পূর্ব সুন্দরবনের মৃগমারী এলাকার শেলা নদীতে গতকাল মঙ্গলবার তেলবাহী একটি কার্গো জাহাজ ডুবে গেছে। ভোরে ঘন কুয়াশার মধ্যে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় জাহাজটি ডুবে যায়। জাহাজটির ট্যাংকারে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েল ছিল। সেই তেল এখন নদীতে ছড়িয়ে পড়ছে। জোয়ার-ভাটার টানে নদী, সংলগ্ন খাল ও বনের গাছগাছালির গায়ে ইতিমধ্যে তেলের মোটা আস্তর জমা হতে শুরু করেছে। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করছে বন বিভাগ। মৃগমারী বিলুপ্তপ্রায় ইরাবতী ডলফিনের অভয়ারণ্য।
ডুবে যাওয়া কার্গো জাহাজটির নাম ‘এমটি সাউদার্ন স্টার ৭’। গোপালগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য ট্যাংকারে করে তেল নিয়ে যাচ্ছিল জাহাজটি। এতে সাতজন নাবিক ছিলেন। ডুবে যেতে দেখে তাঁরা নদীতে লাফ দেন। তাঁদের মধ্যে ছয়জন সাঁতরে তীরে উঠতে পারলেও চালক (মাস্টার) মোখলেসুর রহমান নিখোঁজ রয়েছেন।
জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান মেসার্স হারুন অ্যান্ড কম্পানির ব্যবস্থাপক গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘সোমবার বিকেলে কার্গো জাহাজটি খুলনা থেকে ছেড়ে আসে। খুলনার পদ্মা অয়েল কম্পানি থেকে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস অয়েলবোঝাই ট্যাংকার নিয়ে জাহাজটি গোপালগঞ্জ বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে যাচ্ছিল। ঘন কুয়াশার কারণে সোমবার জাহাজটি শেলা নদীতে নোঙর করে ছিল। আজ (গতকাল) ভোর ৪টার দিকে বিপরীত দিক থেকে আসা এমটি টোটাল নামের আরেকটি খালি কার্গো জাহাজ আমাদের জাহাজটিকে সামনে থেকে ধাক্কা দেয়। এতে জাহাজটির মাথার অংশ ডুবে যায়, আর তেল বের হতে শুরু করে।’ তবে তিনি কার্গোটির উদ্ধার তৎপরতা সম্পর্কে কোনো পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেননি। শুধু বলেছেন, ‘আমরা কার্গোটি উদ্ধারের চেষ্টা করছি।’
ট্যাংকার ডুবে তেল ছড়িয়ে পড়ছে গোটা সুন্দরবনে
খুলনা থেকে মংলা হয়ে জয়মণি গোল এলাকা থেকে ট্রলার নিয়ে গতকাল শেলা নদীর দিকে যাওয়ার সময় জোয়ারের পানিতে তেল ভাসতে দেখা যায়। নদীসংলগ্ন বনের গাছগাছালির পাশে তেলের আস্তর চোখে পড়ে। ভাসমান শেওলা তেলের রঙে রঙিন হয়ে গেছে। নদীর তীরবর্তী গাছপালার গোড়ায় তেলের আস্তর জমতে শুরু করেছে। জোয়ার-ভাটার টানে শেলা নদীর সংযোগকারী খালগুলো বেয়ে তেল ছড়িয়ে পড়ছে অনেক দূর পর্যন্ত।
জয়মণি গোল মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের শেষ জনবসতি। এটি চাঁদপাই রেঞ্জের মধ্যে পড়েছে।
সুন্দরবন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক আবুল কালাম আজাদ গতকাল বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, ট্যাংকারটির সামনের অংশ ডুবে আছে, পেছনের অংশ পানির ওপরে ভাসছে। তাঁর ধারণা, ট্যাংকারের প্রায় সব তেলই ভেসে গেছে।
জীববৈচিত্র্যের হুমকি সম্পর্কে তিনি বলেন, সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জোয়ার-ভাটার টানে তেল আরো ছড়িয়ে পড়বে। এতে এ এলাকার পানিতে ডলফিন, কুমির, মাছ এবং অন্যান্য প্রাণী ছাড়াও ডাঙার বানর ও হরিণের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। তেল পানির দূষণ ঘটাবে। এতে যেমন জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি নদী ও খালসংলগ্ন উদ্ভিদের সংস্পর্শে এসে সেই তেল শ্বাসমূল, পাতা-গুল্মরাজির ক্ষতি করবে। আর তা খেয়ে বনের প্রাণিকুলের ক্ষতি হবে।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক দিলীপ কুমার দত্ত গতকাল বলেন, এত তেল পানিতে ভেসে থাকায় উপকূলীয় জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। সুন্দরবনের মতো শ্বাসমূলীয় বনের গাছপালা শ্বাসমূল দিয়ে শ্বাস নেয়। তেলের আস্তর জোয়ারের সময় মাটির ওপরে ছড়িয়ে যাবে। ফলে গাছের শ্বাসপ্রশ্বাস বাধাগ্রস্ত হবে, গাছ মারা যাবে। তেল পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেবে এবং মাছসহ জলজ প্রাণীও অক্সিজেনের ঘাটতিতে ভুগবে। তিনি বলেন, দেশের ভাটি এলাকায় পানির ভালো প্রবাহ না থাকায় সাগর থেকে উঠে আসা জোয়ার-ভাটা দ্রুত এই বর্জ্য অপসারণ করতে পারবে না। এর ফলে সুন্দরবনের প্রাণিসম্পদের ওপর এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে।
তবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক এ কে ফজলুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, শীতকাল বিধায় ক্ষতির পরিমাণ কিছুটা কম হবে। কারণ শীতে জোয়ার-ভাটার তারতম্য হয়। তবে জোয়ার-ভাটার কারণে তেল বনের ভেতর গিয়ে আটকে গেলে উদ্ভিদ ও স্থলচর প্রাণীর ক্ষতির আশঙ্কা বেশি। আর ছড়িয়ে পড়া তেলে পানিতে দূষণ দেখা দিলে জলজ প্রাণী এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। দীর্ঘমেয়াদে কী পরিমাণ ক্ষতি হবে, তা সরেজমিন দেখে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া বলা যাবে না।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের কর্মকর্তা মো. আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, ‘এলাকাটি ইরাবতী ডলফিনের অভয়ারণ্য। গাঙ্গেয় এ বিশেষ বৈশিষ্ট্যের ডলফিন রক্ষায় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে আমরা বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছি; কিন্তু তেলে পানিদূষণের ফলে খুবই স্পর্শকাতর প্রাণী ডলফিন যেমন মারা যেতে পারে, তেমনি এ এলাকা ছেড়ে চলেও যেতে পারে।’ এখানে ছয় ধরনের ডলফিনের আবাস বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তবে ডুবে যাওয়া ট্যাংকারের তেলে জীববৈচিত্র্য মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়লেও জাহাজটি উদ্ধারে কার্যত কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষ থেকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে দাবি করা হলেও গতকাল বিকেল সোয়া ৪টা পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। বন বিভাগের পক্ষ থেকে ট্রলারে নজরদারি করা হচ্ছে। বন বিভাগ মংলা থানায় এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে। পাশাপাশি বন আইনে মামলা করেছে। ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষও একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে।
প্রসঙ্গত, আগে মংলা নদী হয়ে গাবখান চ্যানেল দিয়ে কার্গো-টাগ ও অন্যান্য পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করত। তবে ওই নৌপথ শুকিয়ে যাওয়ায় সুন্দরবনের বুক চিরে এই নৌপথ দিয়ে মালবাহী জাহাজ চলাচল করছে। কিন্তু বনের ভেতর দিয়ে এভাবে তেলবাহী ট্যাংকার ও মালবাহী কার্গো জাহাজ চলাচল করলে তা জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করবে বলে বিভিন্ন পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছিল; তবে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার খান মোহম্মদ আখতারুজ্জামান কার্গোডুবি প্রসঙ্গে বলেন, কার্গোটি বন্দর চ্যানেলের বাইরে ডুবেছে। এতে বন্দর চ্যানেলের কোনো ক্ষতি হবে না।
এর আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর ৬০০ টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে একটি কার্গো জাহাজ পশুর চ্যানেলের জয়মণি গোল এলাকায় ডুবে যায়। তার আগে ১২ সেপ্টেম্বর পশুর চ্যানেলের হাড়বাড়িয়া এলাকায় প্রায় ৬৩০ টন সিমেন্টের কাঁচামাল নিয়ে এমভি হাজেরা-২ নামের একটি কার্গো জাহাজ ডুবে যায়। সেই জাহাজ দুটি এখনো চ্যানেল থেকে তোলা যায়নি।
মংলা বন্দরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র বলে, ‘এ ধরনের কার্গো উদ্ধারের সক্ষমতা আমাদের খুবই কম। আর ছড়িয়ে পড়া তেল নিয়ন্ত্রণে আনার মতো কারিগরি দক্ষতা আমাদের একেবারে নেই বললেই চলে।’