চমক ধরে রাখলো ক্রোয়েশিয়ার গোল্ডেন জেনারেশন। নাটকীয়তা শেষে স্বাগতিক রুশদের থমকে দিয়ে সেমিফাইনালের টিকিট কাটলো বোবান-সুকারদের উত্তরসূরিরা। গতরাতে আসরের শেষ কোয়ার্টার ফাইনালে রাশিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে (৪-৩) জয় কুড়ায় ক্রোয়েশিয়া। ৯০ মিনিটে ১-১ ও ১২০ মিনিটের লড়াই শেষে ২-২ গোলের সমতায় খেলা শেষ করে দু’দল। ১৯৯৮’র বিশ্বকাপে প্রথমবার সেমিফাইনালে খেলার গৌরব কুড়ায় ক্রোয়েশিয়া। ১৯৯২ সালে সাবেক যুগোস্লাভিয়া থেকে স্বাধীন হওয়া ক্রোয়েশিয়ার এটিই ছিল প্রথম বিশ্বকাপ।
সেবার সেমিফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ২-১ গোলে হার নিয়ে স্বপ্নযাত্রা থামে ক্রোয়াটদের। আসরে ৬ গোল নিয়ে গোল্ডেন বুট পুরস্কার জেতেন ক্রোয়াট স্ট্রাইকার ডেভর সুকার। তবে এবার এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ খোলা মদরিচ-রাকিটিচ-মানজুকিচদের সামনে। আগামী ১১ই জুলাই সেমিফাইনালে মস্কোর লুঝনিকি মাঠে ইংল্যান্ডে মুখোমুখি হবে ক্রোয়াটরা।
বিশ্বকাপে রুশদের সেমিফাইনালে খেলতে দেখা গিয়েছিল একবারই। ইংল্যান্ডে ১৯৬৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওয়েস্ট জার্মানির বিপক্ষে ২-১ গোলে হার নিয়ে শিরোপার স্বপ্ন ভাঙে রুশদের (১৯৯০ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ছিল সাবেক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ । আর রুশদের বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলতে দেখা গেল ৪৮ বছরে প্রথমবার। সর্বশেষ ১৯৭০ বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালের কৃতিত্ব দেখায় রুশরা। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে পা রাখা শেষ পাঁচ আয়োজক দেশের প্রত্যেকেই দেখিয়েছে সেমিফাইনালে খেলার কৃতিত্ব (ইতালি ১৯৯০, ফ্রান্স ১৯৯৮, দক্ষিণ কোরিয়া ২০০২, জার্মানি ২০০৬ ও ব্রাজিল ২০১৪) ।
গতরাতে সোচি স্টেডিয়ামে শুরুর পাঁচ মিনিটে দুইবার সুযোগ তৈরি করে রাশিয়া। তবে সুযোগ কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন আরতেম জিউবা ও ডেনিস চেরিশেভ। খোলস ছেড়ে বের হয় ক্রোয়াটরাও। ষষ্ঠ মিনিটে ডানপ্রান্ত দিয়ে বল পায়ে রাশিয়ার ডি বক্সে ঢুকে পড়ে গোলে শট নেন আন্তে রেবিচ। কর্নারের বিনিময়ে রক্ষা পায় রাশিয়া। কর্নার থেকে পাওয়া সুযোগে লিভারপুল তারকা দেইয়ান লভরেনের মাথা ঘুরে রেবিচের হেড বার উঁচিয়ে বাইরে যায়। ১১তম মিনিটে বার উঁচিয়ে যায় ক্রোয়াট স্ট্রাইকার মারিও মানজুকিচের শট। এক প্রতি-আক্রমণে সুযোগ আতে রুশদের সামনে। কিন্তু সুযোগ নিতে ব্যর্থ হন জিউবা । ৩১তম মিনিটে বল পায়ে ঝলক দেখায় রুশরা। জিউবার সঙ্গে দারুণ লেনদেন শেষে ডি বক্সের বাইরে থেকে দর্শনীয় শটে গোল আদায় করেন চেরিশেভ। চলতি আসরে এটি চেরিশেভের চতুর্থ গোল। আসরে শুরুর দুই ম্যাচে তিন গোল পান স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের ‘একাডেমি বয়’ চেরিশেভ। পরের ৮ মিনিটে বল পায়ে চড়াও হয়ে আরো একাধিক সুযোগ তৈরি করে রুশরা। তবে ব্যবধান বাড়াতে ব্যর্থ রুশরা এতে দেয় মূল্যও। অরক্ষিত রুশ ডিফেন্সের বিপক্ষে এক কাউন্টার অ্যাটাকে বল নিয়ে বাম প্রান্ত দিয়ে ঢুকে পড়েন মারিও মানজুকিচ। তার উড়ন্ত ক্রসে ফাঁকায় দর্শনীয় হেডে গোল নিয়ে ক্রোয়েশিয়াকে সমতায় ফেরান স্ট্রাইকার আন্দ্রে ক্রামারিচ। পুরো প্রথমার্ধের খেলায় রুশ গোলপোস্টে ক্রোয়াটরা শট নেয় ছয়বার। আর বিরতি থেকে ফিরে শুরুর ২০ মিনিটে সাতবার প্রতিপক্ষ গোলবারে শট নেয় ক্রোয়াটরা। এতে সেরা সুযোগ নষ্ট করেন ইভান পেরিসিচ। ছোট ডি বক্সের মাথা থেকে নেয়া পেরিসিচের শট রুশ গোলরক্ষক ইগর আকিনফিয়েভকে ফাঁকি দিলেও বল প্রতিহত হয় গোলপোস্টে। ক্রোয়েশিয়ার মাঝমাঠে সেরা নৈপুণ্যটা ছিল সেই লুকা মদরিচের। রিয়াল মাদ্রিদ তারকা মদরিচ ম্যাচের শুরুর ৬৫ মিনিটে বল স্পর্শ করেন সর্বাধিক ৬৮বার। প্রতিপক্ষ অর্ধে সর্বাধিক ৪৮বার সফল পাস দেয়া ছাড়াও সর্বাধিক ৯ বার বলদখলের লড়াইয়ে জয়ী হতে দেকা যায় ক্রোয়েশিয়া অধিনায়ককে। ৭২তম মিনিটে সুযোগ আসে রাশিয়ার। কিনতু ডান দিক থেকে মারিও ফারনানদেজের ক্রসে বদলি খেলোয়াড় ফেদর স্মলভের হেড বার উঁচিয়ে বাইরে যায়। ম্যাচ অতিরিক্ত সময়ে গড়ানোর আগে ৬৭% বলদখল নিয়ে প্রতিপক্ষ গোলবারে ক্রোয়াটরা শট নেয় ১৬বার। তবে এর মাত্রই দু’টি শট ছিল বারপোস্ট বরাবর। অতিরিক্ত সময়ের দশম মিনিটে ভক্ত সমর্থকদের উল্লাসে ভাসান মদরিচ-রাকিটিচরা। কর্নার থেকে পাওয়া সুযোগে শূন্যে লাফিয়ে হেডে গোল আদায় করেন ডিফেন্ডার দোমাগো ভিদা। ১১২তম মিনিটে প্রতিপক্ষ স্ট্রাইকারের জোরালো শট লুফে নিয়ে দলকে বিপদ মুক্ত করেন গোলরক্ষক সুবাসিচ। ২ মিনিট পর ফের রাশিয়ার প্রচেষ্টা নস্যাত করেন তিনি। শেষ ষোলো রাউন্ডে টাইব্রেকারে তিন শট রুখে দিয়ে দলকে কোয়ার্টার ফাইনালে তুলে নেন সুবাসিচই। তবে ১১৫তম মিনিটে কানায় কানায় ভরা গ্যালারিতে প্রাণ ফেরান রাশিয়ার ব্রাজিলিয়ান বংশোদ্ভূত স্ট্রাইকার ফিগুইরা ফারনানদেস। ফ্রি কিক থেকে পাওয়া সুযোগে ফারনানদেসের দারুণ হেডের গোলে সমতায় ফেরে রাশিয়া।
বিশ্বকাপে রুশ-ক্রোয়াটদের এটি ছিল প্রথম সাক্ষাত। আগের তিনবারের সাক্ষাতে ক্রোয়েশিয়াকে এক ম্যাচেও হারাতে পারেনি রাশিয়া। গোলশূন্য ড্রতে শেষ হয় দুই ম্যাচ। আর পরস্পর সাক্ষাতে ক্রোয়েশিয়ার একমাত্র জয়টি ছিল আলাদা তাৎপর্যের। সবশেষ লড়াইয়ে ২০১৫ সালে প্রীতি ম্যাচে রাশিয়ার রোস্তভ-অন-ডন মাঠ থেকে ৩-১ গোলের জয় নিয়ে ফেরে ক্রোয়াটরা। ওই ম্যাচের প্রথমার্ধে ফেদর স্মলভের গোলে এগিয়ে ছিল রাশিয়াই। তবে দ্বিতীয়ার্ধে গোল আদায় করেন ক্রোয়েশিয়ার তিন তারকা নিকোলা কালিনিচ, মার্সেলো ব্রজোভিচ ও মারিও মানজুকিচ। ২০০৮ ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের (ইউরো) বাছাইপর্বে রাশিয়া-ক্রোয়েশিয়ার হোম ও অ্যাওয়ে ম্যাচ দুইটি গোলশূন্য ড্রতে শেষ হয়।
রাশিয়ায় গ্রুপ পর্বে টানা তিন জয় নিয়ে শেষ ষোলো রাউন্ডের টিকিট কাটে ক্রোয়েশিয়া। এতে তারা দাপুটে নৈপুণ্যে ৩-০ গোলে বিধ্বস্ত করে বিশ্বসেরা ফুটবলার লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনাকে। আর শেষ ষোলো রাউন্ডে ডেনমার্কের সঙ্গে ১২০ মিনিটের খেলায় ১-১ গোলের সমতা শেষে টাইব্রেকারে জয় দেখে ক্রোয়াটরা। শেষ ষোলো রাউন্ডে ‘টাইব্রেকার ভাগ্য’ প্রসন্ন ছিল রাশিয়ারও। ২০১০’র চ্যাম্পিয়ন স্পেনের সঙ্গে ১-১ সমতা শেষে টাইব্রেকারে জয় দেখে রুশরা। গ্রুপে নিজেদের শুরুর দুই ম্যাচে সৌদি আরব (৫-০) ও মিশরের (৩-১) বিপক্ষে জয়ী হয় রাশিয়া। তবে উরুগুয়ের কাছে ৩-০ গোলে হার নিয়ে গ্রুপ পর্ব শেষ করে স্বাগতিকরা।