ঢাকা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে এক কপোত-কপোতির চুমুর যে ছবিটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেটি নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্টে। পত্রিকাটির ভারত ব্যুরো চীফ অ্যানি গোয়েনের করা এই প্রতিবেদনের শিরোনাম ‘প্রেমিক-জুটির চুমুর ভাইরাল ছবি নিয়ে বাংলাদেশে অনেকের আপত্তি। যিনি ছবি তুলেছেন তিনি মার খেয়েছেন, চাকরিচ্যুত হয়েছেন।’
এতে বলা হয়, মৌসুমি বৃষ্টিতে দুই প্রেমিক-প্রেমিকার চুমুর স্বপ্নীল ছবিটি ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ সোমবার নিজের প্রোফাইলে পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে ভাইরাল হয়ে যায়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ওই জুটির এমন সপ্রতিভ মুহূর্ত নিয়ে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে ছবিটি তোলা হয়েছিল, সেখানে এ ধরণের ঘটনা বেশ বিরল। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে এই ক্যাম্পাস বিক্ষোভ ও সহিংস ঘটনা নিয়ে উত্তপ্ত ছিল।
এতে আরও বলা হয়, হাত ধরে থাকার দায়ে দুই শিক্ষার্থীকে পেটানোর অভিযোগে এই মাসেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন ‘রক্ষণশীল’ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে। তবে, প্রকৃতপক্ষে এই তিন শিক্ষার্থী ছিলেন ছাত্রলীগ কর্মী।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ, যেই দেশটিতে চরমপন্থা ক্রমেই গভীরে পৌঁছাচ্ছে, সেখানে অনেকে মনে করেন, ওই ছবিটি আপত্তিকর ছিল। বাংলাদেশের (প্রকৃতপক্ষে, ভারতের) নিউজ ১৮ ওয়েবসাইটে এক রক্ষণশীল ব্লগার লিখেছেন, ‘প্রেমিক যুগল দিনে দিনে দুঃসাহসী হয়ে উঠছেন। আগে এ ধরণের ঘটনা গোপনে হতো। এখন এসব দিনে দুপুরে হচ্ছে। সেই দিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন তারা প্রকাশ্যেই ভালোবাসাবাসি করবে।’
ফটোগ্রাফার জীবন আহমেদ অবশ্য বলছেন, ছবি তোলায় ওই যুগলের কোনো আপত্তি ছিল না। তিনি এ-ও বলেছেন যে, নৈতিকতা ‘পুলিশিং’-এর ভুক্তভোগী হওয়া মেনে নেবেন না তিনি। তার ভাষ্য, ‘নৈতিকতার বিকৃত চেতনা একজন শিল্পীর কাজকে প্রভাবিত করতে পারে না।’
সেদিনের কাহিনী বর্ণনা করে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসএসিতে তিনি যখন ছবি তোলার মতো মুহূর্ত খুঁজছিলেন, তখনই তিনি দেখতে পান বৃষ্টিতে ওই যুগল ‘লিপ-কিসিং’-এ মত্ত। এরপর এক ক্লিকেই তিনি নিজের ক্যামেরায় ধারণ করেন ওই ছবি। এরপর তিনি নিজের বার্তাকক্ষে পাঠান। তবে সেখানকার সম্পাদকরা এই ছবি প্রকাশে রাজি হননি, কেননা এ থেকে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আসতে পারে। জীবনের ভাষ্য, ‘আমি তাদেরকে বললাম, না, আপনি এই ছবিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখাতে পারেন না। কারণ, আমার কাছে এটি ছিল বিশুদ্ধ ভালোবাসার প্রতীক।’ পরে তিনি ছবিটি নিজের ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম প্রোফাইলে আপলোড করেন। আর এক ঘণ্টার মধ্যেই ৫ হাজার বার শেয়ার হয় ওই পোস্ট।
পরেরদিন তারই কিছু ফটোসাংবাদিক সহকর্মী তাকে পেটান। আর একদিন পর বুধবার তারই বস তার কাছ থেকে আইডি ও ল্যাপটপ নিয়ে নেন। কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই।
জীবন বলছিলেন, ‘ওই যুগল অবিরাম চুমুতে ছিল। আমি এতে কোনো ভুল খুঁজে পাইনি। অশ্লীলতা খুঁজে পাইনি। অবশ্যই আজ আমি হতাশ। আমাদের দেশে কিছু মানুষ শুধু কাগজে কলমে শিক্ষিত হয়েছে। বাস্তবে হয়নি। তারা আমার ছবির অন্তর্নিহিত মর্মার্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। আমি নিজের ব্যাপারেও কিছুটা চিন্তিত।’
খবরে আরও বলা হয়, এই ঘটনা এমন সময় ঘটলো, যখন বাংলাদেশে সাংবাদিকরা নানামুখী হুমকির সম্মুখীন। এ বছর কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট-এর এশিয়া প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর স্টিভেন বাটলার এক ব্লগ পোস্টে লিখেছেন, এই হুমকির মধ্যে রয়েছে জঙ্গি হামলা, যেগুলো বাংলাদেশের একসময়কার সক্রিয় ব্লগার সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে দিয়েছে। আছে কঠোর মানহানি আইন ও ভিন্নমতের প্রতি শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা।
ঢাকার ইংরেজি পত্রিকা ঢাকা ট্রিবিউনের বিশেষ প্রতিবেদক তানিম আহমেদের ‘কিসিং লিবার্টি গুডবাই?’ (চুমুর স্বাধীনতা বিদায়?) শীর্ষক একটি মতামত কলামকে উদ্ধৃত করা হয়। তিনি লিখেছেন, এ ধরণের ‘শ্বাসরোধী’ পরিস্থিতিতে এ ধরণের কুণ্ঠাহীন নিষ্কলুষতার ছবি আশার সঞ্চার করে, যা এখন নাই বললেই চলে। তিনি আরও লিখেন, ‘এই যুগেও এ ধরণের কিছু মানুষের অস্তিত্ব আছে যারা জীবন, ভালোবাসা কিংবা তারুণ্য নিয়ে হাল ছাড়েননি, এমন ভাবনাটা মনকে সজীব করে দেয়। উষ্ণ করে দেয় হৃদয়কে।’