দুবাইয়ে এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচে শ্রীলঙ্কাকে ২৬২ রানের লক্ষ্য দিয়েছে বাংলাদেশ। ৩ রানে ২ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে উদ্ধার করে মুশফিক-মিঠুনের ১৩১ রানের জুটি। মুশফিক ক্যারিয়ার-সেরা ১৪৪ রান করেছেন। ভাঙা হাত নিয়ে ব্যাটিং করেছেন তামিম। না হলে ২২৯ রানে থেমে যেত বাংলাদেশ
ম্যাচটায় তাঁর খেলা নিয়েই ছিল অনিশ্চয়তা। পাঁজরের ব্যথা বড় ভোগাচ্ছিল। মুশফিকুর রহিম ব্যথাকে উপেক্ষা করেছেন। আরেকজনের এশিয়া কাপ খেলা নিয়ে এখনো সংশয়। তামিম ইকবাল ম্যাচের মাঝপথে চলে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। এশিয়া কাপ হয়তো আর খেলা হবে না, সেই তিনি নেমে পড়লেন এই ম্যাচে আবার! ২২৯ রানে ৯ উইকেট হারানো বাংলাদেশ ক্রিকেট-বিশ্বকে উপহার দিল বিস্ময়। ম্যালকম মার্শালের এক হাতে ব্যাট করতে নামার সেই স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিলেন তামিম ইকবাল। মুশফিক ক্যারিয়ার-সেরা ১৪৪ রান, মিঠুনের ক্যারিয়ার-সেরা ৬৩…এর সঙ্গে থাকল তামিমের ৪ বলে ২ রানের সেরা এক ইনিংস। তাতে ২৬১ রান তুলতে পারল বাংলাদেশ।
গত ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তিন ম্যাচে দুটি সেঞ্চুরি করেছেন। তামিমের এমন অসংখ্য ইনিংস আছে বীরত্বপূর্ণ। কিন্তু ৪ বলে ২ রানের এই ইনিংসটি এক বিবেচনায় তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা হয়ে থাকবে। দলের জন্য আত্মত্যাগের সবচেয়ে বড় উদাহরণগুলোর একটি। নবম ব্যাটসম্যান হিসেবে মোস্তাফিজ যখন ফিরলেন, বাংলাদেশের সংগ্রহটা ছিল মামুলিই। কিন্তু ৩ বলে ২ রান করে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে ফিরে যাওয়া তামিম শেষে আবার ফিরে এলেন। তাতেই বাংলাদেশ যোগ করল আরও ৩২ রান। পুরোটাই মুশফিকের ব্যাটে। তামিম এর মধ্যে মাত্র একটি বল খেলেছেন। এক হাতে ব্যাট করে ডিফেন্ড করেছেন সুরঙ্গা লাকমলের শর্ট পিচ বল।
তাতেই বিপর্যয় থেকে উদ্ধার পাওয়া বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কাকে মানসিকভাবে দিল এক বিরাট ধাক্কা। বিপর্যয়ও কেমন, প্রথম ওভারেই এক বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নামা লাসিথ মালিঙ্গা যেন ক্যারিয়ারের সোনালি দিন ফিরিয়ে আনলেন। প্রথম চার বল ফোঁসফাঁস, পঞ্চম বলে আউট সুইংয়ের বিষ মিশিয়ে স্লিপে মেন্ডিসের ক্যাচ বানিয়ে লিটন দাসকে (০) ফেরালেন। পরের বলটা আরও দুর্দান্ত। বল বাতাসে হালকা সুইং করিয়েছেন। বলটা যতই দুর্দান্ত হোক, মাত্রই উইকেটে আসা সাকিব আল হাসান হয়তো বেঁচে যেতেন, যদি সোজা ব্যাটে খেলতেন।
প্রায় চার বছর পর গোল্ডেন ডাক মারার অভিজ্ঞতা হলো বাঁ-হাতি অলরাউন্ডারের। বিষফাঁড়া হয়ে এল সুরঙ্গা লাকমলের বলে বাঁ-হাতের কবজিতে ব্যথা পেয়ে তামিম ইকবালের মাঠ ছেড়ে যাওয়া। দলকে আরও বিপন্ন চেহারায় রেখে তামিম ছুটলেন হাসপাতালে। ২ ওভারে বাংলাদেশের স্কোরটা ছিল বড় ভীতিজাগানিয়া! ৩ রানে ২ উইকেট (পড়তে হবে ৩ / ৩, তামিমও তো নেই)!
বাংলাদেশ ১০০ রানও করতে পারে কি না, এ সংশয় যখন গাঢ় হচ্ছিল তখন চতুর্থ উইকেটে মুশফিক-মিঠুনের প্রতিরোধ। চাপ এতটাই জেঁকে বসল, বাংলাদেশ স্বচ্ছন্দে এগোতেই পারছিল না। শ্রীলঙ্কা ফিল্ডারদের হাতটা পিচ্ছিল না হলে বাংলাদেশের ভাগ্যে যে কী লেখা হতো! মালিঙ্গার বলেই ম্যাথুস যখন মিঠুনের ক্যাচটা হাতছাড়া করলেন তখন তাঁর রান মাত্র ১। থিসারা পেরেরার বলে স্কয়ার লেগে দিলরুয়ানের হাত গলে মুশফিক যখন বাঁচলেন, তখন তাঁর রান ১০। প্রথম বাউন্ডারি পেতেই বাংলাদেশের লেগে গেল ৪৮ বল। লাকমলকে স্কয়ার লেগ দিয়ে বাউন্ডারি মেরে মুশফিক প্রথম চাপ কাটিয়ে ওঠার বার্তা দিলেন। তবুও প্রথম ১০ ওভারে বাংলাদেশ ২৪ রানের বেশি তুলতে পারেনি।
শুরুর ধাক্কাটা বাংলাদেশ কাটিয়ে উঠল মুশফিক-মিঠুনের সৌজন্যেই। বাংলাদেশের দুই ব্যাটসম্যান খোলস থেকে যত বেরিয়ে আসতে শুরু করলেন, চাপ ততই সরে যেতে থাকল। প্রথম ১০ ওভারে বাংলাদেশের রানরেট যেখানে ২.৪, পরের ১০ ওভারে সেটিই হলো ৭.৮। দুজনের ১৩৯ বলে ১৩১ রানের জুটি বাংলাদেশকে স্বপ্ন দেখাল বড় স্কোর গড়ার। কিন্তু সে স্বপ্ন ধাক্কা খেল মালিঙ্গার বলে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের আত্মাহুতি দেওয়ায়। প্রায় ৭ মাস পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে নামা মিঠুন লঙ্কান পেসারকে তুলে মারতে গিয়ে কিপার কুশল পেরেরার ক্যাচ হলেন ৬৩ রান করে।
মিঠুন তবুও তাঁর কাজটা করেছেন। কিন্তু মাহমুদউল্লাহ আর মোসাদ্দেক কী করলেন? দুজনই স্কোর কার্ডে মাত্র ১টি করে রান যোগ করতে পারলেন। ২ উইকেটে ১৩৪ থেকে চোখের পলকে স্কোর হয়ে গেল ৫ উইকেটে ১৪২। ৮ রানের মধ্যে মিডলঅর্ডারের তিন ভরসা শেষ! মেহেদী মিরাজ এই ভুলের মিছিলে যোগ দেবেন না বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ছড়ানো তাঁর ১৫ রানের ইনিংসটা শেষ হলো লাকমলের দারুণ এক ফিরতি ক্যাচে। ৪১ রানের মধ্যে বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলল ৪ উইকেট।
মুশফিক তবু হাল ছাড়তে রাজি ছিলেন না। ছোট ছোট প্রতিরোধ গড়েই চললেন। প্রথমে মাশরাফিকে নিয়ে। এরপর রুবেল। রুবেল বোকার মতো রিভিউ না নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন বলে তাঁকে ডেকে নিয়ে বকেও দিলেন। রিভিউ নিয়ে রুবেল বাঁচলেও টিকলেন না বেশিক্ষণ। এরপর মোস্তাফিজ। বারবার মোস্তাফিজকে স্ট্রাইক প্রান্তে এনে ভুল করছেন মুশফিক…ভাষ্যকারদের সমালোচনার গলা তখন চড়ছে। এবং ভাষ্যকারদেরই সঠিক প্রমাণ করে ফিজও ফিরলেন। বাংলাদেশ অলআউট ২২৯…লিখতে লিখতে থেমে যেত হলো সাংবাদিকদের। কী ব্যাপার, মুশফিক কেন ফিজের সঙ্গে বেরিয়ে এলেন না?
কারণটা বোঝা গেল। অবাক বিস্ময়ে সবাই আবিষ্কার করল, তামিম এক হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে নেমে পড়ছেন মাঠে!
এই ম্যাচের ফলাফলের জন্য আরও ৫০ ওভারের অপেক্ষা। তবে এই ম্যাচটা নৈতিকভাবে বাংলাদেশ হারবে না, তা এখনই লিখে দেওয়া যায়।