৮ ঘণ্টা পর উদ্ধার আ.লীগ নেতা

Slider ফুলজান বিবির বাংলা


ঢাকা: বেশ কিছুদিন ধরেই নিরাপত্তা নিয়ে আতঙ্কে ছিলেন কুমিল্লার আওয়ামী লীগ নেতা ও তিতাস উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান পারভেজ সরকার (৪০)। স্ত্রীকে বলেছিলেন গাড়ি ছাড়া ছেলেদের নিয়ে বাইরে না যেতে। নিজেও একা ঘোরাফেরা করতেন না। তাঁর এই আশঙ্কা ভুল ছিল না। শুক্রবার দিনদুপুরে নামাজ পড়ে ফেরার পথে রাজধানীর লালমাটিয়ার বাসার সামনে থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা।

অবশ্য তুলে নিয়ে যাওয়ার আট ঘণ্টা পর শুক্রবার দিবাগত রাত ১০টায় একটি মুঠোফোন থেকে পারভেজ সরকার তাঁর স্ত্রীকে জানান, তিনি ভালো আছেন, সুস্থ আছেন। এরপর ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১০ মিনিট পর আবার স্ত্রীকে ফোন করে জানান, তিনি রাজধানীর ৩০০ ফুট এলাকায় আছেন। এখান থেকে তাঁকে নিয়ে যেতে বলেন। পরে পরিবারের সদস্যরা গাড়ি নিয়ে সেখানে যান।

শুক্রবার রাত সাড়ে ১২টায় পারভেজের খালাতো ভাই মো. ফাহাদ ভূঁইয়া বলেন, রাস্তার পাশে (কাঞ্চন ব্রিজের কাছে) একটি চা দোকানের সামনে একা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর ভাই। সেখান থেকে গাড়িতে করে তাঁরা লালমাটিয়ার বাসায় কিছুক্ষণ আগে ফিরেছেন। কারা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি।

এর আগে শুক্রবার দুপুরে দুজন লোক একটি কালো মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার গাড়িতে করে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায় পারভেজকে। সে দৃশ্য ধরা পড়েছে সিসি ক্যামেরায়। প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা বলছেন, অপহরণকারীদের কাছে তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্র ও ওয়াকিটকি দেখেছেন।

পারভেজের পরিবার এ জন্য তাঁর রাজনৈতিক বিরোধকে দায়ী করছেন।

পারভেজ সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কুমিল্লা-২ আসন (তিতাস-হোমনা) থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। বর্তমানে কুমিল্লা উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য তিনি। তিনি ঠিকাদারি ব্যবসা করতেন।

গত বছর তিতাস উপজেলার বাতাকান্দি বাজারে পারভেজের গাড়িতে গুলি ও হামলার ঘটনা ঘটে। এরপর থেকে তিনি আর এলাকায় যাননি বলে গতকাল জানান পারভেজের স্ত্রী তাহমিনা আফরোজ মৌসুমী। তিনি বলেন, ওই হামলার জন্য তিতাস উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সোহেল শিকদারকে অভিযুক্ত করে আসছিলেন পারভেজ।

এবারের অপহরণের জন্যও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দায়ী করে তাহমিনা বলেন, ছয় বছর ও আড়াই বছরের দুই ছেলে রয়েছে তাঁদের। ছয় দিন আগে হঠাৎ করে ছেলেকে নিয়ে রিকশায় বা হেঁটে স্কুলে যেতে মানা করেন। গাড়ি ছাড়া বাসা থেকে একদম বের হতে নিষেধ করে দেন।
তবে তিতাস উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সোহেল শিকদার শুক্রবার অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এটা আমার দুর্ভাগ্য। পারভেজ ভাই এমপি নির্বাচন করতে চান। আর আমি ভাইস চেয়ারম্যান। আমাদের কোনো বিরোধিতা নেই। তিনি কেন আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন, তা জানি না। আমি এলাকায় আছি। আমরা কখনোই এ রকম কাজে অভ্যস্ত নই। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে। তারা নিশ্চই সব বের করবে।’

যেভাবে তুলে নেওয়া

রাজধানীর লালমাটিয়ার প্রান্তে, ধানমন্ডির ২৭ নম্বর সড়ক লাগোয়া রেজিনা বসতি নামে একটি অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে নিজের ফ্ল্যাটে থাকেন পারভেজ। শুক্রবার দুপুরে বাসা থেকে সিকি কিলোমিটারের মধ্যে মিনার মসজিদে জুমার নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন। তিনি যে বাসায় থাকেন, তার সামনের একটি বাসায় সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, বেলা পৌনে দুইটার দিকে এক হাতে জায়নামাজ, আরেক হাতে ধরা মুঠোফোনের দিকে তাকিয়ে তিনি বাসার দিকে আসছিলেন। সেখানে আগে থেকেই কালো টি-শার্ট পরা দুই ব্যক্তি ঘোরাফেরা করছিলেন। পারভেজ বাসার ফটকে আসার পর একজন হ্যান্ডশেক করার ভঙ্গিতে তাঁর হাত ধরেন। একটু দূরে থাকা আরেকজন দ্রুত হেঁটে পারভেজের কাছে গিয়ে তাঁর ঘাড়ে হাত রাখেন। এরপর দুজন মিলে পারভেজকে টানাহেঁচড়া করতে দেখা যায়।

পারভেজের প্রতিবেশী ব্যবসায়ী খালিদ মল্লিক বলেন, তিনি নামাজ পড়ে ফেরার পথে দেখতে পান, এক যুবক পারভেজকে ডাক দিয়ে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলেন। এ সময় পেছন থেকে আরেক যুবক এসে পারভেজের ঘাড়ে হাত রাখেন। ঘনিষ্ঠ কারও সঙ্গে পারভেজ গল্প করছেন ভেবে খালিদ পাশ কাটিয়ে যেতে চান। তখনই দেখেন তাঁরা পারভেজকে টানাহেঁচড়া করছেন। পারভেজও সাহায্যের জন্য চিৎকার করছেন। যাঁরা তাঁকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের কোমরে ওয়াকিটকি ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তাঁকে একটি কালো কাচে ঘেরা মিতসুবিশি আউটল্যান্ডার গাড়িতে তোলা হয়। গাড়িটি দ্রুতগতিতে এগিয়ে ২৭ নম্বর সড়কের দিকে যায়।

পারভেজের বাসার নিরাপত্তাকর্মী ওমর আলীও ঘটনাটি দেখেছেন। তিনি বলেন, যে দুই ব্যক্তি পারভেজকে ধরে নিয়ে যান, তাঁরা বেশ কিছুক্ষণ ধরেই সেখানে অপেক্ষা করছিলেন। তাঁদের একজন একবার এসে ওমরের কাছে জানতে চান, বাসা ভাড়া দেওয়া হবে কি না। নিরাপত্তাকর্মী ওমর জুমার নামাজের পরে যোগাযোগ করতে বলেন। ওমর বলেন, পারভেজ যখন বাঁচাও বাঁচাও বলে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন, তখন তিনি দৌড় দিয়ে লাঠি আনতে যান। লাঠি হাতে এগিয়ে আসতেই দেখেন, তৃতীয় আরেক ব্যক্তি দরজাটি লাগানোর চেষ্টা করছেন। বড় দরজাটা কোনোমতে ভেজিয়েই ওই লোক লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পড়া মাত্রই সেটি ছেড়ে দেয়।

পারভেজের ভাগনে আবরার শামসাদ বলেন, তাঁরা আশপাশের বেশ কয়েকটি বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখেছেন। সেখানে তিন ঘণ্টা আগে থেকে ওই গাড়ি এই এলাকায় অপেক্ষমাণ দেখা গেছে। বাড়ির পাশেই অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুল হওয়ায় অনেক গাড়ি এখানে পার্ক করা হয়। তাই কেউ মাথা ঘামায়নি।

পারভেজের স্বজন ও ঘনিষ্ঠরা বলছেন, অপহরণে ব্যবহৃত গাড়িটিতে ‘ঢাকা মেট্রো ঘ ১৪-২৫৭৭’ নম্বর লেখা প্লেট লাগানো ছিল। গাড়ির বিষয়ে খোঁজ নিয়ে তাঁদের ধারণা হয়েছে, নম্বরটি ভুয়া। তবে এ ধরনের গাড়ি সাধারণত সরকারি কাজেই বেশি ব্যবহৃত হতে দেখা যায় বলে তাঁরা জানিয়েছেন।

পুলিশের মোহাম্মদপুর জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মৃত্যুঞ্জয় দে সজল বলেন, যে ভিডিও ফুটেজটি পাওয়া গেছে, তা অস্পষ্ট। পরিষ্কার করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তাই ঘটনাস্থলের আশপাশের অন্যান্য বাড়ির সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *