এ জগতে এমন কোনও মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে যার মাতৃভাষা বলে কিছু নেই?
ব্যাপারটা নিয়ে অনেক ভেবেছে জসীমউদ্দীন। ভেবে দেখেছে- মাতৃভাষা নেই, তাই হয় কখনও? মা থাকলেই মাতৃগর্ভ থাকবে, মাতৃস্তন্য থাকবে আর মাতৃভাষা থাকবে না? মাতৃভাষা মানে তো সহজ কথায় মায়ের মুখের ভাষা! সে ভাষার না থাক উজ্জ্বল বর্ণমালা, তবু ভাষা বলে কথা। জসীমউদ্দীন অনেক ভেবে দেখেছে, তার মাতৃভাষার কী-যে নাম সেটাই বা কে বলবে! মানুষের যেমন নাম থাকে, ভাষারও তা থাকে বই কী!এই যেমন তার মায়ের নাম যে নয়নতারা এটা সে ভালোই জানে, কিন্তু তার মা কি জানে- যে তার একমাত্র সন্তানের নাম জসীমউদ্দীন? বাংলা ভাষার কীর্তিমান এক কবির নামে তার নামটা কে যে রেখেছিল! আহা, মা যদি নাম ধরে ডাকতে না পারে তাহলে আর কী সার্থকতা সেই নামের!
নয়নতারার মুখে একেবারে মোটেই ভাষা নেই, এমন তো নয়! তার বাগযন্ত্রে উচ্চারিত ধ্বনিপুঞ্জ সাধারণ কোনও অর্থ বহন করে না। লোকে বলে বোবা, গোঙা। অথচ জন্মের পর থেকে জসীমউদ্দীনের তেমন বিশেষ অসুবিধা হয়নি। অথবা বলা যায়- তার মা ভাষার সংকটটা বুঝতেই দেয়নি। কী এক অসামান্য যাদুবাস্তবতার চাদরে নিপুণ হাতে ঢেকে রেখেছে ভাষার দূরত্ব। কণ্ঠ ছেড়ে মা বলে ডাকলেই হলো, অমনি সে দু’হাতে আঁকড়ে ধরে সন্তানের মুখ; সারা মুখে হাত বুলিয়েই যেনবা সে বুঝে নেয় সন্তানের ভাষা। এভাবেই দিব্যি চলে এসেছে এতোটা বছর।
জসীমউদ্দীন বড় হতে হতে জেনেছে- সব ক্ষেত্রেই তার মায়ের মধ্যে ক্রিয়াশীল থাকে পরস্পরবিরোধী দুটি সত্তা। একটি উন্মোচিত হলে অপরটি থাকে ঘুমন্ত, নিষ্ক্রিয়। দৃশ্যমানতার অধিক কী এক আশ্চর্য ছুরি বুঝিবা নয়নতারার অতি সাধারণ আটপৌরে জীবনটাকেই দু’ভাগ করে দিয়েছে। বাকহীনতার কারণে সে হয়তো কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারে না কখনও, কিন্তু নিজের বুঝের জায়গাটা নিশ্চয় নিজের মতো করে গড়ে পিঠে নিয়েছে। কাঁচা আটার রুটি বানিয়ে একপিঠ সেঁকে নেবার পর যেমন করে অপর পিঠ স্যাঁকার আয়োজন করা হয়, তর এই অমসৃণ জীবন অনেকটা সেই রকম। মায়ের মুখ থেকে সরাসরি কিছুই শুনতে পায়নি বটে, তবু বেড়ে ওঠার কালে গ্রামের দু’দশজনের তাচ্ছিল্যভরা কানাঘুষা থেকে জসীমউদ্দীন বেশ বুঝতে পেরেছে- তার মায়ের জীবনে এখন চলছে দ্বিতীয় পৃষ্ঠা অতিবাহনের কাল এবং সে নিজে এই কালেরই কুণ্ঠিত ফসল।
দুই.
আজ তিনদিন ধরে জসীমউদ্দীনের খুব মন খারাপ। বাইরে নির্মেঘ আকাশে ঝলমলের রোদের আলো। অথচ তার বুকের মধ্যে শ্রাবণ মেঘের আঁধার, জলভারানত মেঘ নুয়ে আছে তিনদিন থেকে। কেন, কী হয়েছে তার? সে কথা কাউকে বলবে না। ক্যাম্পাসে যাবে না। লাইব্রেরিতে যাবে না। এমন কি শাহ্বাগ চত্বরে এত যে উত্তাল তরঙ্গ উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ছে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, ভার্সিটির প্রতিটি হল থেকে ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে পড়েছে পিঁপড়ের সারির মতো; জসীমউদ্দীন তবু নির্বিকার, অন্ধকারের বাদুড় হয়ে ঘরের মধ্যে বসে আছে নিজের হলে। রুমমেট শিহাব পাষাণ টলাতে না পেরে দুদিন আগে সেই যে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে, হলে ফেরার আর নাম নেই। জসীমউদ্দীনের কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। হল থেকেই শুনতে পায় শাহবাগের সমুদ্র-উচ্ছ্বাস। কান পেতে শোনে। কল্পনায় একা একা কী যে জাল বোনে, সে-ই জানে। সারা শরীর শিউরে ওঠে শাহবাগের কলজে ছেঁড়া স্লোগানে। তবু সে স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে পড়ে থাকে নিজের রুমে। শাহবাদ মোটেই দূরে নয় জসীমউদ্দীন-হল থেকে। বলতে গেলে এক লাফেই শাহবাগ। কিন্তু কোথা থেকে কী যে দশা হয়ে গেল তার, নিজের হাত-পা সব যেন অথর্ব, অসাড়, কথা শোনে না একটুও। এমন কি গলার স্বর পর্যন্ত স্ফুট হতে চায় না। সে তো তার মায়ের মতো নির্বাক নয়, তাহলে!
পরপর তিন রাতের একই সময়ে জসীমউদ্দীন তার গর্ভধারিনী মাকে দেখতে পাচ্ছে স্বপ্নে। না না রাত্রি কোথায়, সেটা হচ্ছে আলো না ফোটা ভোরবেলা, হতে পারে তার নাম প্রত্যুষ। প্রতিদিন সেই প্রত্যুষে তার মা আসে দু’হাতে কুয়াশা ঠেলে রাতের ঘোমটা ফেলে, একেবারে মেঘ-থমথমে মুখে। মাত্র একবার মা বলে ডাকতেই সেই মেঘ রাবণজলের ধারা হয়ে নেমে আসে তার চোখে। বাপরে বাপ, সে কী বাঁধভাঙা কান্না! এ কান্নার কোনও অর্থ বোঝে না জসীমউদ্দীন। বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে কত প্রশ্ন করে মাকে, মা যেন তার কিছুই শোনে না। বোবা মানুষ বধির হয় সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার মায়ের ক্ষেত্রেও কি সেটা ঠিক! আশৈশব মা বলে ডাকলেই সে সাড়া পেয়েছে। মনেই হয়নি সে শুনতে পায় না। জসীমউদ্দীন আরও যা যা বলে যেনবা তার মা সবই শোনে, মুখে ভাষা নেই বলে হয়তো বলতে পারে না কিছুই, কিন্তু বোঝে সবই। বোঝে এবং নিজের বুঝমতো প্রতিক্রিয়াও জানায়। জসীমউদ্দীনের তাতেই বেশ চলে যায়। এতদিন এমনই হয়েছে। কিন্তু পরপর তিন রাতের স্বপ্নে এটা কী হচ্ছে? কী হয়েছে তার মায়ের? কান্নার অধিক আর কিছুই বুঝাতে পারে না। কেবলই কাঁদে আর কাঁদে।
সবার চেয়ে জসীমউদ্দীন বরাবরই একটু আলাদা স্বভাবের। মিতবাক মানুষ, নিরন্তর নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। বোঝে যতোখানি, বলে তার চেয়ে অনেক কম। আশৈশব অন্তর্মুখী, সাত চড়ে রা নেই। বয়সে অনেক বড় বৈমাত্রেয় ভাইয়েরা বলে- বোবার ব্যাটার মুখে আবার রা কিসের? বোবা হয়নি, সেই তো অনেক!
জমিজায়গা নিয়ে বিরোধের কোনও সুযোগ রেখে যায়নি জুব্বার হাজি। হোক দুই পক্ষ, তবু এ-পক্ষ ও-পক্ষের ছেলেমেয়েদের মধ্যে সহায়সম্পত্তি বিধি মোতাবেক বিলিবণ্টন করে বুঝিয়ে দিয়েছে মৃত্যুর আগেই। জসীম তখন খুবই ছোট, বিষয়-বৈভবের কিছুই বোঝে না; তবু শুনতে পায়- তার মা নয়নতারাকে নাকি অন্যায্যভাবে তিন বিঘে জমি বেশি দেয়া হয়েছে। তাই নিয়ে জুব্বার হাজির মৃত্যুর পর নয়নতারাকে ঘিরে কত যে শ্রবণঅযোগ্য নোংরা কথা রটিয়েছে বড় তিনভাই, উহ্! সে সব শুনলে সুস্থ মানুষের কানও বধির হওয়া অসম্ভভ নয়; আকাশের দিকে থুতু ছুঁড়লে সে থুতু কোথায় ফিরে আসে, সেটা জানা থাকা সত্ত্বেও তারা তা-ই করে। এমন কি পুত্রতুল্য ছোটভাই জসীমউদ্দীনের জন্মরহস্য নিয়েও কী যে জঘন্য কুৎসা রটায়, তা শুনে মরা মানুষেরও গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার কথা।
বোবা নয়নতারা প্রতিবাদ করবে কী, শিশু জসীমকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায়। জসীম বড় হতে হতে এ সব কদর্য কথাবার্তার খানিক বোঝে, নির্বাক মায়ের চোখে চোখ রেখে বাকিটা বুঝার আশা জলাঞ্জলি দেয়। কুৎসিত কটাক্ষের কাঁটায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হতে বেড়ে ওঠে জসীম। লেখাপড়ায় বরাবরই মাথা ভালো। গ্রামের স্কুল, জেলা শহরের কলেজ পেরিয়ে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসে। এটাও বোধ হয় বৈমাত্রেয় ভাইদের গাত্রদাহের অন্যতম কারণ হয়ে থাকবে। নিজেদের ছেলেমেয়েরা কেউ স্কুলের গণ্ডি পেরোয়নি। ফলে একই পিতার কনিষ্ঠ সন্তানের উচ্চশিক্ষা লাভের ব্যাপারটা প্রথমে ‘গোবরে পদ্ম ফুল’ বলে চিহ্নিত করলেও অচিরেই বুঝতে পারে এটাও এক রকম প্রশংসা করাই হয়ে যাচ্ছে। এটা তো করা যাবে না কিছুতেই। তাই হুল মাখানো বিষাক্ত তীর ছুঁড়তেই হয়। বড় ভাই প্রকাশ্যেই বলে ফ্যালে- জন্মের টিক নেই, তার বিদ্যের জাহাজ দিয়ে কী হবে, এ্যাঁ?
অনেকেই চমকে ওঠে- বলে কী লোকটা! তার দেহে যেমন জুব্বার হাজির রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে, জসীমউদ্দীনের দেহেও তো একই ধারা বইছে!
বড় ভাই জমিরুদ্দীন নির্লজ্জ অট্টহাস্যে চারপাশ কাঁপিয়ে প্রকাশ করে কালিমাখা চিত্র। বেপরোয়া হাসির লাগাম টেনে সে বলে, বাদ দাও বাপ রক্তের ধারা ফারা, নয়নতারার চরিত্রটা দেখতে হবে না?
বয়সে কিঞ্চিৎ ছোট হলেও নয়নতারা তার বাবার বিবাহিতা স্ত্রী। জুব্বার হাজির জীবদ্দশাতেই এ-সম্পর্কের মর্যাদা সে দেয়নি, কুড়ি বছর পর তার মুকে হাত দেবে কে! মনের আনন্দে সে উগ্রে দেয় হলাহল, ওই বেওয়ারিশ মেয়েছেলে কোন গাছের বীজ কোন মাঠে বোনে তার ঠিক আছে? খানসেনাদের বীজ সে ফেলল কোথায় বলো দেখি!
এসব কাসুন্দি শুনতে শুনতে শ্রোতাদেরও কানমুখ লাল হয়ে যায়। কেউবা মুখে তালা এঁটে মাথা নামিয়ে নেয়। জমিরুদ্দীনের দ্বিধা নেই, সংকোচ নেই, কাদাপাঁক ঘাটাঘাটিতে তার ক্লান্তি নেই, সে অবলীলায় বলে যায়- আমার তো দিব্যি মনে আছে, আর্মি ক্যাম্প থেকে যখন সে বেরিয়ে আসে, তখন তার পাঁচ-সাত মাসের গর্ভ। কোথায় গেল সেই খান-সেনাদের আবর্জনা?
খুব নিকট থেকেই কে যেন লাজ-শরমের মাথা খেয়ে স্মরণ করিয়ে দেয়, আপনি থামেন তো বড় মিয়া! আপনার আব্বা তো এ সব জেনেশুনেই ওই মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। ধর্মমতে জসীমউদ্দীন আপনার বৈমাত্রেয় ছোটভাই।
হ্যাঁ, আমার অথর্ব অক্ষম জঈফ বাপের নাম ভাঙিয়েই তো চলছে। দেখি কদ্দূর যায়!
এই একটা প্রসঙ্গ নিয়ে বাড়ির মহিলামহলেও ঘোরতর কানাঘুষা চলে দীর্ঘদিন ধরে। স্ত্রী-বিয়োগেরও বছর দুই পর জুব্বার হাজি একেবারে নিজপছন্দে নয়নতারাকে বিয়ে করে ফেললে এ সংসারে দপ্ করে আগুন জ্বলে ওঠে। সমাজে নানান মুখরোচক কেচ্ছা মুখে মুখে রচিত হয়, ডালপালার বিস্তার হয়। কত কথা, কত কাহিনি!
তিন.
গরিবের মেয়ে নয়নতারা সুন্দরী বলেই অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। এমন রূপসী বউ ঘরে রেখে ক’জনই বা যুদ্ধে যায়! আফজাল গিয়েছিল। যুদ্ধের মধ্যে দুতিনবার সে বাড়িও আসে। শেষবারে তো নয়নতারা বুক দিয়ে পথ আগলে দাঁড়ায়, তবু পারে নি তাকে রুখতে! দেশের উপরে হিংসে হয়। দেশই তার চেয়ে বড় হলো! কে জানত- একদিন এই দেশের জন্যেই তাকে সব হারাতে হবে! স্বামী মুক্তিযুদ্ধে গেছে এই অপরাধে স্থানীয় রাজাকাররা নয়নতারাকে তুলে দিয়েছে পাকিস্তানি আর্মিক্যাম্পে। যুদ্ধশেষে আফজালের ঘরে ফেরা হয়নি। আর্মিক্যাম্প থেকে বিধ্বস্ত শরীরে বেরিয়ে আসার পর নয়নতারা আর ঘর খুঁজে পায় না। আফজালের এক সহযোদ্ধা বন্ধু খুব আহা-উহু করে, একদা ঘরের স্বপ্ন দেখায়; শেষ পর্যন্ত অভিভাবকের নিষেধের তর্জনীর মুখে গোপাল অতি সুবোধ বালক হয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।
জুব্বার হাজি মোটেই তেমনটি করেনি। শতেক রকম প্রতিকূলতা অতিক্রম করে জীবনের পড়ন্ত বেলায় নয়নতারাকে বিয়ে করে ঘরে তুলে আনে। ঘর আলোকিত হয়। এই আলোটুকু জুব্বার হাজির খুব প্রয়োজন ছিল। স্বাধীনতার পর অন্ধকার আত্মগোপনে যখন দম বন্ধ হবার উপক্রমপ্রায়, ঠিক তখনই দেশের রাজা হ্যামিলনের বাঁশিঅলা হয়ে বাঁশিতে ফুঁ দিতেই মাটির তলা থেকে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসে ইঁদুরের দল। অমা, বছর না ঘুরতেই জুব্বার হাজির স্ত্রী বিয়োগ, ঘরে অন্ধকার। আরও দু’বছর পর নয়নতারা এসে সেই ঘরে পুনর্বার আলো জ্বালিয়ে দেয়। বোবা-মানুষ, কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারে না নয়নতারা, তবু বাড়ির বৌ-ঝিয়েরা তাকে নিয়ে মেতে ওঠে রঙ্গরসে; তাদের শ্বশুরের শারীরিক সক্ষমতা নিয়ে নির্মম এবং স্থুল রসিকতা করে। বছরের পর বছর শস্যহীন নিষ্ফলা মাঠ দেখে তারা আপন আপন স্বামীকে আশ্বস্ত করে, আর যা-ই হোক পৈত্রিক সম্পত্তির ভাগীদার আসছে না। তেলপড়া, পানি-পড়া চলছে চলুক, এদিকে বেলা ডুবতে আর বাঁকি নেই।
আরও পাঁচ সাত বছর পর সহসা একদিন অস্তরাগের প্রগাঢ় আলোয় সবার চোখ ধাঁধিয়ে যায়। নয়নতারা গর্ভবতী হয়। সন্দেহের ঘুনপোকা কুটুশ কুটুশ করে কেটে দেয় সংসারের সুতো। গোড়া থেকেই চর্চা হয় কানাঘুষা, ফিসফাস- এ কর্ম হলো কী করে! বলতে বলতে কেউ কেউ বলেই ফ্যালে- এ নিশ্চয় কাকের বাসায় কোকিলের ছা। মানুষ তো ধোঁয়া দেখলে আগুন খোঁজে, আলোকলতার মূলও খোঁজে! আর এখানে তো কৌতূহলের পালে হাওয়া দেয়া হয় বাড়ির ভেতর থেকে, ফলে দোকানে-মাচানে পর্যন্ত রগড়ের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়- এ কাজ হলো কী করে! শেষমেশ কে একজন নাতি সম্পর্কের মানুষ এ সংশয়ের কথা জুব্বার হাজির কানে তুললে প্রথমে হা হা করে সে হাসে, তারপর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলে- মর্দানি দেখিস তো যা, বাড়ি থেকে নাত-বৌকে নিয়ে আয়। সে বুঝবে ঠেলা।
এ নিয়ে বাইরে যতোই হাসি তামাশা হোক না কেন জুব্বার হাজির বাড়ির ভেতর মহলে খুবই গুরুতর আলোচনা শুরু হয়ে যায় বিষয়সম্পত্তি নিয়ে, ভাগ তাহলে দিতেই হবে! বুদ্ধি আঁটে নানান রকম। শেষে জসীমউদ্দীন ভুমিষ্ঠ হবার পর তিন ভাই মিলে শেষ বোমাটিও ফাটিয়ে দেয়- এ সন্তান জুব্বার হাজির ঔরসের নয়।
জুব্বার হাজি শাসিয়ে দেয়, সব সম্পত্তি এই নাবালককে দিয়ে দেব।
ব্যাস, তিন পুত্রই তখন গৃহপালিত সারমেয় হয়ে যায়, বাবার পাশে বসে লেজ নাড়ে এবং শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চেয়ে উঠে আসে। জসীমউদ্দীন বড় হতে হতে এসবই শুনেছে, কিন্তু কোথাও কোনও মন্তব্য করেনি। প্রবল শ্রদ্ধা জেগেছে জুব্বার হাজি নামের লোকটির প্রতি; নিজের জন্মের জন্যে তো বটেই, তার মায়ের পায়ের তলে দাঁড়াবার মাটি জুটিয়ে দিয়েছে এই কারণে। নাহ্, জসীমও দীর্ঘদিন পায়নি এই মানুষটির স্নেহ। মাতা-পুত্রের অস্তিত্বের শেকড়ে দু’আঁজলা মাটি দিয়ে সে চলে গেছে অচেনা অন্যজগতে। জসীমউদ্দীন অতি শৈশবে দেখা বাবার সে ছবি একুশ বছর পর আর মনে করতে পারে না। তার স্মৃতির চরাচরে শুধুই মায়ের অস্তিত্ব।
চার.
সামনের মাসে ফাইনাল পরীক্ষা জসীমের। রেজাল্টের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হলে প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। আর সেই কারণে সে নিজে থেকেই নিজেকে নিঃসঙ্গ করে রেখেছে। কিন্তু পর পর তিন রাতের স্বপ্নে ক্রন্দনরত জননীর উদ্বেগাকুল চোখমুখ এবং অন্যদিকে শাহবাগের তরুণ প্রজন্মের আকাশসমান উত্তোলিত প্রত্যাশার হাত জসীমউদ্দীনের ভেতর-বাহিন ওলোট-পালট করে দেয়। কখনো বা মায়ের কান্না তাকে সংক্রমিত করে। একা একা প্রাণ খুলে কাঁদে। তথাপি তার বুকের পাথর যেন নড়ে না, চড়ে না। কোথায় এই কালো পাথরের অস্তিত সেটা নির্ণয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু কোথায় সেই অনড় পাথর! এ পাথরকে কতটুকুই বা চেনে সে! কতটুকু?
জসীমউদ্দীনের হঠাৎ ভাবনা হয়- তার মায়ের জীবনে প্রথম যে পুরুষটি এসেছিল নারীত্বের দুয়ার খুলতে, সে শুনেছে তার নাম শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন। এই অদেখা মানুষটির সঙ্গে কি তার কোনই সম্পর্ক নেই? সামাজিক পরিচয়ের ফ্রেমে কি বাঁধা যায় সেই অসামান্য সম্পর্ক? কী জানি কেন মনে পড়ে এই সম্পর্ক! শাহবাগে যারা কল্লোলিত সমুদ্র রচনা করেছে, তাদের সবাইকেই প্রায় চেনে জসীম; ওদের আড়ালে কি শহীদ আফজালের দীর্ঘায়িত ছায়াও দাঁড়িয়ে নেই? নাহ্, আর দেরি নয়, আগামীকাল আলো ফোটার আগেই সে শুভ্র সমুজ্জল প্রত্যুষে সামিল হবে শাহবাগে; প্রথম পুরুষের সম্প্রসারিত হাতের মুঠোয় হাত রেখে নির্ভয়ে দাঁড়াবে।
আহ্! এই সিদ্ধান্ত নিতে পারায়। জসীমউদ্দীনের বুকের ভেতর থেকে জমাটকালো মেঘ পেঁজা তুলো হয়ে উড়ে যায়, সরে যায়। নিজেকে ভীষণ নির্ভার মনে হয়। আর তখনই মায়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখের ছবি উদ্ভাসিত হয় তার চোখের পর্দায়। কে বলে তার মা বাকহীনা বোবা। কান খাড়া করতেই সে যেন শুনতে পায় তার মা তাকে ডাকছে এই যে খোকা, আয় এখানে। এই তো আমি… আয়…।