শহিদুল আলমের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ৬ শিক্ষক

Slider বাধ ভাঙ্গা মত


ঢাকা: আলোকচিত্রী শহিদুল আলমকে নিয়ে আমরা চিন্তিত, শঙ্কিত। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ৫৭ ধারায় করা মামলায় রিমান্ডে থাকা বিশ্বনন্দিত এই আলোকচিত্রীকে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাতে ৭ আগস্ট নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। এরপর রাজধানী ঢাকায় পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয় থেকে বুধবার সকালে তাঁকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। চার দশকে তাঁর যে অর্জন আর মর্যাদা-সরকার আজ তা প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কেন?

নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের শুরু করা আন্দোলনের মধ্যে ‘উসকানিমূলক মিথ্যা’ বক্তব্য প্রচারের অভিযোগে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় শহিদুল আলম ডিবি হেফাজতে রিমান্ডে আছেন। তাঁকে আটকের পর নির্যাতন ও রিমান্ডে পাঠানোর বৈধতা নিয়ে এবং চিকিৎসার জন্য তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর নির্দেশনা চেয়ে তাঁর স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ মঙ্গলবার রিট করেন। এতে ইতিবাচক সাড়া দেন হাইকোর্ট। এ জন্য মহামান্য আদালতকে সাধুবাদ।

শহিদুল আলম একটি বিস্ময়কর সফলতার নাম; তিনি চার দশকের কর্মজীবনে বিশ্বের বহু দেশ ও প্রতিষ্ঠান থেকে স্বীকৃতি, সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। ছবি মেলা, দৃক বা পাঠশালা-তাঁর প্রতিটি উদ্যোগ দারুণভাবে সফল ও জনপ্রিয়। এর মাধ্যমে তিনি শত শত ফটোসাংবাদিক যেমন তৈরি করেছেন, তেমনি বিশ্বনন্দিত ফটোসাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারদের একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেকোনো বিচারেই তিনি দেশের সাংবাদিকতার একজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক ও সাংবাদিক। তাঁকে খুনি-সন্ত্রাসীদের মতো চোখ বেঁধে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং রিমান্ডে নিয়ে অন্যায়ভাবে নির্যাতনের ঘটনা বাংলাদেশকে গোটা বিশ্বের সামনে হেয় করেছে।

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রাজধানীর জিগাতলা এলাকায় সংঘর্ষের বিষয়ে কথা বলতে বেশ কয়েকবার ফেসবুক লাইভে আসেন শহিদুল আলম। এই আন্দোলন প্রসঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে সাক্ষাৎকারও দেন তিনি। ধানমন্ডির বাসা থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সুধীজনের মনে সংশয় জাগে: মতপ্রকাশের স্বাধীনতাও কি কেড়ে নেওয়া হলো? নিতান্ত দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি এ বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন বলে আমরা বিশ্বাস করি। তাঁর এই ভূমিকায় সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কোনো অভিপ্রায় আছে—এমনটি বিশ্বাসযোগ্য বা স্পষ্ট নয়। তাই রিমান্ডে নিয়ে তাঁকে যেন হেনস্তা করা না হয়, তাঁকে যেন দ্রুত তাঁর পরিবারের কাছে ফিরে যেতে দেওয়া হয়, আমরা এই দাবি জানাই।

গত ছয় মাসে অনেকগুলো প্রাণ ঝরে গেছে রাস্তায় বেপরোয়া গাড়ির চাপায়। অনেকেই হারিয়েছেন হাত কিংবা পা। এই কয়েক দিন আগেই একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আহত হওয়ার পর এ ঘটনার দায় এড়াতে নির্দয় হাতে তাঁকে নদীতে ছুড়ে ফেলে দিয়ে চলে গেছেন বাসের চালক ও তাঁর সহকারী। কই, সরকারের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিদের পক্ষ থেকে তো কোনো সাড়া জাগল না? চোখের সামনে সহপাঠীদের বাসের তলায় পিষ্ট হতে দেখে ছোট্ট শিশুদের বিবেক তো ঠিক জেগে উঠল! ছাত্রসমাজে রীতিমতো বিস্ফোরণ দেখতে পেলাম আমরা। আর পুরোটা সময় শিক্ষার্থীদের চাওয়া ছিল একটাই: নিরাপদ সড়ক। এখানে কোনো রাজনীতি ছিল না, সরকারবিরোধী কোনো তৎপরতা ছিল না। কিন্তু দেখা গেল, পুলিশ ও ‘হেলমেট পরিহিত কিছু অচেনা যুবক’ (যারা সরকার-সমর্থিত বলে অভিযুক্ত) রাস্তায় নেমে লাঠি, রড, রামদা ইত্যাদি নিয়ে নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের পিটিয়েছে; সহিংস আক্রমণের শিকার হয়েছেন দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকেরাও।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে এসব আক্রমণ আমাদের বিস্মিত ও বিক্ষুব্ধ করেছে! ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক মাধ্যম এবং গণমাধ্যমকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এসব হামলার ঘটনায় প্রতীয়মান হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে যে, পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা দেওয়ার নীতি গ্রহণ করেছে। এই আশঙ্কা যদি সত্যি হয়, তাহলে বলতে চাই, রাষ্ট্রপক্ষকে এখনই এটি বুঝতে পারতে হবে যে, এতে করে সরকারই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ছোট ছেলেমেয়েদের এই আন্দোলনকে যৌক্তিকভাবে গ্রহণ করে তাদের সব দাবি (৯ দফা) দ্রুত বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, সত্যিই তিনি গণমানুষের নেত্রী-সবার মনের খবর তিনি রাখেন, সবার অনুভূতি বোঝেন। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ও উদার সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবে বর্তমান সরকারের যে জনপ্রিয়তা রয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর এমন আক্রমণ কখনোই মেনে নেওয়া যায় না। আর আমাদের রাষ্ট্রপক্ষকে এটি বুঝতে হবে, সাংবাদিকদের ওপর এসব আক্রমণ অবাধ তথ্যপ্রবাহ, জনগণের তথ্য জানা ও জনগণকে তথ্য জানানোর অধিকার এবং স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর আঘাত।

আন্দোলনে জনজীবনে ভোগান্তি তৈরি হলো বটে, কিন্তু এ উদ্যোগকে দেশবাসী শেষ পর্যন্ত স্বাগতই জানিয়েছে, সাধুবাদ দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের ওপর নির্যাতন-হামলা শুধু অমানবিক নয়, মানবাধিকারের পরিপন্থী। তাহলে এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের কী অর্জন হলো? হিসাব করলে লাভের চেয়ে লোকসানের পাল্লাই ভারী হবে। তাই সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া: শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক আন্দোলনের পদক্ষেপে বা যারাই ছিল, তাদের ঢালাওভাবে ‘সরকারবিরোধী’ বলে আখ্যা দিয়ে ধরপাকড় বা হয়রানি এখনই বন্ধ হোক। শহিদুল আলম আইনের চোখে অপরাধ করেছেন কি না, সেটি আদালত বিচার করবেন। কিন্তু তাঁকে যে আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটি নিয়েই বিতর্ক আছে। সরকারও বলেছে, আইসিটি আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা বাতিল করা হবে। এ অবস্থায় শহিদুল আলমের নিরাপত্তা নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ প্রত্যাশা করছি।

রোবায়েত ফেরদৌস, মাহ্বুবুল হক ভূঁইয়া, কাজী আনিছ, এম. মাহবুব আলম, নাসরিন আক্তার ও সজীব সরকার

*লেখকেরা বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *