শোকের চাদর সরিয়ে গতকাল অস্ট্রেলিয়ায় মাঠে ফিরেছে ক্রিকেট। অ্যাডিলেডের এ মাঠেই আজ থেকে ঠিক ৮৯ দিন পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বিশ্বকাপের শেষ গ্রুপ ম্যাচে মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ দল। ২০১৫ বিশ্বকাপ শুরু হবে এর প্রায় এক মাস আগে, বাংলাদেশ মহড়া দিতে অস্ট্রেলিয়ায় যাবে তারও দিন ১৫ আগে। কিন্তু দেশের ক্রিকেটাঙ্গনে যে মহড়া চলছে, তাতে বিশ্বকাপের বাতাবরণ নেই, আদতে ক্রিকেটীয় আবহটাই নেই। চলছে কথার পাল্টাপাল্টি।
ক্রিকেট নেই বললে ভুল হবে, কারণ কদিনের বিরতির পর আজই আবার মাঠে গড়াচ্ছে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। কিন্তু গত কদিনে এমন কিছু কাণ্ড ঘটেছে যে মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের বিতণ্ডাটাই বেশি আকর্ষক! পক্ষপাতদুষ্ট আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগ করতে গিয়ে লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের মালিক লুৎফর রহমান বোর্ডের শীর্ষ থেকে অধস্তনদের যে ভাষায় প্রকাশ্যে আক্রমণ করেছেন, সেসব ছাপার যোগ্য কি না, তা নিয়ে মিডিয়া জগতেই দ্বিমত আছে। তবু তিনি যখন ‘অন রেকর্ড’ বলেছেন, তখন ছাপানোর দায় মিডিয়ার নয়। লুৎফর কাল ঘটা করে ভুল স্বীকার করলেও সেদিন যে গালমন্দ করেছিলেন, সেটি অস্বীকার করেননি।
ক্রিকেটে ফিরতে হচ্ছে বাংলাদেশকেও!
তবে বক্তব্য প্রত্যাহার না করার সাহস কিংবা বিবৃতির মাধ্যমে লুৎফরের ভুল স্বীকার করার ঘটনা খুব একটা প্রভাব ফেলেনি বোর্ড পরিচালকদের মনে। গতকাল সন্ধ্যায় এ ঘটনা নিয়ে আলোচনায় বসেছিল ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস (সিসিডিএম)। পরে বিষয় সুরাহার জন্য সেটি ডিসিপ্লিনারি কমিটিতে পাঠায় তারা। শৃঙ্খলা কমিটিকে সুপারিশ করার অর্থ একটাই, লুৎফরের শাস্তি হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। সিসিডিএম ও ডিসিপ্লিনারি কমিটির সভার ফাঁকে তেমন কঠোর মনোভাবের আঁচই পাওয়া যাচ্ছিল নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিবির এক পরিচালকের কণ্ঠে, ‘বাদল (লুৎফর) যা বলেছেন, তাতে তাঁর বিপক্ষে শৃঙ্খলাভঙ্গের শামিল। আপনি যে বোর্ডের অধীনে খেলছেন, সেটিকেই চোরচোট্টাদের আখড়া বলে দিতে পারেন না। আম্পায়ারদের নাম উল্লেখ করে বিবৃতিও দিতে পারে না কোনো ক্লাব।’
গতকালই কালের কণ্ঠে ছাপা হওয়া এনামুল হকের কথায় আরো বড় অভিযোগ রয়েছে রূপগঞ্জের বিপক্ষে। মিডিয়ার কাছে প্রায় প্রতিদিনই আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগ করলেও সেসবের কিছুই নেই ক্লাবটির অধিনায়কের প্রতিবেদনে, অথচ আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগ করার ওটাই একমাত্র বৈধ প্রক্রিয়া। তা ছাড়া যে ছয়জন আম্পায়ারের ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ করে রূপগঞ্জ, সে তালিকার একজন এ মৌসুমে মাত্র একটি ম্যাচে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেটিও রিজার্ভ আম্পায়ারের ভূমিকায়। তাই মাঠের সিদ্ধান্তে তাঁর ভূমিকা রাখার কোনো সুযোগই নেই।
লুৎফর অবশ্য লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছেন, তাৎক্ষণিক উত্তেজনাতেই ওসব বলে ফেলেছিলেন তিনি। এ বিবৃতি পড়ে যেন আরো ক্ষুব্ধ বিসিবির এক পরিচালক, ‘তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় নয়, টাকার গরমে ওসব বলে ফেলেছেন বাদল!’ এটা ‘ওপেন সিক্রেট’ যে শেয়ার ব্যবসায় বিপুল লাভ করে লুৎফর দেশের শীর্ষ ধনবানদের একজন। ক্রিকেটাঙ্গনের বিভিন্ন স্তরে লুৎফরের অনুসারীও আছে। পরিস্থিতি গোলমেলে আঁচ করতে পেরে গত পরশু বিসিবির ‘শোডাউনে’র পর থেকেই বিভিন্ন পর্যায় থেকে এ ‘ঝামেলা’ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাও হয়েছে; কিন্তু তাতে বরফ গলেনি। লুৎফরের বক্তব্যের পাল্টা হিসেবে পরশু শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ক্লাব সমিতি, আম্পায়ার ও ক্রিকেটারদের সংগঠনের বাড়াবাড়ি নিয়ে প্রচারণায়ও অনড় বিসিবি।
অনড় থাকার কারণটা জানিয়েছেন বিসিবির আরেকজন পরিচালক, ‘আপনারা (মিডিয়া) এটা বুঝবেন না, কারণ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আপনাদের হতে হয় না। ভেবে দেখুন সমাজে আপনার একটা পরিচিতি আছে। এখন মিডিয়ায় ছাপা হলো আপনি চোরচোট্টা, কেমন লাগবে আপনার?’
আর যার যেমন লাগুক, বিসিবি ভীষণ ক্ষুব্ধ। তবে লুৎফরের দণ্ডের ‘সরকারি মানদণ্ড’ এই ক্ষোভ নয় বলেই জানিয়েছেন বিসিবির এক কর্তাব্যক্তি, ‘ব্যক্তিগত ক্ষোভের কারণে কাউকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই, কারণ আইন আছে। আমরা আইনের পথেই হাঁটছি।’ সে হাঁটাও খুবই দ্রুতগতির। সিসিডিএম সন্ধ্যায় সুপারিশ করার পর রাতেই ডিসিপ্লিনারি কমিটির বৈঠক করার ঘটনা খুব নিয়মিত ব্যাপার নয়।
এত তাড়াহুড়া তো সন্দেহের নতুন জানালা খুলেও দিতে পারে, শুনে এক বোর্ড পরিচালকের প্রতিবাদ, ‘কেন? এই উটকো ঝামেলা দ্রুত মিটিয়ে ফেলাই তো ভালো। তাতে সবাই আবার ক্রিকেটে মন দেবে।’
এই ক্রিকেটে ফেরাটাই এখন সবচেয়ে জরুরি।