ছেন। অথবা তিনি সেলিম আল দীনের জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে নিজেই বিখ্যাত হতে চাইছেন।
সেলিম আল দীন প্রেমিক পুরুষ ছিলেন। জীবনে একাধিক প্রেম করেছেন। সেসব প্রেমের কথা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। তার প্রেমিকাদের সম্পর্কে জানতে আপনারা পড়ে নিতে পারেন তার ‘ভাঙা প্রেম অশেষ বিশেষ’ বইটি। ঢাকার জাগৃতি প্রকাশনী থেকে বইটি প্রকাশিত হয়। ঢাকার দীপনপুরে বইটি পাওয়া যায়। এছাড়াও তার জীবনের নানা কথা তিনি লিখেছেন তার দিনলিপিতে। নারীদের প্রতি তিনি কতটা শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, ছাত্রীদের তিনি কতটা স্নেহ করতেন, পিতার মতো কীভাবে আগলে রাখতেন, তা তার ছাত্র-ছাত্রী, ভক্ত-শিষ্য সবার জানা।
ঋষিতুল্য এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে, বাংলা নাটকের এই প্রাণপুরুষের বিরুদ্ধে মুশফিকা লাইজু যে অভিযোগ তুলেছেন, তা সম্পূর্ণ কাল্পনিক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছি। আমরা এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আশা করি মুশফিকা লাউজু সাক্ষ-প্রমাণহীন তার এই কাল্পনিক অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেবেন।
সেলিম আল দীন পাঠক পরিষদের পক্ষে
স্বকৃত নোমান
ঢাকা ১৫.১১.২০১৮