জিয়াউর রহমানের বিচার না করতে পারার যে আক্ষেপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন সে প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. আবদুল হান্নান খান বলেন, ‘দীর্ঘ তদন্ত শেষে আমি তো তার বিরুদ্ধেও চার্জশিট দিয়েছিলাম। কিন্তু বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে চার্জশিট থেকে জিয়ার নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।
শুধু তাই নয়, মাননীয় জজ রায়ের সময় রাজনীতিক ওবায়দুর রহমান, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেমকেও রেহাই দিয়েছেন। বিচারপতি ১৫ আগস্টের নৃশংসতাকে সামরিক বাহিনীর ক্যু হিসেবে মনে করে রায় দিয়েছেন। ‘
বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়কারী আইজিপি পদমর্যাদার হান্নান খান পিপিএম উল্লেখ করেন, ‘এখন আর জিয়াউর রহমানের বিচারের সুযোগ নেই বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় জড়িত হিসেবে। ‘
১১ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা এবং নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার খলিশাপুর ইউনিয়নের খান পাড়ার সন্তান হান্নান খান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলা এবং চলমান মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা তদন্তে সম্পৃক্ত থাকতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবানই মনে করছি। বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত স্পর্শকাতর এসব মামলায় অপরাধীরা দণ্ডিত হয়েছে এবং হচ্ছে, যা প্রতিটি বিবেকসম্পন্ন মানুষের দীর্ঘ প্রত্যাশার প্রতিফলন। ‘
চার্জশিটে বঙ্গবন্ধু হত্যার জন্য জিয়াউর রহমানকেও আসামি করা হয়েছিল। কীভাবে বাদ গেল সে নাম— এমন জিজ্ঞাসার জবাবে ঝানু এই পুলিশ অফিসার বলেন, ‘সেটি ছিল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, হয়তোবা বাস্তবতার কারণে। সে সময়ের প্রবীণ এবং শীর্ষ পর্যায়ের একজন আইনজীবীর পরামর্শে জিয়ার নাম বাদ দিয়ে দ্বিতীয় দফায় নতুন করে চার্জশিট তৈরি করতে হয়েছে। তবে খন্দকার মোশতাকের নাম, মাহবুবুল আলম চাষী, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুরের নাম শেষ পর্যন্ত ছিল আসামির তালিকায়।
কিন্তু মাননীয় বিচারক সে সময়ের আওয়ামী লীগের এই নেতাদের মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন। জাতির জনক হত্যায় সামরিক বাহিনীকেই তিনি টার্গেট করে বিচারকার্য সমাধা করেছেন। ‘
তাহের, মোয়াজ্জেমসহ অন্যদের খালাস দেওয়ার পর সরকারের পক্ষ থেকে আপিল করা হয়েছিল কিনা সে কথা এখন আর স্মরণ করতে পারেননি হান্নান খান। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে দণ্ডিত কয়েকজন এখনো বিদেশে পালিয়ে রয়েছে। এদের ধরে বাংলাদেশে নিয়ে যাওয়া জরুরি। জানি না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ অবস্থান কোন পর্যায়ে। তবে ইতিহাসের কলঙ্ক মোচনের স্বার্থেই এসব ঘাতককে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দণ্ড কার্যকর করা জরুরি। ‘
১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তদানীন্তন গভর্নর মোনায়েম খানের আগমনের প্রতিবাদ আন্দোলনে অংশ নিয়ে সেই সমাবর্তন ভণ্ডুলকারীদের অন্যতম হিসেবে গ্রেফতার ও ছয় মাস কারাবরণকারী হান্নান খান উল্লেখ করেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে এবং কানাডাতেও রয়েছে দু’তিনজন। এদের ফিরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। এটি খুবই আশাব্যঞ্জক ঘটনা। আশা করছি কূটনীতিক চ্যানেলে সবকিছু ঠিকমতো এগোচ্ছে। ‘
‘বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা এবং জেলহত্যা মামলার তদন্ত শুরুর পর অভিযুক্তদের কারাগারে নেওয়া হলো। ঠিক তেমন পরিস্থিতির মধ্যেই সরকারের পরিবর্তন ঘটায় নতুন সরকার (বিএনপি-জামায়াত জোট) আমাকে নানাভাবে হেনস্তা করেছে। চারবার বদলি করা হয় বান্দরবানে। অবশেষে আমাকে যেতে হয়েছে বাংলাদেশের বাইরে জাতিসংঘ শান্তিরা মিশনে। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ রহমত যে, পরবর্তীতে জাতির জনক হত্যা মামলা সম্পন্ন হয়েছে’-উল্লেখ করেন হান্নান খান।
যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা আলবদর আশরাফুজ্জামান এবং রাজাকার জব্বার ইঞ্জিনিয়ার প্রসঙ্গে হান্নান খান উল্লেখ করেন, ‘তারা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য মিথ্যা তথ্য প্রদান করেছে ইমিগ্রেশন বিভাগে। সেটি যথাযথ কর্তৃপরে মাধ্যমে মার্কিন প্রশাসনকে অবহিত করা হলেই তো ওদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। সেটি হচ্ছে না কেন?’
পারিবারিক কারণে নিউইয়র্কে আসা হান্নান খান ১১ আগস্ট ঢাকায় ফিরে যাওয়ার প্রাক্কালে প্রদত্ত এ সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে আরও জানান, আট বছরে মাত্র ৩৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। পেন্ডিং কয়েক হাজার মামলা এই গতিতে তথা মাত্র একটি আদালতে চলতে থাকলে বিচার শেষ হওয়ার অনেক আগেই আসামি এবং সাক্ষীরা ইন্তেকাল করবেন বলে মনে করছি। এ জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে আমরা আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধির অনুরোধ জানিয়েছি। একাত্তরের চিহ্নিত ঘাতকদের সহায়-সম্পদ সরকারের বরাবরে বাজেয়াপ্ত করা প্রসঙ্গে হান্নান খান বলেন, তদন্তের প্রারম্ভেই এসব কুখ্যাত অপরাধীদের গ্রেফতারের ক্ষমতাও নেই তদন্ত সংস্থার। এ জন্য কেউ কেউ আভাস পেয়েই বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছে। একইভাবে দণ্ডিত অপরাধীদের সহায়-সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার ব্যাপারেও সুস্পষ্ট কোনো বিধি না থাকায় আলবদর রাজাকারসহ ঘাতকরা বিচারের শঙ্কায় সহায়-সম্পদ অন্যের নামে দলিল করেছে। এসব বিষয় আমরা আইনমন্ত্রীর নজরে এনেছি। সাক্ষীদের নিরাপত্তার কথাও জানানো হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবলের কারণে একাত্তরের ঘাতকদের বিচার অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছে— উল্লেখ করেন ১৯৬৪ সালে ডাকসু নির্বাচনে ‘মেনন-মতিয়া’ প্যানেলের নির্বাচিত সদস্য হান্নান খান।
তিনি বলেন, মীর কাশেমসহ জামায়াতিরা ২০০ মিলিয়ন ডলার নিয়ে দেশ-বিদেশের আইনজীবী নিয়োগ করেছিল। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারাও ফোন করেছিলেন শেখ হাসিনাকে। কিন্তু একবিন্দু টলাতে পারেনি কোনো ফোন-ই-মেইল অনুরোধ। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের বন্ধু-শ্রেণির কোনো দেশও বিচার ব্যাহত করার চেষ্টা চালায়। সেটিও সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কমিটমেন্টের প্রতি যে আস্থা, তার পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সারা বাংলার মানুষ এই বিচারের জন্য নৌকা মার্কায় ভোট দিয়েছেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের ভোটাররা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আশায় ছিলেন।
হান্নান খান বলেন, আন্তর্জাতিক বন্ধুরা নগদ অর্থের কারণে বাহ্যিকভাবে কিছুটা দুর্বল হয়ে ফাঁসি থেকে বিরত হওয়ার জন্য ফোন করলেও পরবর্তীতে তারা ভিতরে ভিতরে খুশীই হয়েছেন। শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের সব কর্মকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটিশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাতিসংঘের অকুণ্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে সেটিও বাংলার মানুষ অবলোকন করছেন।
জামায়াতের আইনজীবী টিমের নেতা ব্যারিস্টার রাজ্জাক প্রসঙ্গে এই পুলিশ অফিসার বলেন, তার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। তিনিও আলবদর ছিলেন। তবে কেন তিনি দেশ ছেড়ে লন্ডনে একেবারেই নীরবতা পালন করছেন তা আমি জানি না। সময় হলেই হয়তো সব কিছু উদঘাটিত হবে।