“কইন্যার চিরল বিরল চুল
তাহার কেশে জবা ফুল—
সেই ফুল পানিতে ফেইলা কইন্যা করলো ভুল!
একটা ছিল সোনার কইন্যা মেঘবরণ কেশ…”
আমার দাদা বাড়ির পুকুর ঘাটে বসে একটা অংক খাতার রুলটানা কাগজে আমাকে উদ্দেশ্য করে এই গান লিখেছিলেন হুমায়ূন।
সেই সময়টায় আমার লম্বা কোঁকড়ানো চুল ছিল।
আমার মা আমার চুলের অসহ্য সব যত্ন করতেন। জোর করে তেল দিয়ে দেয়া.. টকদই, ডিম- (এই ধরনের খাদ্যদ্রব্য টাইপের আরো অনেককিছু) ভর্তা বানায়ে উৎকট গন্ধওয়ালা এক বস্তু তৈরী হতো যা মাথায় দিতে দিতে ধারাবাহিক ‘বকাবকি’র সেশন চালু করতেন আম্মু।
“এখন তো বুঝো না! বুঝবা বুঝবা। যখন পায়ে ধরলেও এগুলো করে দেয়ার কাউকে পাবা না তখন বুঝবা!”
আমার বান্ধবীরা নানান বৈচিত্র্য কেশ কর্তন করতেন আর আমি শুকনো মুখে লোভী লোভী দৃষ্টিতে তাদের পানে চেয়ে ভাবিতাম- “দেখিস! একদিন আমিও…”
বাসায় মিনমিন করে দুইএকবার ছোট করে চুল কাটার শখের কথা বললেই আম্মু ঝাঁঝালো গলায় বলতো- “থাকার মধ্যে আছে তো ঐ চুলগুলোই। ওটাও কেটে ফেলতে চান! যা ইচ্ছা তাই করেন!”
অন্য কিছু বিষয় নিয়ে ‘যা ইচ্ছা তাই’ করলেও কেশ কর্তনের ক্ষেত্রে ‘যা ইচ্ছা তাই’ কোনোদিনই করতে পারিনি। অথচ আমার ছোট ভগ্নীদ্বয় কতবার কতো ঢঙে চুল কাটলেন!
বিবাহের পর ভাবলাম এই সুযোগ। এবার আমার ‘যা ইচ্ছা তাই’ করবো। ওমা… অনুমতি মেললো না! আমি স্বাধীন হইলেও আমার কেশগুচ্ছের মালিকানা নাকি আমার না! হুমায়ূন দেখি আমার মা’এর চেয়ে এক ধাপ উপরে। কর্তন তো অতি দূরের ব্যপার- আমার চুল বাঁধিবারও স্বাধীনতা নাই।
মাঝে সিঁথি করে চুলখানা দুইপাশে দিলেই বলতেন ‘মিশরীয় রাজকন্যা’! আমাকে নিয়ে নুহাশপল্লী যাবার সময় গাড়িতে সলিল চৌধুরীর গান দিয়ে দিতেন—
“শোনো- কোনো একদিন… আকাশ বাতাস জুড়ে রিমঝিম বরষায়… দেখি তোমার চুলের মতো মেঘ সব ছড়ানো… চাঁদের মুখের পাশে জড়ানো… মন হারালো, হারালো, মন হারালো…”
আচ্ছা কেশ নিয়ে এতো গান কবিতা থাকতে হবে কেন! চুলের সাথে মেঘের তুলনা করেন কেন কবিগণ!
“সোনার রেখার মতো- সোনার রিঙের মতো
রোদ যে মেঘের কোলে-
তোমার গালের টোলে রোদ-
তোমার চুলে যে রোদ— মেঘের মতো চুলে…”
(জীবনানন্দ দাশ)
আমার মেঘের মতো চুলগুলোকে ‘যা ইচ্ছা তাই’ করে ফেললাম…