ঢাকা: জাতীয় স্বার্থে, জনস্বার্থে অথবা সরকারের স্বার্থে অনেক সময় অতি উঁচু পদ থেকেও অনেকে ইস্তফা দেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েও অনেকে পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ মনঃকষ্টের কারণ হতে পারে, কিন্তু তাতে অমর্যাদা নেই। বরং আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন মানুষ পদত্যাগ করে আত্মশ্লাঘা বোধ করেন। পদত্যাগ করা আর প্রাণত্যাগ করা এক কথা নয়।
এই উপমহাদেশে উচ্চতম পদ থেকে অনেকে পদত্যাগ করে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সিকে বিভক্ত করে ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ’ গঠন করেছিলেন। কংগ্রেস নেতারা এর প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলেন। অতি উঁচু ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ ছিলেন লর্ড কার্জন। তাঁর সময়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে যোগ্য প্রশাসক। বহু গ্রন্থ লেখা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। বাংলা ভাগ নিয়ে আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু তাঁর পদত্যাগ চাননি কেউ। যেহেতু তাঁর কাজটি অনেকেই পছন্দ করছেন না, তাই তিনি নিজে থেকেই পদত্যাগ করেন। তিনি পদত্যাগ না করলে পরাধীন দেশের কেউ তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারত না। ঢাকায় কার্জন হল তাঁর নামে।
ওই একই সময়ে নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলারও পদত্যাগ করেন। গভর্নর হয়ে আসার পর পূর্ব বাংলার মুসলমানদের খুশি করতে তিনি এক জনসভায় বলেন, ‘আমার দুই রানি, সুয়োরানি ও দুয়োরানি। বাঙালি মুসলমানরা আমার বড় রানি।’ তাঁর এই বক্তব্যকে আক্ষরিক অর্থে নিয়ে কংগ্রেসের হিন্দু নেতারা তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন। তাঁরও আত্মমর্যাদা ছিল, কয়েক দিন পর তিনি পদত্যাগ করেন। তাঁর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রয়েছে ফুলার রোড।
চল্লিশের দশকে অখণ্ড বাংলার গভর্নর স্যার ওয়েভেল প্রধান দল কংগ্রেসের নেতাদের দ্বারা মৃদু সমালোচিত হন। তা তাঁর আত্মসম্মানে বাধে। তিনি পদত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁর জায়গায় উপমহাদেশের শেষ গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন লর্ড মাউন্টব্যাটেন। সুতরাং পদ আঁকড়ে থেকে সমালোচিত হওয়ার চেয়ে পদত্যাগ করা শ্রেয়।
এ তো গেল বহুকাল আগের ইতিকথা। আমাদের সময়েও রয়েছে পদত্যাগের বহু উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আওয়ামী লীগের সভাপতি মাওলানা ভাসানী দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করতে বলেন সাংগঠনিক কাজে বেশি সময় দিতে। অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু পদত্যাগ করেন। কোনো রকম গড়িমসি করেননি। তাঁর সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেন। ১৯৭২-৭৫ সময়ে আরও কয়েকজন মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সরকারের স্বার্থে ও দলীয় প্রয়োজনে পদত্যাগ করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার ও সুবুদ্ধির কাজ।
গণতান্ত্রিক দেশে কোনো নেতা বা উচ্চপদস্থ কোনো কর্তা যখনই বিতর্কিত হন, তখনই পদত্যাগ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকে পদত্যাগ করেছেন। ব্রিটেনে মন্ত্রীদের পদত্যাগের নজির বহু। ভারতে গত ৭০ বছরে কেন্দ্রে ও রাজ্যে যত মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন, তাঁদের তালিকা করলে তা হবে খুবই দীর্ঘ। মানুষ দাবি করলেই যে পদত্যাগ করতে হবে তা নয়, কেউ বলুক বা না বলুক, নিজে থেকে সরে দাঁড়ানো সম্মানজনক।
দুজন কলেজশিক্ষার্থীর গাড়িচাপায় রাজপথে মৃত্যুর পর তাদের সহপাঠীরা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানাতে সড়কে বিক্ষোভ করে। বেপরোয়া যানবাহনের চাকায় পিষ্ট হয়ে আর যেন কেউ সড়কে প্রাণ না হারায়, এর ব্যবস্থা নিতে শিক্ষার্থীরা কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়। কিশোর-কিশোরীরা রাজনীতি বোঝে না। তাদের প্রতিবাদ সরকারের বিরুদ্ধেও নয়। তারা চেয়েছে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হোক। সে দাবি শুধু তাদের নয়, দেশের দলমত-নির্বিশেষে সব মানুষের।
স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা একটি নয় দফা দাবিনামা ঘোষণা করে। সে দাবিগুলোতে অযৌক্তিক কিছু না থাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারি দলের নেতারা তা মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। তারপরও কার কারণে প্রতিবাদটি উত্তাল হয়ে ওঠে, তা নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করে দেখা উচিত ছিল।
পরিবহন খাতের নৈরাজ্যকে কেন্দ্র করে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে, তাতে পরিবহনমালিক-শ্রমিকনেতা ও নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের পদত্যাগের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে ও আলোচিত হয়েছে। কোনো একটি শ্রেণি কোনো মন্ত্রীর পদত্যাগ চাইলেই অমনি তিনি পদত্যাগ করবেন, তা কেউ বলবে না। দাবি যৌক্তিক কি না, সেটা মানুষ বিচার করে দেখবে। নৌমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, তাঁর পদত্যাগ শিক্ষার্থীরা চায়নি, চেয়েছে বিএনপি-জামায়াত। তাই তিনি পদত্যাগ করবেন না।
পদত্যাগই সব সমস্যার সমাধান, তা কেউ বলবে না। তিনি পদত্যাগ না করলেও অন্যভাবে সমস্যাটির সমাধানের চেষ্টা করা যেত। শিক্ষার্থীদের ন্যায়সংগত আন্দোলনকে কর্তৃপক্ষ যেভাবে প্রশমিত করতে চেয়েছে, তা সঠিক পথ ছিল না। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার প্রয়োজন ছিল না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার নির্দেশের মধ্যে আমি কোনো যুক্তি দেখতে পাইনি। এখন আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের ওপর শিক্ষামন্ত্রী ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা যদি স্কুলেও না যায় এবং রাস্তায়ও না নামে, ব্যবস্থাপনা কমিটি কী করতে পারে?
স্কুল-কলেজগুলোর ম্যানেজিং কমিটির মুরব্বি হওয়ার জন্য জনপ্রতিনিধিদের ব্যাকুলতার শেষ নেই। শিক্ষার্থীরা যখন গণযোগাযোগব্যবস্থা ভালো করার জন্য রাস্তায় নেমে এল, সাংসদদের কোনো ভূমিকা দেখা গেল না। তাঁরা রাস্তায় হোক বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে হোক, তাদের আশ্বস্ত করতে পারতেন। তাহলে পরিস্থিতি এত দূর গড়াত না।
যারা মোটেই সরকারবিরোধী ছিল না, সেই দেড়-দুই কোটি ছাত্রছাত্রী সরকারের ওপর বিরূপ হলো। সরকারি দলের জন্য যা খুব বড় ক্ষতি। তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তা শুধু মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়, আন্তর্জাতিক শিশু অধিকারেরও লঙ্ঘন, যে শিশু অধিকার সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী।
এই শিশু-কিশোরেরা অতীতের বিএনপি-জামায়াত সরকারের অন্যায়-অত্যাচার দেখেনি। তাদের অনেকের তখন জন্ম হয়নি। জীবন শুরু করার আগেই তাদের যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো, তা তারা কোনো দিন ভুলবে না। এই আন্দোলনের ভেতর দিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজনীতিসচেতন হলো। সেটা যদি গঠনমূলক হয়, সৃষ্টিশীল হয়, তাহলে দেশের মঙ্গল হবে। তা না হলে লক্ষ্যহীন উগ্র রাজনীতিতে অভ্যস্ত হলে তাদেরও কল্যাণ হবে না, দেশের তো নয়ই।
বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সম্ভাবনা অপার। পূর্ববর্তী প্রজন্মের চেয়ে তারা অনেক বিষয়ে অগ্রসর। তাদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে কী অর্জিত হলো বা না হলো, সেটা বড় নয়। দুনিয়ার মানুষ জানল অধিকাংশ যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র নেই, ফিটনেস নেই। শিক্ষার্থীরা প্রমাণ করে দিল, এ দেশে ছোটরা বড়দের দিয়ে আইন মানাতে শেখায়, বড়রা আইন অমান্য করতে ভালোবাসে। বাঙালিদের বড় বড় মানুষ কোটি কোটি টাকায় গাড়ি কেনেন, রাষ্ট্রকে সামান্য রোড ট্যাক্স দিতে তাঁদের আপত্তি। শীর্ষ কর্মকর্তারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া গাড়ি হাঁকান। ড্রাইভিং লাইসেন্স ও রুট পারমিট ছাড়া যাত্রীবাহী বাস চলে রাস্তায় দুর্বার গতিতে। বেপরোয়া চালক গাড়ি উঠিয়ে দেন ফুটপাতের পথচারীর ওপর। চালকের শাস্তি চাইলে হয় অঘোষিত ধর্মঘট। তাঁরা পান সরকারের প্রশ্রয়।
কিশোর-কিশোরীরা নাগরিক হয়ে ওঠার আগেই নির্মমতার শিকার হলো। সড়কে নিরাপত্তা শিক্ষার্থীদের শুধু নয়, সব মানুষের দাবি। সস্নেহে যার সমাধান হতে পারত, তার সমাপ্তি সহিংসতায় কাম্য ছিল না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক