একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন। ৮ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণের মধ্য দিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক তফসিল ঘোষণা করবেন।
এবারে প্রথমবারের মতো সংসদ নির্বাচনে সীমিত আকারে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারের প্রস্তুতি রাখছে কমিশন। এজন্য পর্যাপ্ত ইভিএমও প্রস্তুত রয়েছে। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচনে অনলাইনে মনোনয়নপত্র দাখিলের ব্যবস্থাও থাকছে। প্রার্থী রিটার্নিং অফিসারের অফিসে উপস্থিত না হয়েও অনলাইনে তার মনোনয়নপত্র দাখিল করতে পারবেন। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকে ফলাফল গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত শত কাজের ফর্দ ধরে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন। ভোটের ১২ দিন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনসংক্রান্ত পরিপত্র জারি হবে। ভোটের সাত দিন আগে জেলা পর্যায়ে পাঠানো হবে নির্বাচনী সামগ্রী। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের চূড়ান্ত তালিকা পাওয়ার পর ব্যালট পেপার মুদ্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা, রিটার্নিং কর্মকর্তা, মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে সভা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে ‘বিশেষ পর্যালোচনা বৈঠক’ কমিশন নির্ধারণ করবে।
দ্বিতীয় দফা বৈঠক করে সেনাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের ‘টাইমফ্রেম’ নির্ধারণ করা হয়। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনী নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগকে অনুরোধ করবে ইসি। এ ছাড়া ভোটের দিন ফলাফল সংগ্রহ ও পরিবেশনের পর দিন কেন্দ্রভিত্তিক ফল একীভূত করা হবে। নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন শেষে ভোটের দুই দিন পর নির্বাচিতদের গেজেট প্রকাশ এবং তিন দিন পর সংসদ সচিবালয়ে তা পাঠানোর কর্মপরিকল্পনা করা হয়েছে।
ইসির কর্মকর্তারা বলেন, ভোটার তালিকা, ভোট কেন্দ্র, নির্বাচনী সামগ্রী প্রস্তুতসহ সব কাজ শেষ। মাঠের সার্বিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক। কোথায়, কীভাবে নির্বাচনী সামগ্রী নেওয়া হবে, সে বিষয়ও ঠিক করা হয়েছে। এ ছাড়া আজকালের মধ্যে মনোনয়নপত্র দাখিলসহ সংশ্লিষ্ট ফরম-প্যাকেটসহ প্রয়োজনীয় দ্রব্য মাঠপর্যায়ে পাঠানো হবে। নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত ম্যানুয়েল রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দ্রুত পাঠানো হবে। ভোট গ্রহণ কর্মকর্তার প্যানেল প্রস্তুত করে ৮ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন কমিশনে পাঠানোর জন্য মাঠ কর্মকর্তাদের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য দুর্গম, স্পর্শকাতর নিবাচনী এলাকায় হেলিকপ্টারে নির্বাচনী মালামাল পরিবহন এবং ভোট গ্রহণ কর্মকর্তাদের আনা-নেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ৮ নভেম্বর তফসিল ও ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট করার সব প্রস্তুতি রয়েছে নির্বাচন কমিশনের। ৮ নভেম্বর সকালে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে ভোটের তারিখ চূড়ান্ত করা হবে।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার যুগ্মসচিব ফরহাদ আহাম্মদ খান জানান, তফসিল ঘোষণার আগে ২২টি খাতে ১০৩টি কাজ সাজানো হয়েছে, যাতে তফসিল ঘোষণার পরই সব কাজ দ্রুততম সময়ে করা সম্ভব হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সব কাজ শেষ হয়েছে। এ কর্মকর্তা জানান, তফসিল ঘোষণার পর ৯৯টি কাজ নিয়ে ‘কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নসূচি’ রাখা হয়েছে। সূত্র জানিয়েছে, এবারে বিজয় দিবসের পরে ভোট হতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২০ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বা ২৩ ডিসেম্বর রবিবার ভোটের তারিখ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ২২ ডিসেম্বর শনিবার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও ইসি কর্মকর্তাদের চিন্তায় রয়েছে। ইসির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, ১৮, ১৯, ২০ ও ২২, ২৩ ও ২৭ ডিসেম্বর ভোটের চিন্তা করা হচ্ছে। তবে ৮ নভেম্বর সকালে আবার কমিশন সভা হবে, সভায় ভোটের তারিখ চূড়ান্ত হবে।
ফল গেজেটে প্রকাশ পর্যন্ত ৯৯ কাজ : তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনী সময়সূচি ও রিটার্নিং অফিসার নিয়োগসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারির মধ্য দিয়ে কাজ শুরু হবে। নির্বাচনকাজে সহায়তায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে চিঠি; ইসির অধীনে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ফল ঘোষণা পর্যন্ত বদলি না করা; স্থানীয় সরকারের সহায়তা; আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশনা; মনোনয়নপত্র বাছাইয়ে ঋণখেলাপিরর তথ্য পেতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে চিঠি তফসিল ঘোষণার দিনই পাঠাবে। মনোনয়নপত্র দাখিল, প্রাসঙ্গিক তথ্য, প্রার্থীর তালিকা, রাজনৈতিক দল, জোট গঠন নিয়ে পরিপত্র ও বিজ্ঞপ্তি জারি করা হবে। তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা, স্বতন্ত্র প্রার্থিতা, হলফনামা, নানা ধরনের কমিটি গঠন বিষয়ে পর্যায়ক্রমে ভোট পর্যন্ত ১৮ ধরনের পরিপত্র জারি ও বেশকিছু নির্দেশনা দেবে ইসি। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক বৈঠক, ব্যালট পেপার মুদ্রণ, নির্বাচনী মালামাল পাঠানোর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা থাকবে। ভোটের ১২ দিন আগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েনসংক্রান্ত পরিপত্র জারি হবে। ভোটের সাত দিন আগে জেলা পর্যায়ে পাঠানো হবে নির্বাচনী সামগ্রী। ভোটের দিন ইসি সচিবালয় পরিস্থিতি প্রতিবেদন, ফল প্রকাশ ও একীভূত ফল জানাবে। ভোটের দুই দিন পর ইসি ফল অনুমোদন করে নির্বাচিত ব্যক্তির নাম-ঠিকানা গেজেটে প্রকাশে প্রেসে পাঠাবে। ভোটের তিন দিন পর গেজেট সংসদ সচিবালয়ে যাবে।
৪৫ দিন সময় রেখে তফসিল : সাধারণ তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট পর্যন্ত ৪০-৪৫ দিন সময় লাগে। সর্বশেষ দশম সংসদ নির্বাচনে ৪২ দিন সময় রেখে ভোটের তফসিল হয়েছিল। একাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিলে ৪৫ দিন সময়কে ‘স্ট্যান্ডার্ড’ মেনে ভোটের সময়সূচি ঘোষণা করা হচ্ছে বলে জানান নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন চৌধুরী। তবে মনোনয়নপত্র দাখিল, বাছাই, প্রত্যাহার ও ভোটের তারিখ ৮ নভেম্বরই তফসিলে চূড়ান্ত হবে বলে জানান তিনি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শাহাদাত হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আপনারা জানেন, একটা স্ট্যান্ডার্ড সময় লাগে। তা ৪৫ দিনের কাছাকাছি। ’ সে ক্ষেত্রে ১৯-২০ (বুধ-বৃহস্পতি) ডিসেম্বরের কাছাকাছি ভোটের ইঙ্গিত দেন এই নির্বাচন কমিশনার।
কখন ভোট : ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করা হলে ৪০ দিনের সময় শুরু হবে ১৭ ডিসেম্বর। ১৬ ডিসেম্বরের পর ১৭-২০ (সোম-বৃহস্পতি) ডিসেম্বর পর ১৭-২০ (সোম-বৃহস্পতি) ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় রয়েছে ৪০-৪৩ দিন। ২১ ও ২২ ডিসেম্বর শুক্র ও শনিবার রয়েছে। ২৩ ডিসেম্বর থেকে ৪৬ দিন হবে। ২৫ ডিসেম্বর বড়দিন। সে ক্ষেত্রে রবিবার থেকে বৃহস্পতিবার ২৩, ২৪, ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর রয়েছে। ৪৯ দিন সময় দিতে হবে ২৭ ডিসেম্বরে ভোটের জন্য। ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর শুক্র ও শনিবার বাদে ভোটের তারিখ ৩০ ও ৩১ ডিসেম্বরে গেলে ৫০-৫১ দিন সময় দিতে হবে কমিশনকে।