রাত ৮টার পর থেকেই কাকরাইল মোড়ে, রাজমণি সিনেমা হলের বিপরীত পাশে বহুতল ভবনের নিচে মানুষের জটলা বাড়ে। সারিবদ্ধভাবে সাজানো হয় রিকশাও।
এই শহরে কিছু মানুষ থাকে যাদের কোনো আত্মীয় নেই, নেই কোনো আপনজন। যাদের কোনো দাওয়াত থাকে না। যারা কারো মেহমান হতে পারেন না। এইসব মানুষগুলোকে সমাজ আলাদা স্তরে বিভক্ত করে দিয়েছে ‘অসহায়, দুস্থ, ছিন্নমূল মানুষ’ নামে।
সমাজের এই মানুষগুলো সন্ধ্যার পর আসেন তাদের একজন আত্মীয়ের কাছে। সেই আত্মীয় হলেন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট। নিঃস্বার্থভাবে তাদের খাইয়ে মানবিক আত্মীয় হয়ে উঠছেন তিনি।
সন্ধ্যার পর যারাই কাকরাইল দিয়ে যাওয়া আসা করেন, তারা হয়ত অনেকেই এই জটলা, রিকশার সারির সঙ্গে পরিচিত হয়েছেন। আবার নতুন করে দেখলেই ভাববেন হয়ত, অভিজাত এলাকায় রিকশার গ্যারেজ হলো কিভাবে? আবার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছিন্নমূল, ভবঘুরে মানুষের আগমন দেখে ভাবতে পারেন হয়ত আশপাশে বস্তি থেকে তারা এসেছেন।
কিন্তু না, যারা এখানে আসেন, তারা অনেকেই হয়ত দিনে একবার করে ভাত খান আবার কেউ তাও পান না।
শুধু ছিন্নমূল মানুষই না, আসেন প্যান্ট, শার্ট পড়া ‘ভদ্রলোক’ও। এসব ‘ভদ্রলোক’ আসেন মেহমানদারি করার জন্য।
সাড়ে তিন মাস ধরে প্রতিদিন সম্রাটের মেহমানদারী চলে তার সেইসব আত্মীয়দের জন্য। অর্থাভাবে যে মানুষগুলো পেটের ক্ষুধা মেটাতে পারেন না। এই এলাকার সেইসব মানুষগুলো জেনে গেছেন তাদের ১ জন আত্মীয় আছেন। যিনি প্রতিদিন খাবার তৈরি করে তাদের অপেক্ষায় থাকেন।
রিজিকের মালিক আল্লাহ। মানুষ তো শুধু মাধ্যম। তার কাকরাইলে এই অফিসের নিচে মানুষদের ভিড়, জটলা। তিনি কোনো সংসদ সদস্য নন, তারপরও তার প্রতি একটা আবদার, অধিকার নিয়ে সকলে যান।
বুধবার রাতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রিকশা চালকরা সারিবদ্ধভাবে রিকশা রেখে ভাতের থালা হাতে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। এমন একজন ময়মনসিংহের গঁফরগায়ের হাসেম আলী। থাকেন তেজগাঁওয়ে। সারাদিন বিভিন্ন এলাকায় ভাড়া খাটেন। রাত ৯টার আগেই তিনি কাকরাইল, প্রেসক্লাব এলাকার ভাড়া ধরেন। যাত্রী নামিয়ে সোজা চলে আসেন তাদের ‘আপনজন’ সম্রাটের অফিসের নীচে।
তিনি জানালেন, ‘আমি প্রায় দেড় মাস ধরে নিয়মিত খাই। এখানে যে মানের খাবার দেয়া হয়, সেই খাবার কিনে খেতে হলে কমপক্ষে দেড়শ টাকা লাগবে। আমি গরীব মানুষ। দেড়শ টাকা খরচ বাঁচে। ’
তিনি বললেন, দ্যাশে এমন কিছু মানুষ আছে বলেই গরীব-অসহায় মানুষগুলো ভরসা পায়। আল্লাহ যেন তাকে সুস্থ রাখেন এবং মনের আশা পুরণ করেন। ’
কথা হয়, মিলন নামের আরেকজনের সাথে। তিনি জানালেন, থাকি হাইকোর্টের মাজারে। সারাদিন খাওন পাই না। রাতে সম্রাট ভাই খাওন দেন। দিন শেষে পেট পুড়ে ভাত খাই।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা গেল, গরুর মাংস, সাথে সবজি এবং ডাল দিয়ে প্লেটে করে খাবার বেরে দিচ্ছেন যুবলীগের নেতাকর্মীরা। প্রায় হাজার মানুষ এতে সারিবদ্ধভাবে খাবার নিচ্ছেন, আবার খাবার খেয়ে প্লেট ধুয়ে রাখছেন।
কাকরাইলের একাধিক নেতা জানালেন, এই মানুষটা (সম্রাট) কোনো জনপ্রতিনিধি না। জনপ্রতিনিধি না হয়েও নিজ অবস্থান থেকে কিভাবে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করতে হয় সেটাই করে যাচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে সম্রাটের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি সংবাদ প্রকাশে আগ্রহী নন বলে জানান। তবে তার কাছের লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাড়ে তিন মাস ধরে প্রতিদিন এই খাবার রান্না করা হয়। প্রথম দিকে ২০০শ থেকে ৪শ লোক হলেও এখন হাজারের বেশি হয়। এত লোক হলেও তাদের খাওয়ানো কোনো সমস্যা হয় না। সবাই সারিবদ্ধভাবেই খাবার গ্রহণ করেন। এই কার্যক্রম চলমান থাকবে বলেও জানান তারা।