শহীদ লেখকদের রচনা অপঠিত কেন?

বাধ ভাঙ্গা মত

johir1-1418538536শুরুতে জানা কথাগুলোই আবার পড়ে নেওয়া যাক।
১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনী যখন বুঝতে শুরু করে যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব না, তখন তারা নবগঠিত দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দূর্বল এবং পঙ্গু করে দেয়ার জন্য পরিকল্পনা করতে থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ গৃহ থেকে তুলে এনে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। (সূত্র বাংলা উইকিপিডিয়া)

এই ক্ষুদ্র লেখা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তাৎপর্যপূর্ণ স্মরণের প্রয়োজনে রচিত। কেননা স্মরণকেও আমরা আনুষ্ঠানিকতার প্রলেপে মুড়িয়ে দিয়েছি। আমাদের ভেতর জাতিগতভাবেই সম্ভবত দেখানেপনা আছে। আর হাহাকার, হাহুতাশ, বাষ্পরুদ্ধ হয়ে পড়া, চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু ফেলে আত্মশ্লাঘা অনুভব আমাদের মজ্জাগত হয়ে পড়েছে। ভাষা আন্দালনের সেই বিখ্যাত গানটির দিকেই ফিরে তাকান। পুরো গানটা আমরা গাই না। ওই গানের একটা অংশ অশ্রু ভারাতুর, অন্য অংশে মশাল জ্বালার অঙ্গীকার। নাগিনীদের জেগে উঠে বসুন্ধরাসুদ্ধ কাঁপিয়ে দেওয়ার দ্রোহের দিকটি উপেক্ষা করে ‘আমি কি ভুলিতে পারি’ বলে মনটাকে কান্নার দলার ভেতর মুচড়ে দিতেই আমাদের স্বস্তি। দৃষ্টি আকর্ষণ করলে গানটির রচয়িতা স্বয়ং আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী আমাকে তার চমৎকার উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘একুশে ফেব্রুয়ারির যে একটা বিদ্রোহাত্মক দিক আছে, কোনো সরকারই চান না সেটা থাকুক। তারা এটাকে প্রথাগত উৎসবে রূপান্তরিত করেছেন। একুশের ভেতরে আসলেই যে উদ্দীপনার স্পন্দন ছিল, সেটা এখন নেই। এটা একটা উৎসব। এটার যে একটা স্বকীয়তা ছিল ষাটের দশক পর্যন্ত, এখন আর সেটা নেই। এটা অন্তর্গত বিদ্রোহ সুকৌশলে এভয়েড করা হয়েছে।’
(খ্যাতিমান লেখকদের সাক্ষাৎকার, প্রেরণা প্রকাশনী ১৯৯৩)

আজ শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসেই প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখুন- সেখানে শোকের কথাই বহুল উচ্চারিত। কে কত বেশি শোকাতুর করে তুলবেন গোটা বিষয়ে তারই এক সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা। নিশ্চয়ই ১৪ ডিসেম্বর আমাদের শোকের দিন। এত বড় বর্বরতা আর কোন জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছে কে কবে? সেকথা সবিস্তারে আমরা নিশ্চয়ই তুলে ধরব নতুন প্রজন্মের কাছে। কিন্তু জাতির সেরা সন্তানদের অবদানের দিকগুলোকে কেন আমরা এড়িয়ে যাব? আমি এ ক্ষুদ্র লেখায় শুধুমাত্র কয়েকজন লেখকের কথাই উপস্থাপন করতে চাইছি। স্বাধীনতার পরপর ১৯৭২ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের জেলাওয়ারি একটি হিসাব প্রকাশিত হয় যা বাংলা উইকিপিডিয়ায় তুলে ধরা হয়েছে। খেয়াল করে দেখবেন সেখানে কোনো সাহিত্যিক শহীদ বুদ্ধিজীবী লেখক-তালিকায় আলাদাভাবে অন্তর্ভুক্ত হননি। সেখানে ৯৯১ জন শিক্ষাবিদের নাম আছে। এমনকি সাংবাদিক, চিকিৎসক, আইনজীবীদের পেশাটিও স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত। ‘অন্যান্য’ হিসেবে এসেছে শহীদ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পী ও প্রকৌশলীদের নাম। ওই তালিকা থেকে কেবলমাত্র লেখকদের নাম আলাদা করতে গেলে কাজটা সহজ হয় না। এটা প্রথম সমস্যা।

এর পরেই আমাদের যা বলা জরুরি সেটা হলো শহীদ লেখক বা সাহিত্যিকদের রচনাসম্ভার পাঠকের কাছে সহজলভ্য করা। সেইসব লেখা নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করে বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষকশূন্য, জাতিকে মনন-প্রতিবন্ধী করার দুরভিসন্ধি তো ছিলই পাকিস্তানি শাসকচক্রের। ঈর্ষা, পরশ্রীকাতরতাই এর নেপথ্য কারণ- বিষয়টি এত সরল নয়। এ এক গভীর জাতিবিদ্বেষ। ভাষাবিদ্বেষ। সাহিত্যবিদ্বেষ। যে ক’জন সাহিত্যিককে ১৪ ডিসেম্বর জীবন থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছিল তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সমাজের অগ্রসর সাহিত্যিক। মুনীর চৌধুরীর মতো নাট্যকার সেই বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী সময় থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছে ছিলেন চক্ষুশূল। তাঁর ‘কবর’ নাটকটি প্রতিবাদের এক আশ্চর্য নাট্যসৃষ্টি। নাটকটি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠিকে অনেক বিব্রত করেছে। সমাজে সাধারণ  মানুষের কাছে নাটকের মাধ্যমে বক্তব্য সহজেই সঞ্চারিত করা যায়। অত্যন্ত শক্তিশালী জনমত গঠন এবং একই সঙ্গে বিনোদনে সক্ষম এক শিল্পমাধ্যমের পুরোধা ব্যক্তিত্বকে সরানো নরঘাতকদের জন্যে জরুরি হয়ে উঠেছিল। মুনীর চৌধুরীর অল্প কিছু রচনা আলোচনার পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা হয়েছে স্বাধীনতার পর। পাঠ্য বইয়ের বাইরে তিনিও ব্যাপকভাবে পঠিত ও আলোচিত হননি।

স্বাধীন দেশে জহির রায়হান নিখোঁজ হয়েছিলেন। এতে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ নেই যে ১৪ ডিসেম্বরের অসমাপ্ত পরিকল্পনাটির এক ধরনের আপাত সমাপ্তি ঘটে জহির রায়হানকে সরিয়ে ফেলার ভেতর দিয়ে। জহির রায়হানের ক্ষেত্রেও আমরা দেখব তাঁর চলচ্চিত্র বহুল প্রদর্শিত, আলোচিত। সে তুলনায় তার সাহিত্যকর্ম প্রায় উপেক্ষিত। এটা কি আমাদের উদাসীনতা, নাকি সচেতন উপেক্ষা? জহির রায়হানের অগ্রজ শহীদুল্লা কায়সারের দুটি উপন্যাস ‘সারেং বউ’ ও ‘সংশপ্তক’। ‘সারেং বউ’ সিনেমা হয়েছিল, ‘সংশপ্তক’ ধারাবাহিক টিভি নাটক। এ দুটোর দর্শক মিলেছে অনেক, উপন্যাসের পাঠক সে তুলনায় নগণ্য।

সম্ভবত কবি-পরিচয়ে পরিচিতদের ভেতর একমাত্র শহীদ হয়েছিলেন কবি মেহেরুন্নেসা। তাঁর কবিতা পাওয়া আজ সহজ নয়। জাতীয় যাদুঘরে বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত চলমান বিশেষ প্রদর্শনীতে তাঁর একটি গ্রন্থ সংরক্ষিত আছে। তার একটি খোলা পাতা থেকে এখানে উদ্ধৃত করছি :

‘শত সুন্দর সবুজ জড়ানো বনানী আমার
স্বচ্ছ শীতল ছলোছলো স্রোত এ-নদী আমার
আম-জাম-ঝাউ নিম-নারিকেল শিমুল-তমাল
উদাস প্রকৃতি বাউল বাতাস
কলাপাতা-ছাওয়া মায়া সংসার-

এ সব আমার- এ দেশ আমার।’

সহজিয়া দেশপ্রেমের কবিতাটি সহজেই মন ছুঁয়ে যায়।

মোফাজ্জল হায়দার ছিলেন যুগপৎ সৃজনশীল ও মননশীল প্রতিভার অধিকারী। গবেষণার পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন অনেক কবিতা, গল্প ও নাটক। রবীন্দ্রসাহিত্য ও রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ ছিল তাঁর অধ্যয়ন ও চিন্তাচেতনার প্রধান অংশ। এর প্রত্যক্ষ ফসল তাঁর ‘রবি পরিক্রমা’ (১৯৬৩) গ্রন্থটি। এ ছাড়াও তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলির মধ্যে ‘বাংলা বানান ও লিপি সংস্কার’ (১৯৬২), ‘রঙীন আখর’ (১৯৬৩), ‘সাহিত্যের নব রূপায়ণ’ (১৯৬৯), ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

শহীদ অধ্যাপক আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ বইটির কথা অনেকেই শুনে থাকবেন। তবে সেটি পাওয়া সহজ নয়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছিলেন এই লেখক। রণেশ মৈত্র তাঁর সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোকপাত করেছেন। মুসলমান পরিচয়ের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হতে না পারার প্রসঙ্গ আছে তাতে। লিখেছেন : ‘সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়ে দেশত্যাগী অধ্যাপক আনোয়ার পাশা বহু ছেলেকে সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রোশ থেকে ১৯৬৪ সালে বাঁচালেন। কিন্তু ১৯৭১-এ ওই সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতেই তাঁর জীবন গেল।’

একাত্তরে যেসব লেখক শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের সেরা রচনাগুলো মলাটবন্দি হয়ে আজকের প্রজন্মের পাঠকের হাতে তুলে দেওয়া দরকার। তাঁরা হত্যার শিকার হয়েছিলেন একাত্তরে। চার দশক পরেও যদি তাঁদের রচনা উপেক্ষার শিকার হয় তাহলে আগামী প্রজন্মের কাছে আমাদের কোনো জবাব থাকবে না। আমাদের বুঝে নিতে হবে বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান তাঁরা রেখেছিলেন বলেই পাকিস্তানিরা হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁদের কলম চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল। সেইসব বর্বরদের আমরা ক্ষমা করতে পারি না। কখনো করব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *