সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের চূড়ান্ত সংখ্যা নির্ধারণের জন্য গত এক বছর ধরে চলছে বাঘ শুমারি।
ক্যামেরা ট্র্যাপিং বা ফাঁদ পেতে ছবি তোলা পদ্ধতির এই গণনা এখন শেষের পথে।
ধারণা করা হচ্ছে আগামী জুন-জুলাই নাগাদ বাংলাদেশের সুন্দরবনে কত বাঘ আছে তার একটা চূড়ান্ত ও যথাযথ সংখ্যা পাওয়া যাবে।
এর আগে সর্বশেষ ২০০৪-০৫ পাগ-মার্ক বা পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে বাঘ শুমারি করা হয়েছিল।
ওই পদ্ধতিতে বাংলাদেশ অংশে ৪৩০টি এবং ভারতীয় অংশে ২৭০টি বাঘ রয়েছে বলে জানা গিয়েছিল।
কিন্তু কর্মকর্তারা এখন বলছেন, সুন্দরবনের জন্য পাগ-মার্ক পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এত বাঘ সুন্দরবনে কোনও সময়েই ছিল না।
ক্যামেরা ট্র্যাপিং
সুন্দরবনের নীলকমল অঞ্চলে একটি সরু খাল ধরে ঘন্টাখানেক এগিয়ে যাওয়ার পর দেখা যায়, একটি গরান গাছ যেটির গোড়ায় লাল রং করা।
এ জায়গাটিতেই বসানো রয়েছে একজোড়া ক্যামেরা।
নির্দিষ্ট স্থানটিতে গাছপালা কেটে ছোট্ট একটা জায়গা পরিষ্কার করা হয়েছে।
বৃত্তাকার জায়গাটির ব্যাস বারো ফুটের মতো।
বাঘ সেজে ক্যামেরা ট্র্যাপিং যন্ত্রের কার্যকরিতা পরীক্ষা করছেন বাঘশুমারি প্রকল্পের একজন কর্মী। পেছনে একটি খুঁটির সাথে ঝোলানো রয়েছে ক্যামেরাটি।
এই বৃত্তের দুপাশে দুটি খুঁটি পোতা এবং একটি বাঘের আনুমানিক উচ্চতায় দুপ্রান্তে দুটি ক্যামেরা মুখোমুখি বসানো। বৃত্তের চারপাশ জাল দিয়ে ঘেরাও করা হয়েছে।
দু’পাশে এমনভাবে দুটি প্রবেশ পথ রাখা হয়েছে যে এই বৃত্তের মধ্যে কোনো কিছু প্রবেশ করলেই তাকে ক্যামেরার সামনে পড়তেই হবে।
বৃত্তের মাঝখানে একটি ছোট্ট পাত্রে রাখা হয়েছে খাবার পানি।
আর একটি কাঠির মাথায় কাপড় বেঁধে তাতে মাখা হয়েছে স্টিংক বম্বের দ্রবণ।
এই দ্রবণ থেকে অতিশয় দুর্গন্ধ বের হচ্ছে, অনেকটা পচা মাংসের মতো। ‘এই দুর্গন্ধই হল ফাঁদের টোপ। বাঘ যেহেতু অতিশয় উৎসুক প্রাণী, সেহেতু এই দুর্গন্ধই তাকে ক্যামেরার সামনে টেনে আনবে’। বলছিলেন খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বা ডিএফও এবং এই বাঘশুমারি কর্মসূচি বাস্তবায়নের অন্যতম কুশীলব জাহিদুল কবির।
এখানে বসানো ক্যামেরাগুলোতে ক্যামোফ্লেজ রং করা।
ফুট-খানেক দীর্ঘ এবং ইঞ্চি-চারেক চওড়ার একটি বাক্সাকার যন্ত্র।
ক্যামেরাগুলো সারাক্ষণই চালু থাকে এবং লেন্সের সামনে কোনো নড়াচড়া ধরা পড়লেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তোলে। ছবিগুলো একটি মেমোরি কার্ডে রক্ষিত হয়।
প্রকল্পের কর্মীরা প্রতি ৫দিন অন্তর এসে ক্যামেরাগুলোর ব্যাটারি বদলে দেন এবং মেমোরি কার্ড খুলে নিয়ে নতুন মেমোরি কার্ড লাগিয়ে দেন।
ছাব্বিশ জনের একটি দল সুন্দরবনের দক্ষিণ ব্লক নীলকমল অঞ্চলের চৌত্রিশটা পয়েন্টে এরকম মোট আটষট্টি টি ক্যামেরা বসিয়ে গত একমাস ধরে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
দক্ষিণ ব্লকের ৬৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে আগামী বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত তারা এভাবে বাঘের ছবি তুলবে।
এর আগে একই ভাবে দক্ষিণ-পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্ব ব্লকের আরও সাতশো বর্গকিলোমিটার এলাকায় বাঘ গণনা শেষ করেছে তারা।
ওই দুটি ব্লকে ত্রিশটির মতো বাঘের অস্তিত্ব তারা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছে।
বাঘের ছবি
জানা যাচ্ছে, গত একমাসে নীলকমলের বিভিন্ন পয়েন্টে কমপক্ষে ত্রিশ বার বাঘের ছবি ধরা পড়েছে। প্রাথমিক বিশ্লেষণ বলছে, নীলকমলের চৌত্রিশটি পয়েন্টে এখন পর্যন্ত ৫-৬টি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। চলতি বছরেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত টাইগার স্টকটেকিং সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১৬ সাল নাগাদ একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতিতে সারা বিশ্বের সব বাঘ গণনার কাজ শেষ করবার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে যে সোয়া ছয় হাজার বর্গকিলোমিটার রয়েছে, তার মধ্যে সাড়ে তেরো’শ বর্গকিলোমিটার অংশকে নমুনা অঞ্চল ধরে এই বাঘ গণনার কাজ চলছে।
পরে প্রাপ্ত তথ্য ও নমুনাকে সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে একটি চূড়ান্ত সংখ্যা নির্ণয় করা হবে।
এরই মধ্যে ভারতীয় অংশে ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ের মাধ্যমে বাঘ গণনার কাজ শেষ হয়ে গেছে।
প্রাথমিক তথ্য বলছে, দেশটিতে সুন্দরবনের যে অংশ রয়েছে তাতে একশ’রও কম বাঘ রয়েছে।
সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মি. কবির বলছেন, বাংলাদেশ অংশের সুন্দরবনে কমবেশি দুইশ’র মতো বাঘ থাকতে পারে।