ঢাকা: এ বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে ১১তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে বাংলাদেশে। অতীতের মতো বেশ কিছু নতুন ও স্থায়ী বিতর্কের মধ্য দিয়ে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অতীতের মতো আরো একবার উচ্চমাত্রায় বিভক্ত, রাজনৈতিক মেরুকরণ ও সহিংসতাপ্রবণ পরিবেশে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির প্রধান বেগম খালেধা জিয়া দুর্নীতির অভিযোগে জেলে রয়েছেন। নির্বাচনের আগে তার মুক্তি পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ অবস্থায় তাকে মুক্তি না দিলে, নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষ অথবা নির্দলীয় তত্ত্বাবধাক সরকার (এনপিসিজি) ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা না হলে, বিএনপি নির্বাচন বর্জনের হুমকি দিয়েছে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার না থাকায়, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো আস্থা না থাকায় ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। এর ফলে যদিও মাত্র শতকরা ৩০ ভাগ ভোটার ভোট দিয়েছেন, তবু ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাদের প্রার্থীরা বিজয়ী হন ১৫০ আসনে।
বিএনপি নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ায় এবং সরকারের ওপর তাদের কোনো প্রভাব না থাকায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ খোলা মাঠ পেয়ে যায়। চীনা ঋণ নিয়ে মেগা প্রকল্পগুলো শুরু করে তারা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জন করে। কিন্তু সরকারকে দেখা গেছে নির্যাতনের ভূমিকায়। গুম, সমালোচকদের গ্রেপ্তার, সন্দেহজনক সন্ত্রাসী ও মাদকের ডিলারদের বিচারবহির্ভূত হত্যা একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে আতঙ্ক বৃদ্ধি পেয়েছে, তৃতীয় দফা ক্ষমতার জন্য ২০১৮ সালের নির্বাচনে জালিয়াতি করতে পারে সরকার।
এর ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জনমনে আস্থা সৃষ্টি করেছে। অতীতের নির্বাচনগুলো হয়েছে এই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে ফেরাতে ‘বিগ ব্রাদার’ ভারত ও পশ্চিমাদের সূক্ষ্ম চাপ রয়েছে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নির্বাচন হবে ‘নির্বাচনকালীন সরকারের’ অধীনে। তবে তিনি এটা বলেননি ওই ‘নির্বাচনকালীন সরকার’ কি নির্দলীয় অথবা দলহীন সরকার। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’ বাইরের কোনো লোক থাকবেন না। অন্য কথায়, নির্বাচনকালীন সরকারে কোনো টেকনোক্র্যাট থাকবেন না। তবে এরও আগে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এমন সরকার হতে পারে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে। ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ওই সরকারে দুই থেকে তিনজন সদস্য রাখার জন্য অনুরোধ করেছে জাতীয় পার্টি। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেননি প্রধানমন্ত্রী।
যখন শেখ হাসিনা ও তার দল নির্বাচনকালীন সরকারের বিষয়ে স্পষ্ট নন, তখন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম ও যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণার আগেই জাতীয় সংসদ ভেঙে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শনিবার। সব দলের সঙ্গে আলোচনার পর নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের আহ্বানও জানানো হয়েছে।
দুটি সংগঠন বলেছে, নির্বাচনকালীন সরকারে যারা থাকবেন তাদের উচিত হবে না নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। সব দলের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় এমনভাবে নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠনের দাবি জানিয়েছে তারা। তারা আরো বলেছে, পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নির্বাচন কমিশনের। নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক মাস আগে থেকে ৪০ দিনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে মোতায়েন করা উচিত সেনাবাহিনীকে। রাজনীতিকের গ্রেপ্তার বন্ধ রাখা উচিত এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনস (ইভিএম) বাতিল করা উচিত।
অতীতের অভিজ্ঞতা
শেখ হাসিনার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুমোদন অপ্রত্যাশিত নয়। এর জন্য অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো, নাগরিক সমাজকে কঠোর লড়াই করতে হয়েছে। প্রাণহানি হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য এটা একটি বিস্তৃত ও অব্যাহত লড়াই।
বাংলাদেশের গণতন্ত্রে প্রথম আঘাত আনা হয় দেশটির জন্মের চার বছর পরে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে। ওই সময় তখনকার প্রেসিডেন্ট ও জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজের বাংলাদেশ ফারমার্স অ্যান্ড লেবারস পিপলস লিগ (যা বাকশাল হিসেবে বেশি পরিচিত) বাদ রেখে সব রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করেন। এ ঘটনায় ১৯৭৫ সালের আগস্টে কিছু সেনা কর্মকর্তা তাকে হত্যা করে। এর ধারাবাহিকতায় ক্ষমতায় আসেন সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরে তিনি গঠন করেন বিএনপি। এর মধ্য দিয়ে তিনি তার শাসনকে বেসামরিক লেবাস দেয়ার চেষ্টা করেন।
১৯৮১ সালে সেনা কর্মকর্তারা তাকেও হত্যা করে। এরপর ক্ষমতায় আসেন জেনারেল এইচএম এরশাদ। নিজের মতো করে তিনিও জাতীয় পার্টি গঠন করে শাসন করতে থাকেন। যদিও জিয়া ও এরশাদ নির্বাচন দিয়েছিলেন, তবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা ছিল না। কারণ, তাদেরকে সমর্থন দিয়েছে সেনারা। ১৯৮৬ সালেই এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে সব রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের আগে এর পক্ষে ব্যাপক সমর্থন পাওয়া যায়। এই লড়াই অব্যাহত ছিল ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, যখন এরশাদ পদত্যাগ করেন।
এরপরে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে গঠন করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ওই সরকার ১৯৯১ সালে ৫ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে। অতীতের তুলনায় এই নির্বাচন ছিল অত্যধিক অবাধ ও সুষ্ঠু। সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয় বিএনপি এবং তারা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট সরকার গঠন করে। কিন্তু তারা মাগুরা উপনির্বাচনে জালিয়াতি করে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি ভবিষ্যতের সব নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার প্রস্তাব করে। এতে সমর্থন দেয় আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি। তবে তার বিরোধিতা করে তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি।
উল্টো তারা নির্বাচন কমিশনকে পুনর্গঠনের প্রস্তাব করে। কিন্তু তা আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। পক্ষান্তরে বিরোধীরা জাতীয় সংসদ অধিবেশন বর্জন করা শুরু করে। আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে। তাদের দাবি, ওই ক্ষমতা হাতবদল করতে হবে প্রধান বিচারপতির কাছে। বিএনপি যখন এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তখন জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন বিরোধী দলের ১৫৩ জন সদস্য। তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান তখনকার স্পিকার। বিরোধীরা তা সত্ত্বেও জাতীয় সংসদ বর্জন অব্যাহত রাখে।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই অনুষ্ঠিত হয় ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এ নির্বাচন বর্জন করে বিরোধীরা। শতকরা মাত্র ১০ ভাগ ভোটার এতে ভোট দেন। তাতে বিএনপি ভালভাবে বিজয়ী হয়। কিন্তু তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই বিজয়ের সুখ নিতে পারেননি। কারণ, তার সরকারের বৈধতার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে বিরোধীরা। একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠায় একটি আইন প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া তখন তার হাতে কোনো বিকল্প ছিল না। পরে তিনি পদত্যাগ করেন। ক্ষমতা হস্তান্তর করেন অপসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকারের হাতে।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করে ২০০১ সালে। ২০০৬ সালের নির্বাচনের জন্য কে এম হাসানকে প্রধান উপদেষ্টা করে পুনর্গঠন করা হয় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কিন্তু তিনি বিএনপির প্রতি অনুগত এমন অভিযোগে কে এম হাসানের বিরোধিতা শুরু করে বিরোধীরা। তারা আবার আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে তখনকার প্রেসিডেন্ট ইয়াজুদ্দিন আহমেদ নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা ঘোষণা করে নিজের মতো করে তার টিম গঠন করেন।
আওয়ামী লীগ আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এর ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. ফখরুদ্দিন আহমেদকে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা হয়। তবে এতে জড়িত ছিলেন সাবেক সেনা প্রধান জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ। জনগণ সেনাসমর্থিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু এই নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। তারা সব রকম রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ করে। নির্ধারিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শিডিউল বাতিল করে দেয়। শুরু করে দুর্নীতি বিরোধী ব্যাপক অভিযান। গ্রেপ্তার করা হয় দুই লাখের বেশি সন্দেহভাজনকে। এর ফলে হাসিনা ও খালেদা যৌথভাবে একটি প্রকৃত নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে লড়াই করতে থাকেন।
নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল
২০০৮ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে হয়েছে। তাতে ভূমিধস বিজয় পায় আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় একবার নিজেদের যখন পাকাপোক্তভাবে বসিয়েছে তখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ২০১১ সালের ১০ই মে একটি রুলিং দেয় সুপ্রিম কোর্ট। সেই রায়ের সুবিধা নেয় আওয়ামী লীগ। তারা বাতিল করে দেয় নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা। আদালত তার রায়ে বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা হলো অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক। কারণ, এই সরকার অনির্বাচিত। ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হন শেখ হাসিনা। সাবেক প্রেসিডেন্ট, একজন আওয়ামী লীগার জিল্লুর রহমান তিক্ত বড়ির ওপর যেন চিনির প্রলেপ লাগানোর চেষ্টা করেন। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হবে। কিন্তু তাতে বরফ বেশি কাটেনি। সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক রিসার্চের এক জনমত জরিপ অনুযায়ী, তারা যত মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছে তার মধ্যে শতকরা ৬৭ ভাগ মানুষ নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরুদ্ধে মত দিয়েছেন।
(শ্রীলংকা থেকে প্রকাশিত অনলাইন ডেইলি মিররে প্রকাশিত মন্তব্য কলামের অনুবাদ)