অজ বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি এখন উদ্বেগজনক। পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশে গত আট বছরের মধ্যে এখনকার মানবাধিকার পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ। চলতি বছরের শেষ নয় মাসে এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের হার সবচেয়ে বেশি। এখনো দেশের বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠছে। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে গুম, থানায় ধরে নিয়ে নির্যাতন, মামলার হয়রানি এমনকি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথেও জড়িয়ে পড়ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের নাম।
নারায়নগঞ্জের সাত খুনের ঘটনাতো রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গায়ে কালিমা লেপে দিয়েছে। এছাড়া কলেজছাত্র লিমন, লক্ষীপুর, খুলনা, মিরপুরের কালসীতে, রাজধানীর ভাষানটেকের ঘটনাগুলোতেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর সদস্যদের জড়িত থাকার ব্যাপারে তথ্য বেরিয়েছে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, আমাদের একটি নীতিগত অবস্থান হচ্ছে—যখনই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠে আমরা সোচ্চার থাকি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নতুন নয়। এ বিষয়েও আমরা সোচ্চার আছি।
এদিকে, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিগত ৮ বছরের মধ্যে এখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় অাছে এখন। দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান ঘেঁটে গুম-অপহরণের উদ্বেগজনক চিত্র পাওয়া গেছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত আট বছরের মধ্যে চলতি বছরের প্রথম নয় মাসে এ ধরনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে। এ সময়ে দেশে ৮২ ব্যক্তি গুম-অপহরণের শিকার হন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে এসব ব্যক্তিকে তুলে নেওয়া হয়েছে বলে তাঁদের স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন। পরে এঁদের মধ্যে ২৩ জনের লাশ পাওয়া গেছে। ১০ জন ছাড়া পেয়েছেন। সাতজনকে গ্রেপ্তারের খবর পরে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনজনকে পরে থানায় ও কারাগারে পাওয়া গেছে। বাকি ৩৯ জন এখনো নিখোঁজ।
২০১১ সালে গুম-অপহরণ হন ৫৯ জন। তাঁদের মধ্যে ১৬ জনের লাশ উদ্ধার হলেও ৩৯ জন এখনো নিখোঁজ। চারজন পরে ছাড়া পান। ২০১২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫৬। যাঁদের মধ্যে আটজন পরে ছাড়া পান, চারজনের লাশ পাওয়া যায়। ১০ জনকে পুলিশ হেফাজতে ও কারাগারে পাওয়া যায়। ৩৪ জন এখনো নিখোঁজ। ২০১৩ সালে গুমের শিকার হন ৭৬ জন। এঁদের মধ্যে ২৩ জনের লাশ পরে পাওয়া গেছে। অন্যরা এখনো নিখোঁজ।
এ ছাড়া গত এক দশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টারের’ ঘটনায় ও হেফাজতে নিহতের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। একইভাবে চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে মারা গেছেন ১৩৬ জন। এসব মৃত্যুর ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে আসক।
বিচারবহির্ভূত হত্যার সর্বশেষ বড় অভিযোগ উঠেছে খুলনার পাইকগাছার জিরবুনিয়া গ্রামে পুলিশের বিরুদ্ধে। গত ৫ অক্টোবর সেখানে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে একসঙ্গে ১৩ জন নিহত হন। পুলিশের দাবি, নিহত ব্যক্তিদের সবাই সুন্দরবনের দস্যু। তবে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের দাবি, স্থানীয় মানুষের সহায়তায় পুলিশ তাঁদের পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে। অন্যান্য বিচারবহির্ভূত হত্যার মতো এ ঘটনায়ও সরকার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি। নেয়নি নিরপেক্ষ তদন্তের উদ্যোগ।
অবশ্য মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির কথা মানতে রাজি নন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি বলেন, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, এটা একদম বাজে কথা। মানবাধিকারকর্মীরা খামোকাই এ গৎবাঁধা কথা বলেন। তাঁর দাবি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাঁরা যাচাই করে দেখেন। বেশির ভাগ অভিযোগই সত্য নয়। ফলে সরকারের করার কিছু থাকে না। তবে সত্য ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে।
সরকারের এই অস্বীকার করার প্রবণতার কারণে মানবাধিকার পরিস্থিতি এত উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে মনে করেন আসকের পরিচালক মো. নূর খান। তিনি বলেন, গুম-অপহরণের অনেক ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবার, মানবাধিকার সংগঠন ও গণমাধ্যম সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করার পরও কার্যকর তদন্ত হয়নি। রাস্তা থেকে, ঘর থেকে মানুষকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। কোথাও প্রতিকার পাচ্ছে না মানুষ। সর্বত্র ভীষণ ভয়ের আবহ তৈরি হয়েছে।
নূর খান আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম-অপহরণসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্তের জন্য একটা স্বাধীন কমিশন গঠন করার দাবি জানান।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, শুধু গুম-খুনই নয়, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও বিরোধী দলের সভা-সমাবেশের অধিকারও অনেক সংকুচিত হয়ে এসেছে। বিরোধী দলের ওপর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ হচ্ছে। বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর পরিচালক এস এম নাসির উদ্দিন বলেন, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে গুম-খুনের বাইরে নতুন যুক্ত হয়েছে ’৭৪-এর বিশেষ ক্ষমতা আইনের প্রয়োগ, রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের অপব্যবহার।
এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মানুষকে গ্রেপ্তারের পর হেফাজতে নির্যাতনের মাত্রা বৃদ্ধি ও মানুষকে ধরে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করার অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে শৃঙ্খলা অমান্য করার উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। গত বছর মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, কখনো কখনো এ বাহিনীর ওপর কার্যকর নিয়ন্ত্রণ রাখতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
শাহদীন মালিকের মতে, জনপ্রিয়তা ও জনসমর্থন যখন কম থাকে, তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর সরকারের নির্ভরতা বাড়ে। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর নির্ভরতা বাড়লে তারা যদি আইনের বাইরেও কাজ করে, তখন সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। এ কারণেই বর্তমানে দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির এ অবস্থা।
তথ্যসূত্র: প্রথম অলো