শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতেই নির্বাচন কমিশন যাবতীয় কার্যক্রম চালাচ্ছে মন্তব্য করে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন ও আওয়ামী লীগ সবসময় উল্টো পথে হাঁটে। আজ শনিবার সকালে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অর্থই হচ্ছে- স্বচ্ছ নির্বাচনী ব্যবস্থার বারোটা বেজে যাওয়া। সংলাপ, নির্বাচন, তফসিল ঘোষণা সবই তামাশার নামান্তর মাত্র। এইজন্য আগামী নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বীতামূলক করার বা নির্বাচনী মাঠ সমতল করার কোনো গরজ বর্তমান নির্বাচন কমিশনের নেই। আর সেজন্যই শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার স্বার্থে একতরফা নির্বাচনের জন্য তাড়াহুড়ো করে কমিশন তফসিল ঘোষণা করেছে। এই ঘোষণায় সারাদেশের ভোটারদের মুড-অফ, দেশের জনগণ নির্বিন্ন ও হতাশ। এসময় দলের কেন্দ্রীয় নেতা আব্দুস সালাম আজাদ, মোঃ মুনির হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
রিজভী বলেন, সন্ত্রাসীদের দূর্গ আওয়ামী লীগ কখনোই প্রতিযোগিতামূলক অবাধ নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। নিজেদের স্বার্থে যখন যা ইচ্ছা তাই তারা করতে পারে। তারাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন করেছে, আবার তারাই সংবিধান থেকে সেটি মুছে দিয়েছে। কোনো আধুনিক সভ্য রাজনৈতিক দল একের পর এক প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বখাটের মত আচরণ করতে পারে না। এই যে জনমতকে তাচ্ছিল্য করা, এর মধ্য দিয়েই প্রমানিত হয়- সেই ব্যর্থ বাকশালে ফিরে যেতেই যতো আয়োজন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অবৈধ ক্ষমতাসীনরা জনগণের দাবি মানছে না। ৭ দফা দাবিকে অগ্রাহ্য করেই একতরফা নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। চিরস্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্যই বছরের পর বছর ধরে মিথ্যা মামলা-মোকদ্দমা, গ্রেফতার, হত্যা, গুপ্তহত্যাসহ ক্রসফায়ারের মতো পৈশাচিক নির্মমতাকে কাজে লাগানো হয়েছে বিরোধী দল দমনে।
তিনি আরো বলেন, ওরা জনগণকে ভয় পায় বলেই দেশের বিপুল জনপ্রিয় নেত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে কারাবন্দী করে রেখেছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও বানোয়াট মামলায় সাজা দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বিবেকশুন্য সরকার ও সরকারপ্রধানের নির্দেশে বেগম জিয়াকে চিকিৎসা না দিয়েই জরাজীর্ণ, পরিত্যক্ত ও বাসানুপযোগী নাজিমউদ্দিন রোডের সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। বাড়ীঘরসহ তার বেঁচে থাকার সমস্ত অবলম্বনকে কেড়ে নিয়ে, তার চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারকেও হরণ করেছে। নির্বাচন থেকে দুরে রাখতেই নির্বাচনের বছরে অনুগত আদালতকে দিয়ে সাজা দিয়ে জেলে আটকে রাখা হয়েছে। মামলায় আদালতে হাজিরাসহ বন্দীশালায় চালানো হচ্ছে নানামুখী নির্যাতন-নিপীড়ন। বিরোধী নেতাকর্মীদেরকে বিনা কারণে নিপীড়ন করার জন্যই দেশের কারাগারগুলো এখন শেখ হাসিনার প্রতিশোধ গ্রহণের পার্সোনাল খোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর জুলুম চালাতেই নিম্ন আদালত পার্টি ক্যাডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি আমাদের আন্দোলনের মূল লক্ষ্য। গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় মানুষ বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে উত্তাল আন্দোলনকে বিজয়ের পথে ধাবিত করবেই।
রিজভী বলেন, প্রাণী হত্যা করার পর আদিম বন্য উৎসবের ন্যায় এখন গণতন্ত্র হত্যার উৎসব চলছে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মনোনয়ন ফরম বিক্রির মাধ্যমে। আসলে একতরফা তফসিল ঘোষণার পর সারাদেশে বিষাদঘন পরিবেশ বিরাজ করছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন নিয়ে সংলাপের নামে সরকারি প্রতারণায় দেশবাসী বিস্মিত ও হতবাক। সরকারের সর্বোচ্চ ব্যক্তি কিভাবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন! তিনি বলেছিলেন- ‘নতুন মামলা দেয়া হবে না ও গ্রেফতার করা হবে না’, যেদিন বলেছেন ঠিক সেই রাত থেকেই আরও বেশী মামলা ও গ্রেফতার শুরু হয়েছে। এমনকি সিইসি তফসিল ঘোষণার সময় বলেছেন-বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার হয়রানি না করতে, রাজনৈতিক মামলা না দিতে, কিন্তু শুধু গতকালই বিরোধী দলের ৩ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দায়ের হচ্ছে নতুন নতুন মামলাও। বিএনপি নেতাকর্মীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
তিনি বলেন, কিছ্ক্ষুণ পূর্বে টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও কালিহাতি উপজেলা বিএনপির আহবায়ক শুকুর মাহমুদকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গত দুই দিনে ঝিনাইদহে ৩৮৫ জন, বগুড়ার শেরপুরে অর্ধশতাধিক, কুমিল্লায় ৬৩ জন, বরগুনার আমতলী, বামনা, পাথরঘাটা থেকে ১১ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল রাজধানীর নিউমার্কেট থানার কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন সরদারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে ৭, সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি গ্রেফতার হয়েছেন। মুন্সীগঞ্জে সিরাজদীখান উপজেলার বালূচর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবুল হোসেন, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলা ছাত্রদল নেতা সাইদুল ইসলাম লাকীসহ ৪ জনকে গতরাতে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
এছাড়া ময়মনসিংহের ভালুকায় এক সপ্তাহে প্রায় দেড় শতাধিক ও ফুলপুরে ৪৯ বিএনপির নেতাকর্মীর নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া গতকাল ধামরাইয়ে পাঁচশতাধিক বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে তিনটি মিথ্যা মামলা করা হয়েছে।
রিজভী বলেন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ধামরাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তমিজ উদ্দিন, ঢাকা জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক ইয়াছিন ফেরদৌস মুরাদসহ ৯১ জনের নাম উল্লেখসহ পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর নামে মামলা করা হয়। আর মিথ্যা মামলায় পুলিশ ধামরাইয়ের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে গতকাল পর্যন্ত বিএনপির ১২ নেতাকর্মীকে আটক করেছে।
আটককৃতরা হচ্ছে- ফটো মিয়া, সফি উদ্দিন, ফারুক হোসেন, সৈয়দ নাঈম, আব্দুল হালিম কন্ঠু, শাহীন মাহমুদ, আবু তাহের, আনোয়ার হোসেনসহ ১২ জন। বরগুনার বামনা উপজেলার তিন বিএনপি নেতাকে বৃহস্পতিবার রাতে আটক করেছে বামনা থানা পুলিশ। আটককৃত বিএনপি নেতারা হলেন- মোঃ খোকন মিয়া, মোঃ জামাল আকন ও মোঃ জামাল হোসেন। এদের প্রত্যেককে নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানা যায়।
ভোলার চরফ্যাশনে যুবদলের ফখরুল, মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে মোশারফ হোসেন, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে যুবদলের সভাপতি মহিউদ্দিন আহম্মদ ঝাড়ু, জেলা যুবদলের কাজী আব্দুল গফুর, কুষ্টিয়ায় মিথ্যা মামলায় জেলা বিএনপির সহসভাপতি বশিরুল আলম চাঁদসহ ২৫ জনকে আটক করেছে পুলিশ। কুমিল্লার চান্দিনায় বিরোধী দলের ছয় নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। আটককৃতরা হলেন- রমিজ উদ্দিন চেয়ারম্যান, দেলোয়ার হোসেন, সফিকুল ইসলাম, মাজহারুল ইসলাম, ওসমান আলীর ছেলে সফিকুল ইসলাম, ফরিদ উদ্দিন।
বগুড়ার শেরপুরে বিরোধী দলের ১৩ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন- মোঃ মঞ্জুরুল আলম বাপ্পী, আনোয়ার হোসেন, তাইফুর রহমান পাভেল, মোঃ কাওসার, আল আমিন, আশিকুর রহমান আশিক, ইয়াকুব আলী রাঙা, শহিদুল ইসলাম পাশা, ইয়াহিয়া, আব্দুল মুন্নাফ, আব্দুর রউফ বাচ্চু ফকির ও জামায়াত নেতা সামছুল হক, শাহাদত হোসেন। খুলনায় আনিসুর রহমান, আবু হানিফ সুমন, শাহাজী কামাল টিপু ও মোজাম্মেল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গত ৫ নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত ২৫০০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানান তিনি। বিএনপি নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতারের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অবিলম্বে তাদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত বানোয়াট ও অসত্য মামলা প্রত্যাহারসহ নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করেন রিজভী।