ঢাকা: জাল ভোট, কেন্দ্র লুট, গুলি, হামলা, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে তিন সিটির ভোট গ্রহন সমাপ্ত হয়েছে। খুলনা ও গাজীপুরের পর আজ সমাপ্ত হল রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি নির্বাচন। এই নির্বাচনে বেশ কয়েকজন মেয়র প্রার্থী ভোট শেষ হওয়ার আগেই ভোট বর্জন করেছেন। বরিশালে আহত ও অবরুদ্ধ হয়েছেন দুই মেয়র প্রার্থী। এখন শুরু হবে ভোট গণনা। এর আগে সকাল ৮টা থেকে টানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট গ্রহন চলে।
দিনভর কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটারদের ভোট দেওয়া, অনেক কেন্দ্রে জাল ভোট-কেন্দ্র দখল, ভোট বর্জন, এজেন্ট ঢুকতে না দেওয়া, হাতাহাতি, পুলিশের ধাওয়া, কেন্দ্র স্থগিতসহ নানা ঘটনার মধ্যে শেষ হয়েছে তিন সিটি করপোরেশনের ভোটগ্রহণ। এখন চলছে গণনা। এরপর ফল ঘোষণা হবে।
আজ সোমবার রাজশাহী, সিলেট ও বরিশাল সিটি করপোরেশনে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে টানা ভোটগ্রহণ। তিন সিটিতে একজন মেয়র, একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও একজন সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর বেছে নিতে ভোটারেরা ভোট দিয়েছেন। তিন সিটিতে মোট ১৪টি কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়েছে।
তিন সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার প্রায় ৯ লাখ। প্রাথমিক হিসেবে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়তে পারে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন।
সকাল ৮টায় ভোট শুরুর পর থেকেই কেন্দ্র থেকে এজেন্ট বের করে দেওয়া, এজেন্টদের ঢুকতে না দেওয়াসহ বিভিন্ন অভিযোগ করতে থাকে বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। তবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন, বদরুদ্দিন আহমেদ কামরান ও সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, বিএনপি নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে এবং নিশ্চিত পরাজয় জেনে এসব অভিযোগ করছে।
ঢাকায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে ভোট নিয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে। আওয়ামী লীগ বলছে, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হচ্ছে। বিএনপির অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলেছে দলটি। অন্যদিকে বিএনপি এই নির্বাচনকে বলেছে নীলনকশার নির্বাচন।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিএনপির অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বিএনপির আসলে কোনো লোকজনই নেই। সেই জন্য তারা এজেন্ট পায়নি। এখন মিথ্যাচার করছে।’
বরিশালে নানা অনিয়মের কথা তুলে ধরে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ভোট বর্জন করেন বরিশালে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী মজিবর রহমান সরওয়ার। এর পরপরই ভোট বর্জন করেন বাসদের মনীষা চক্রবর্তী, ইসলামী আন্দোলনের ওবাইদুর রহমান। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস ভোট স্থগিতের দাবি জানান।
সিলেটে বিএনপির প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট অভিযোগ করেছেন মোট ৪১টি কেন্দ্র দখল করে সরকারদলীয়রা জালভোট দিয়েছেন। অন্যদিকে রাজশাহীতে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল বলেছেন ৭৬টি কেন্দ্রে অনিয়ম, জালভোটের ঘটনা হয়েছে।
সিলেট ও রাজশাহীতে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা বারবারই বলেছেন, যাই হোক না কেন তাঁরা শেষ পর্যন্ত ভোটে থাকবেন। এবং শেষ পর্যন্ত থেকেছেনও। তবে সিলেটে বিএনপির মেয়রপ্রার্থী আরিফুল হক ভোট বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে আবেদন করেছেন তিনি। এতে তিনি ৪১টি কেন্দ্রের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেন। এর আগে নগরের কাজী জালালউদ্দিন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্র পরিদর্শন করে নিজ কার্যালয়ে গিয়ে বলেন, এবার ভোট চুরির ঘটনা সব সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এমনটা সিলেটে আগে কখনো হয়নি। মানুষের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছে। ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার আন্দোলনের ডাক দেবেন বলে তিনি জানান।
এ ছাড়া মেয়র পদে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) মনোনীত প্রার্থী মো. আবু জাফর ‘নজিরবিহীন কারচুপির’ অভিযোগ এনে সব কেন্দ্রের ভোট বাতিলের আবেদন করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামানের কাছে।
বরিশালে বিএনপিসহ ৪ প্রার্থীর ভোট বর্জন:
নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন বিএনপিসহ চারটি দলের মেয়র প্রার্থী। তাঁরা হলেন বিএনপির মজিবর রহমান সরওয়ার, ইসলামী আন্দোলনের ওবাইদুর রহমান, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) মনীষা চক্রবর্তী ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির আবুল কালাম আজাদ।
আজ সোমবার দুপুর ১২টা থেকে দেড়টার মধ্যে তাঁরা পৃথকভাবে এ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেন।
দুপুর সোয়া ১২টার দিকে বরিশাল প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী মজিবর রহমান সরওয়ার। তিনি বলেন, গাজীপুর ও খুলনায় ভোটগ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা পালন করা হলেও বরিশালে ভোট শুরুই করা হয়নি। ৭০ থেকে ৮০টি কেন্দ্রে ভোট শুরু না হতেই ব্যালটে নৌকার সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে। বিএনপি ও অন্য দলের কোনো প্রার্থীর এজেন্টদের ভোটকক্ষে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নির্বাচনে প্রশাসনের ভূমিকা ন্যক্কারজনক—এমন অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ‘আমি চারবার সাংসদ ও একবার মেয়র ছিলাম। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকারের আমলেই এমন নজিরবিহীন ভোট আমরা দেখিনি। এমন প্রহসনের নির্বাচন না করে এমনিতেই ঘোষণা দিয়ে নিয়ে যেতে পারত সরকার।’
সরওয়ার বলেন, ‘আমরা আগেই বলেছিলাম, এখানে প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় প্রার্থী, তাই সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশনের আশ্বাসে আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের আগের আশঙ্কাই আজ ঠিক হলো।’
সংবাদ সম্মেলনে সরওয়ার নৌকা প্রতীকে সিল মারা ১০ থেকে ১২টি ব্যালট সাংবাদিকদের দেখিয়ে বলেন, সদর গার্লস স্কুল কেন্দ্রে এভাবে ব্যালটে নৌকার সিল মেরে বাক্স ভর্তি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, ইসলামী আন্দোলনের ওবাইদুর রহমান এবং বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের মনীষা চক্রবর্তী সমর্থকদের নিয়ে ‘প্রহসনের নির্বাচন মানি না মানব না’, ‘ভোট চুরির নির্বাচন মানি না মানব না’—এমন বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে বরিশাল সদর রোডে পৃথকভাবে মিছিল করেন। এ সময় মনীষা গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে অভিযোগ করেন, তিনি সদর গার্লস স্কুল কেন্দ্রে গিয়ে প্রকাশ্যে নৌকা প্রতীকে সিল মারতে দেখেন। প্রতিবাদ করলে তাঁকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। অভিযোগ জানানোর পরও এই কেন্দ্রে নির্বাচন এখনো চলছে। এই কেন্দ্রের মতো সব কেন্দ্রেই নৌকায় সিল মারা হচ্ছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল কালাম আজাদ ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। বেলা দেড়টার দিকে বরিশাল প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই ঘোষণা দেন।
এদিকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ইকবাল হোসেন ১২৩টি কেন্দ্রর সবগুলোতে ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট স্থগিত করে পুনরায় ভোটগ্রহণের দাবি জানিয়েছেন। দুপুরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তিনি এই আহ্বান জানান।
দুপুরে রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির মেয়র প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ইসলামীয়া ভোটকেন্দ্রে অবস্থান নেন। তাঁর অভিযোগ—ওই কেন্দ্রে মেয়র প্রার্থীর ব্যালট শেষ হয়ে গেছে। মোসাদ্দেক হোসেন প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে ব্যালটের হিসাব চান। তিনি বলেন, ব্যালটের হিসাব না পেলে তিনি সেখান থেকে যাবেন না।