হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: ফাতেমা বেগম (৪০), নদী সব কিছু কেরে নেয় কিন্তু গরু ছাগল তো নিতে পারে না। বন্যায় সব কিছু ভেসে নিয়ে গেলেও সম্বল হিসাবে থাকে গরু কিংবা ছাগল। যেখানে সেখানে নড়াতে পারা যায়।
এমনকি পোদ্দার বা মহাজনের কাছে বর্গা নিয়ে লালন পালন করা গরুই লালমনিরহাটের তিস্তার উপকূলীয় দ্বীপ চরের নারীদের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল। গরু লালন পালনের পর্যাপ্ত সম্বাবনাময় এসব তিস্তা চরা লের নারীদের গরু কেনার সামর্থ নাই। তবে মহাজনের কাছে বর্গা নেয়া গরু দিয়ে ভরে উঠেছে চরা ল।
দ্বীপ চরের নারীরা জানান, তিস্তা নদীর ভাঙ্গনে সব কিছু হারিয়ে জেগে উঠা দ্বীপ চরে বেঁচে থাকার স্বপ্নে মাথা গোঁজার ঠাঁই করেছেন। তাদের স্বামীরা অন্যের জমিতে দিনমজুরী করে।
কেউ কেউ পরিবার পরিজন রেখে পাড়ি জমিয়েছেন দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে মৌসুমি শ্রমিক হিসেবে। এ সময় তাদের স্ত্রী সন্তানেরা বাড়িতে অনেকটাই বেকার হয়ে বসে থাকেন তার একমাত্র উপার্জনের উপর। সংসারে বাড়তি আয় করতে তারা মূল ভূখন্ডের মহাজনদের অনুনয় বিনয় করে ছোট গরু কিনে নেন। এসব গরু দিনভর চরা লের খোলা মাঠে ঘাস ও লতাপাতা খাইয়ে বড় করে বিক্রি করেন। ক্রয় মুল্যের অতিরিক্ত অংশের দুই ভাগের একভাগ পান তারা। বাকী টাকা চলে যায় মহাজনের পকেটে। এভাবে গরু লালন পালন শেষে বিক্রয় করার পর আবারও ছোট গরু কিনে নেন তারা। এভাবে বসে না থেকে গরু পালনে বাড়তি আয় করছেন চরা লের নারীরা।
আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবর্দ্ধন চরা লে রয়েছে প্রায় তিনশ’ পরিবার।
এসব প্রতিটি পরিবারে বাড়িতে রয়েছে ৩/৪টি করে বর্গা নেয়া গরু। এ চিত্র জেলার সকল দ্বীপ চরে গেলেই চোখে পড়ে। এসব এলাকায় চুরি ডাকাতির কোনো ভয় নেই। ভয় শুধু বন্যা আর নদী ভাঙ্গন শুরু হলেই। বন্যার সময় থৈ থৈ পানিতে মানুষের মত গরু রাখার জায়গা মিলে না এসব দ্বীপ চরে। এ জন্য তিস্তা নদী শাসন করে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে স্থায়ী বসবাসের দীর্ঘ দিনের দাবিও করেছেন তারা। যে কথাগুলো সরকার দলীয় নেতারা আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন হয় না বলে তাদের অভিযোগ।
দ্বীপ চরের বাবু মিয়ার স্ত্রী ফাতেমা বেগম জানান, চরা লে গরু পালনের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু চরা লের বাসিন্দাদের গরু কেনার টাকা নেই। তাই মূল ভূখন্ডের এক আত্মীয়ের কাছ থেকে ৪৮ হাজার টাকা মূল্যে দুইটি ছোট গরু কিনে নিয়েছেন। এক বছর পালন করেছেন। বর্তমানে যার বাজার মুল্য প্রায় লাখ টাকা ছাড়িয়েছে।
ভবিষ্যতে চাষাবাদের জন্য গরুর লাভ্যাংশের অর্ধেক টাকা দিয়ে জমি বন্দক নিবেন বলে জানান। ঘরে যদি চাল থাকে, তাহলে লবন-পেঁয়াজ দিয়েও খাওয়া যায়। তাই তখন পেটের চিন্তা থাকে না বলে যোগ করেন ফাতেমা। ওই চরের আছিয়া বেগম জানান, সকাল হলেই পরিবারের সকলের জন্য খাবার তৈরি করে প্রতিদিন গরু নিয়ে যান চরের মাঠে। তিনি আরও জানান, তাদের নিজেদের গরু কেনার সামর্থ নেই বললেই চলে। অন্যের টাকায় ৪টি ছোট গরু নিয়েছেন আছিয়া বেগম। যা তাকে সারা দিন ব্যস্ত রাখছে। সকালে গরু গুলো মাঠে নিয়ে যাওয়া, দুপুরে ও সন্ধ্যায় বালতি ভরে পানি খাওয়ানো। গত দুই বছরের গরুর লাভ্যাংশে এক মেয়ের বিয়েও দিয়েছেন তিনি। আগামী দুই বছরের মধ্যে গরুর লাভ্যাংশের টাকা দিয়ে মূলভূখন্ডে বাড়ি করার মত দুই তিন শতাংশ জমি কেনার স্বপ্ন আছে তার। ‘দুই দিকে নদী তাই চোর ডাকাতের ভয় নেই। ভয় শুধু যখন বন্যার আর নদী ভাঙ্গন শুরু হয়’ বলেন আছিয়া বেগম।
দ্বীপ চরের বেগম আক্তার জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে জমির দলিলের কাগজপত্র লাগে। তাদের চরের জমি খাস খতিয়ানে হওয়ায় ব্যাংকগুলোও তাদের ঋণ দেন না।
এ ছাড়াও চরের লোকজনকে ঋণ দিতে নারাজ ব্যাংকগুলো। যোগাযোগের সমস্যায় কিস্তি আদায় না হওয়ায় আশংকায় চরের মানুষ ব্যাংক ঋণ থেকে বি ত হচ্ছে। এনজিও’র ঋণে গরু পালন সম্ভব নয়। কেন না তাদের ঋনের কিস্তি পরের সপ্তাহে শুরু হয়। গরুর লাভ আসতে সময় লাগে ৬ মাস থেকে এক বছর। তিনি বলেন, গরিবের কোথাও ভাল নেই, শান্তি নেই। হামার গুলার জন্মই হইছে বড় লোকের গালি খাওয়ার জন্য।
সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ পেলে বর্গা নয় নিজেরা গরু, ছাগল, ভেড়া ও দুগ্ধখামাড় গড়ে তুলে স্বাবলম্বী হয়ে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখতে পারবে চরা লের বাসিন্দারা।
তবে এ জন্য সরকারের উচ্চ মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার অনুরোধ জানিয়েছেন চরাঞ্চলের সুবিধা বঞ্চিত এসব নারীরা।