রাষ্ট্র ও রাজনীতি নিয়ে ভারতে বইছে পরিবর্তনের হাওয়া। ঘুরেফিরে বারবার সামনে আসছে কংগ্রেসের পতন ও বিজেপির উত্থান প্রসঙ্গ। কংগ্রেস এখন ঘুনে খাওয়া দলে পরিণত হয়েছে। তবে এ দলের পিঠে চড়েই ভারত পাড়ি দিয়েছে প্রায় অর্ধশতাব্দী। তাহলে কেন কংগ্রেসের এই জনবিচ্ছিন্নতা? একেক জনের একেক মত। তবে সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে কংগ্রেস ও কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারে গান্ধী পরিবারের একক মাতব্বরি ও ভুল সিদ্ধান্ত।
২০১৪ সালের আগে কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসনামলে অনেক বিদগ্ধ ও জাদরেল রাজনীতিবিদ সরকারের ভেতরে-বাইরে গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বে উঠে এসেছেন। সবশেষ উদাহরণ রাষ্ট্রপতি প্রবণ মুখার্জি। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মন্ত্রিসভায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ছিলেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে কংগ্রেস সরকারের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনও করেছেন। সোনিয়া গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস যখন সরকারে, এই তো ২০১২ সালে, বছর দুয়েক আগের কথা, তিনি হলেন রাষ্ট্রপতি। এতে কোনো সন্দেহ নেই, প্রবণ মুখার্জি এ পদের যোগ্য। তবে গান্ধী পরিবারের আশীর্বাদ ছাড়া তিনি রাষ্ট্রের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন না, তা নির্দি¦ধায় বলা যায়।
গান্ধী পরিবারের আস্থাভাজন সেই প্রবণ মুখার্জিই এবার জানালেন ইন্দিরা গান্ধীর ভুল-ভ্রান্তি, অক্ষমতা ও এক হাতে সরকার পরিচালনার গল্প। এ নিয়ে বই লিখেছেন তিনি। বইয়ের নাম ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেইড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স’। বইয়ের নামই বলে দিচ্ছে এতে কী স্থান পেয়েছে।
ইন্দিরা সরকারের বিশ্বস্ত পাত্র হিসেবে নিজের দেখা, শোনা ও গান্ধী পরিবারের সঙ্গে ওঠাবসার যে অভিজ্ঞতা, তার আলোকে অধ্যায় থেকে অধ্যায়ে এগিয়েছে প্রণব মুখার্জির বইটির গল্প। সঙ্গে আছে রাজনীতির সুদীর্ঘ পথে নিজের চড়াই-উৎরাইয়ের কাহিনী। বই সম্পর্কে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘এই বইয়ে আছে টিম টিম করে জ্বলা লন্ঠন হাতে পশ্চিমবঙ্গের এক ব্রাত্য গ্রাম থেকে জাতীয় রাজধানীর ঝাড়বাতির প্রাসাদে পৌঁছানো একটি ছেলের গল্প। এ এক দীর্ঘ পথপরিক্রমা। আরো ভাস্মর হয়েছে কিছু সফলতা, কিছু হতাশা ও মোহমুগ্ধতার দ্বন্দ্ব।’
১৯৭৫ সালের ২৫ জুন ইন্দিরা গান্ধী জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। কিন্তু তা করা হয়েছিল বিশেষ ফরমান (ডিক্রি) জারির মাধ্যমে। প্রবণ মুখার্জি তার বইয়ে লিখেছেন, ‘অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যায়, তা জানতেন না ইন্দিরা গান্ধী।’
একই বছর ১২ জুন নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের দায়ে ইন্দিরা গান্ধীকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য ঘোষণা করেন এলাহাবাদ হাইকোর্ট। সেই সংকটময় পরিস্থিতিতে তখনকার বিরোধী দলগুলোর কাছে জনপ্রিয় নেতা জনতা পার্টির জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে দেশজুড়ে ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতাচ্যুত করার আন্দোলন ফুঁসে উঠছে- গোয়েন্দাদের দেওয়া এমন তথ্যের ভিত্তিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণার উদ্যোগ নেন তিনি।
১৯৭৫ সালের ১২ জুন থেকে ২৫ জুন, জরুরি অবস্থা ঘোষণার আগের এই কদিন ইন্দিরা গান্ধীর ব্যতিব্যস্ততা ও ভুলের ঘোরে ঘুরপাক খাওয়া নিয়ে ‘মিডনাইট ড্রামা’ শিরোনামে একটি অধ্যায় নিজের বইতে লিখেছেন প্রবণ মুখার্জি। এই অধ্যায়ে আরো স্থান পেয়েছে, স্বাধীন ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর অধীনে জরুরি জমানার অন্ধকার দিনগুলোর নানা দিক।
তবে জরুরি অবস্থা জারির আগে যে ব্যক্তির জন্য ইন্দিরা গান্ধী ঘোরের মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেন, সেই ব্যারিস্টার সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ের কথা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মিডনাইট ড্রামা অধ্যায়ে। সিদ্ধার্থ শঙ্কর ছিলেন কংগ্রেসের প্রভাবশালী বাঙালি নেতা ও কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী (১৯৬৭-১৯৭২)। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। অর্থাৎ ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত দুটি সরকারে বেশ সমাদর পেয়েছেন সিদ্ধার্থ।
জরুরি অবস্থা জারির ঠিক আগে কোনো একদিন সকালে সিদ্ধার্থ শঙ্করকে ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে তার সরকারি বাসভবনে ডেকে পাঠান। সিদ্ধার্থ সেখানে গেলে ইন্দিরা বলেন, ‘আইনহীনতা, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের কারণে দেশ গভীর সংকটের মুখে পড়েছে। তা ছাড়া জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে অফিস-আদালত, পুলিশ ও সেনাবাহিনীতে সরকারকে বয়কট করে একটি বিকল্প প্রশাসন গড়ে তোলার তোড়জোড় চলছে।’ এই পরিস্থিতিতে কী করা যেতে পারে, সিদ্ধার্থ শঙ্করের কাছে তা জানতে চান ইন্দিরা গান্ধী। সংকট থেকে উত্তরণে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা ভেবে দেখার জন্য সিদ্ধার্থ শঙ্কর কিছু সময় চান। একই দিন বিকেলে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে এসে সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরামর্শ দেন।
প্রণব মুখার্জি তার বইয়ে লিখেছেন, ‘ইন্দিরা গান্ধী আমাকে বলেছেন, অভ্যন্তরীণ অরাজকতার জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণার সাংবিধানিক বিধি সম্পর্কে আমি অবহিত ছিলাম না। যদিও এর আগে ১৯৭১ সালে ইন্দো-পাক সংর্ঘের সময় (বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে) রাষ্ট্রীয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল।’
১৯৭৭ সালে নির্বাচনে কংগ্রেসের পরাজয়ের পর জনতা পার্টির (জেপি) সরকারের অধীনে জরুরি আমলের অত্যাচার-নিপীড়ন ও হত্যা নিয়ে তদন্তের জন্য বিচারবিভাগীয় কমিটি গঠন করা হয়। বিচারপতি জে সি শাহকে এই কমিটির প্রধান করা হয়। তার নামানুসারে কমিটির নাম হয় শাহ কমিশন। এই কমিশনের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রণব মুখার্জি লিখেছেন, ‘সিদ্ধার্থ শঙ্করের পরামর্শেই ইন্দিরা গান্ধী জরুরি অবস্থা জারি করেন। সেই দিন সিদ্ধার্থকে সঙ্গে নিয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্টের (ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ) সঙ্গে জরুরি অবস্থা নিয়ে আলোচনা করতে যান ইন্দিরা গান্ধী। ইন্দিরার কাছে সব কিছু শোনার পর সংবিধানের ৩৫২ ধারার ‘ভাষা’ সম্পর্কে সিদ্ধার্থ শঙ্করের কাছে জানতে চান রাষ্ট্রপতি। সিদ্ধার্থ ব্যর্থ হন। এরপর ফরমান জারির জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ চান রাষ্ট্রপতি। এভাবেই ২৫ জুন মধ্যরাতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়।’
মিডনাইট ড্রামা অধ্যায়ে সিদ্ধার্থ শঙ্করকে একজন সুযোগ-সন্ধানী ও কুচক্রী মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রবণ মুখার্জি। সব ব্যাপারেই সিদ্ধার্থ সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠনেও তিনি ঘুঁটি চালাতেন। এ ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে নকশালদের উত্থানের জন্যও সিদ্ধার্থের দমন-পিড়নকে দায়ী করেছেন প্রণব।
শাহ কমিশনের প্রতিবেদন পড়ে সিদ্ধার্থ শঙ্করের ‘শুভঙ্করের ফাঁকি’ বুঝতে পারেন ইন্দিরা গান্ধী। তার ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায় ইন্দিরা গান্ধীর। সে সময় একদিন শাহ কমিশনের হলরুমে টকটকে লাল রঙা শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সেখানে হাজির হন সিদ্ধার্থ শঙ্কর। দৌড়ে ইন্দিরার গান্ধীর কাছে গিয়ে বলেন, ‘আপনাকে আজ খুবই সুন্দর লাগছে।’ ইন্দিরা গান্ধী উত্তর দেন, ‘ তবে তা আপনার প্রচেষ্টা ছাড়াই।’
সরকার পরিচালনায় ইন্দিরা গান্ধীর একক সিদ্ধান্তের কথাও তুলে ধরেছেন প্রণব মুখার্জি। মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরে তা বাস্তবায়ন করতে বলতেন তিনি। জরুরি অবস্থা জারির সময়ও তাই করেছিলেন। তবে রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিনের সঙ্গে গোপন চিঠির লেনদেন হতো, যার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে মতবিনিময় করতেন তারা।
তবে ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণাকে মেনে নেয়নি বিশ্বের অধিকাংশ দেশ। সে সময় এ নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধীর ওপর প্রচ- চাপ সৃষ্টি হয়। এমনকি ভারতের সহযোগিতায় সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশও সে সময় ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার ঘোষণা মেনে নেয়নি।
দেশে ও বিদেশে এমন বৈরিতার মুখেও ২৫ মার্চ ১৯৭৫ থেকে ২৪ মার্চ ১৯৭৭ টানা ২১ মাস জরুরি অবস্থার মধ্য দিয়ে সরকার চালিয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। এই সময়ে ইন্দিরার প্রধান বিরোধিতাকারী জয়প্রকাশ নারায়ণসহ অসংখ্য বিরোধী নেতাকে জেলে পুরা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় হত্যা-গণহত্যার অভিযোগ ওঠে। প্রণব মুখার্জি তার বইয়ে এসবের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, জরুরি অবস্থার সময় বিরোধীদের দমনে পরামর্শদাতা হিসেবে প্রণব মুখার্জির নাম আসে শাহ কমিশনের চূড়ান্ত প্রতিবেদনে। তবে ১৯৮০ সালে জনতা পার্টির সরকারের পতন ও ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ফের কংগ্রেস সরকার গঠন করলে শাহ কমিশনের কার্যক্রম চাপা পড়ে যায়। ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর আততায়ীর হাতে ইন্দিরা নিহত হলে, ভারতের রাজনীতি মোড় নেয় নতুন দিকে। সে সবও আছে প্রণব মুখার্জির বইয়ে।
তবে ভারতের ইতিহাসে ‘কালো দিনলিপি’ হিসেবে পরিচিত ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি শাসনামলের অজানা যেসব তথ্য প্রণব মুখার্জি তার বইয়ের মিডনাইট ড্রামা অধ্যায়ে উল্লেখ করেছেন, তা ইতিহাসের পাতায় নতুন আলোর সংযোজন।
ভারতে বিজেপি ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ম্যাজিক্যাল উত্থান ও কংগ্রেস থেকে জনগণের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার বর্তমান বাস্তবতায় রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিবর্তনের যে হাওয়া বইছে, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির আন্তঃদর্শনমূলক ইতিহাস আশ্রীত ‘দ্য ড্রামাটিক ডিকেইড : দ্য ইন্দিরা গান্ধী ইয়ার্স’ বইটি তাতে আরো ইতিবাচক বেগ সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায়।