তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে

Slider লাইফস্টাইল

হাসানুজ্জামান হাসান, লালমনিরহাট: আগে লালমনিরহাট জেলার বিভিন্ন উপজেলা এলাকায় বেশ দেখা যেত। সময়ের বিবর্তন আর পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে আজ আমরা হারাতে বসেছি এ পাখিটি। সেই সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে শিল্পী, স্থপতি ও সামাজিক বন্ধনের কারিগর বাবুই পাখি ও এর বাসা।

তালগাছের কচিপাতা, খড়, ঝাউ ও কাশবনের লতাপাতা দিয়ে উঁচু তালগাছে নিপুণ দক্ষতায় বাসা তৈরি করত বাবুই পাখি। সেই বাসা দেখতে যেমন আকর্ষণীয় তেমনি মজবুত। প্রবল ঝড়েও তাদের বাসা ভেঙে পড়ে না। শক্ত বুননের এ বাসা টেনেও ছেঁড়া যায় না।

বড় আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভারসাম্য রক্ষার জন্য বাসার ভেতরে থাকে কাদার প্রলেপ। বাবুই পাখির অপূর্ব শিল্পশৈলীতে মুগ্ধ হয়ে কবি রজনীকান্ত সেন তাঁর কবিতায় লিখেছিলেন- “বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই। কুঁড়েঘরে থেকে কর শিল্পের বড়াই।

আমি থাকি মহাসুখে অট্টালিকায় পরে।
তুমি কত কষ্ট পাও রোদ বৃষ্টি ঝড়ে।।”

এই অমর কবিতাটি এখন এ দেশে তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে পাঠ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত।

শুধুমাত্র পাঠপুস্তকের কবিতা পড়েই এখনকার শিক্ষার্থীরা বাবুই পাখির শিল্পকর্মের কথা জানতে পারছে। এখন আর চোখে পড়ে না বাবুই পাখি ও ‌এর নিজের তৈরি দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যশৈলী। সরু চিকন পাতা দিয়ে তৈরি বাবুই পাখির বাসা আর দেখা যায় না। দেখা যায় না এর সামাজিক জীবনাচারও।

অভিজ্ঞ মানুষ মাত্রই জানে, বাসা তৈরির পর সঙ্গী খুঁজতে যায় অন্য বাসায়। সঙ্গী পছন্দ হলে স্ত্রী বাবুইকে সাথী বানানোর জন্য কত কিছুই না করে এরা। পুরুষ বাবুই নিজেকে আকর্ষণ করার জন্য খাল-বিল ও ডোবায় ফূর্তি করে, নেচে বেড়ায় গাছের ডালে ডালে। বাসা তৈরির কাজ অর্ধেক হলে কাঙ্ক্ষিত স্ত্রী বাবুইকে সেই বাসা দেখায়। বাসা পছন্দ হলেই কেবল সম্পর্ক তৈরি হয়।

স্ত্রী বাবুই বাসা পছন্দ করলে বাকি কাজ শেষ করতে পুরুষ বাবুইয়ের সময় লাগে চার দিন। স্ত্রী বাবুই পাখির প্রেরণা পেয়ে পুরুষ বাবুই মনের আনন্দে শিল্পসম্মত ও নিপুণভাবে বিরামহীন কাজ করে বাসা তৈরি করে।

বাসার ভেতরে ঠিক মাঝখানে একটি আড়া তৈরি করে, যেখানে পাশাপাশি দুটি পাখি বসে প্রেমালাপসহ নান রকম গল্প করে। তারপর নিদ্রা যায় এ আড়াতেই। কী অপূর্ব বিজ্ঞানসম্মত শিল্প চেতনাবোধ তাদের!

একটা সময় ছিল, একটি তালগাছে ঝুলে থাকত অসংখ্য বাসা। সে দৃশ্য বড়ই নান্দনিক এবং চিত্তাকর্ষক যা চোখে না দেখলে সে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। এসব শিল্পকর্মের ছবি ব্যবহার করে অনেক ক্যালেন্ডার হতো।

অফুরন্ত যৌবনের অধিকারী প্রেমিক বাবুইয়ের যত প্রেমই থাক, প্রেমিকার ডিম দেওয়ার সাথে সাথেই প্রেমিক বাবুই খুঁজতে থাকে আরেক প্রেমিকা।

পুরুষ বাবুই এক মৌসুমে ছয়টি বাসা তৈরি করতে পারে। ধান ঘরে ওঠার মৌসুম হলো বাবুই পাখির প্রজনন সময়। দুধ ধান সংগ্রহ করে স্ত্রী বাবুই বাচ্চাদের খাওয়ায়। এরা তালগাছেই বাসা বাঁধে বেশি। তালগাছ উজাড় হওয়ার কারণে বাবুই পাখি এখন বাধ্য হয় অন্য গাছে বাসা বাঁধছে।

একসময় লালমনিরহাটের প্রতিটি উপজেলার প্রায় সবখানেই দেখা যেত শত শত বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে তালগাছের পাতায় পাতায়। গত শতাব্দীর ৮০র দশকে ফসলে কীটনাশক ব্যবহার করার ফলে কীটনাশকযুক্ত ফসল আর মৃত পোকামাকড় খেয়ে বাবুই পাখি বিলুপ্তি প্রধান কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে গ্রামাঞ্চল থেকে হারিয়ে যেতে বসছে প্রকৃতির এক অপরূপ শিল্পের কারিগর বাবুই পাখি। প্রকৃতির বয়নশিল্পী, স্থপতি এবং সামাজিক বন্ধনের কারিগর নামে সমধিক পরিচিত বাবুই পাখি আর তার বাসা এখন আর চোখে পড়ে না।

ঝাঁকে ঝাঁকে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা এসব বাবুই পাখির বিলুপ্তির প্রধান কারণ হচ্ছে ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশক প্রয়োগ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক শ্রেণির মানুষ অর্থের লোভে বাবুই পাখির বাসা সংগ্রহ করে শহরে ধনীদের কাছে বিক্রি করছে। গাছে গাছে এসব বাসা এখন আর দৃশ্যমান না হলেও শোভা পাচ্ছে শহরে ধনীদের ড্রইং রুমে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *