ইলিশের ঢল আসছে

Slider ফুলজান বিবির বাংলা

75e99ea4afaa608b478dc845689b85e7-5b3daaca04867

ঢাকা: কাগজে-কলমে ইলিশ মাছের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। তবে হাতের নাগালে ইলিশ আসি আসি করেও যেন আসছে না। তাই বলে বাজারে যে ইলিশ নেই তা নয়। তবে সেসব ইলিশ কিনতে গেলে পকেট থেকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি টাকা খসে যায়। ইলিশপ্রেমীদের জন্য সুখবর হচ্ছে, কম টাকায় বেশি ইলিশ কেনা শুরু হতে যাচ্ছে শিগগিরই। এ মাসের শেষ দিকে আসছে ইলিশের ঢল।

মৎস্য অধিদপ্তর ও বিশেষজ্ঞদের তথ্য মতে, বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি নদনদীগুলোতে ইলিশ মাছ আসা শুরু করেছে। বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী ও সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীগুলোতে এখন বিচ্ছিন্নভাবে ধরা পড়ছে ইলিশ। এ মাসের শেষের দিকেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ওপরের দিকে আসতে শুরু করবে। ওই সময় চাঁদপুর পর্যন্ত নামবে ইলিশের ঢল। মাছ ব্যবসায়ী, খুচরা বিক্রেতারা এখন প্রস্তুতি নিচ্ছেন সেই সময়ের। অপেক্ষায় আছেন ক্রেতারাও। ইলিশের জন্য চাঁদপুর হচ্ছে কেন্দ্রস্থল। ভোলা, বরিশাল ও নোয়াখালী থেকে ইলিশভরা নৌকা চাঁদপুরের ঘাটে আসে। চট্টগ্রাম থেকেও আসে কিছু। এই ঘাটে ইলিশগুলো নামার পর তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে চলে যায়।

ইলিশ বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের মতে, এবার ইলিশ কিছুটা দেরিতে আসছে। আবহাওয়া ও পানির তাপমাত্রাসহ বেশ কিছু বিষয় ব্যাপকভাবে ইলিশ আসার ক্ষেত্রে উপযোগী না হওয়ায় প্রায় মাস খানিক দেরি হয়ে গেছে।

যদিও এই ব্যাপারে এক মত নন মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তাঁদের ভাষ্য, জুলাইয়ের শেষ দিকে বা আগস্টের শুরুতেই ইলিশের ঢল নামার কথা। এর বাইরে এখনো বিভিন্ন বাজারে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এম নিয়ামুল নাসের বলেন, এবার ইলিশের ঝাঁক দেরিতে আসছে বলেই মনে হচ্ছে। এ সময়েই প্রচুর ইলিশ পাওয়া যাওয়ার কথা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইলিশ এখনো বঙ্গোপসাগরের দিকে অবস্থান করছে। বরিশাল ও ভোলার নদ নদী এবং সুন্দরবনের পশুর ও রূপসা নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে এখন। মাছগুলো এখনো ওপরের দিকে আসেনি। এ কারণে চাঁদপুর এবং এর পরে পদ্মা পর্যন্ত এখনো ইলিশের দেখা পাওয়া যাচ্ছে না।তিনি বলেন, এই সময়েই ইলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ার কথা। ধারণা করা যায়, ইলিশের ক্ষেত্রে আবহাওয়ায় যেসব নিয়ামক থাকা প্রয়োজন তার সবগুলো না মেলায় এবার সময়ের চেয়ে কিছুটা দেরিতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পানির মধ্যে তাপমাত্রার পরিবর্তন হয়। সেই পরিবর্তন এবং পানিতে অক্সিজেনের প্রাপ্যতা ইত্যাদি ইলিশের ঝাঁক আসার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে পুরোপুরি উপযোগী অবস্থায় নেই বলে মনে করা হচ্ছে।

ড. এম নিয়ামুল নাসের আরও বলেন, ইলিশ সারা বছরই অল্প বিস্তর আসে। বর্ষাকালে ও শীতকালে প্রজনন হয় ইলিশের। প্রজননের সময় নদীতে ইলিশ আসায় বেশি ধরা পড়ে। ইলিশের জন্য গভীর পানি প্রয়োজন। বর্ষায় পানির প্রবাহ থাকে বেশি। উজানের বৃষ্টিপাত ইলিশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এবার বর্ষা আগে ভাগে এসেছে। সে ক্ষেত্রে গতবারের চেয়েও এবার ইলিশ বেশি পাওয়া যেতে পারে। গতবার আগাম বন্যার কারণে রাজশাহীর গোদাগাড়ি, আসাম ও ফারাক্কা বাঁধের নিচে প্রচুর ইলিশ পাওয়া গেছে।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দের মাছ ব্যবসায়ী বাদল বিশ্বাস বলেন, হিসাব অনুযায়ী এখন ইলিশের মৌসুম। তবে এখনো ইলিশ তিনি সেভাবে পাচ্ছেন না। বরিশাল থেকে কিছু ইলিশ এনে বিক্রি করছেন। তবে সেগুলোর দাম চড়া। এক কেজি ওজনের ইলিশের দাম ১৮০০ টাকা। ইলিশের ঢল নামলে এই দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে বলে জানান তিনি। ছোট আকারের মাছ বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা কেজি দরে।

মৌসুম হলেও এখন ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক ভাবেই নেই। প্রাকৃতিক বিষয় এখন উলটপালট হয়ে গেছে। আমার বাবা যখন ব্যবসায়ী ছিলেন, তখন আষাঢ় মাসেই ব্যাপক ইলিশ ধরা পড়ত। আষাঢ়ে ইলিশ হিসেবেই সেগুলোর নাম ছিল। এখন তেমন ইলিশ পেতে আষাঢ় মাস পার হয়ে যায়। আগে শীত কালে ইলিশ পাওয়া যেত না। এখন শীতেই বেশি ইলিশ ধরা পড়ে।’

এবারও সময় মতোই ইলিশ আসছে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞ ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ শাখার প্রধান ও জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এ বি এম জাহিদ হাবিব। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ইলিশের মৌসুম এসে গেছে, মাছ নেই- বিষয়টি মোটেও তা নয়। জুলাইয়ের শেষ দিকে বা আগস্টের শুরুতেই ইলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়ে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না। এ মাসের শেষের দিকে বিপুল পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়বে বলে আশা করা যাচ্ছে। আষাঢ়, শ্রাবণ মাসের গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির পানি নদী থেকে সাগরে যাবে। সেই পানির টানেই ইলিশের ঝাঁক আসবে। ইলিশের জন্য এবার আবহাওয়া সম্পূর্ণ অনুকূলেই আছে।

তিনি বলেন, ‘এখনো বাজারে বেশ ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে। রোববার আমি নিজে কারওয়ান বাজারে গিয়ে অন্তত ১০টি দোকানে প্রচুর ইলিশ দেখেছি।’

গতকাল সোমবার বিকেলে রাজধানী ঢাকার কাওরানবাজারে গিয়ে দেখা যায়, ১০-১২ টি দোকানে অল্প কিছু সংখ্যক ইলিশ মাছ বিক্রি হচ্ছে। তবে দাম বেশি বলে স্বীকার করছেন বিক্রেতারাই।

সেখানে মো. সুমন নামে এক মাছ বিক্রেতা জানান, তিনি সাত শ গ্রাম ওজনের চারটি ইলিশ দুই হাজার ৬০০ টাকায় বিক্রি করছেন। সাড়ে আটশো গ্রাম ওজনের চারটি ইলিশ বিক্রি করছেন তিন হাজার ২০০ টাকায়। তিনি বলেন, ‘এখন আমরা কয়েকজন শুধু ইলিশ বিক্রি করছি। মাছ আসা শুরু হলে এই বাজারের সব বিক্রেতার কাছেই ইলিশ পাওয়া যাবে। দামও কম হবে।’

গত বছর ভরা মৌসুমে ইলিশের আধিক্য ছিল অন্যতম আলোচিত ঘটনা। চার দশকে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। মৎস্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯৮ হাজার টন ইলিশ মাছ উৎপাদিত হয়েছে। পরের বার ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে ৪ লাখ ৯৪ হাজার মেট্রিক টন। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ নদ-নদী থেকে যে পরিমাণ ইলিশ আহরণ করা হয়, এর দ্বিগুণ পরিমাণ সাগর থেকে আসে।

মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এবার জাটকা নিধনে কড়াকড়ি থাকায় গত বারের মতো এবারও বড় আকারের ইলিশ অনেক বেশি পরিমাণে পাওয়া যাবে। গত বছরের নভেম্বর থেকে এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত আট মাস জাটকা ধরা নিষিদ্ধ ছিল।

পরিপক্ব ইলিশ সংরক্ষণের সময় নির্ধারণের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে:

ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য নদীতে আসে। ইলিশের প্রজনের সঙ্গে পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সম্পর্ক রয়েছে। তাই চাঁদের ওপর হিসাব কষে পরিপক্ব বা মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য সরকার প্রতি বছর সময় নির্ধারণ করে থাকে। এ কারণে প্রতি বছরই এ সংক্রান্ত বিধি সংশোধন করতে হয়।

মৎস্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, অক্টোবর মাসের দিকে ইলিশ ডিম পাড়ার জন্য নদীতে আসে। পরিপক্ব ইলিশ সংরক্ষণের জন্য ২২ দিন সময় নির্ধারণ করে ওই সময় মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। এবারও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠক করে অক্টোবরের নির্দিষ্ট ২২ দিনের একটি প্রস্তাব মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে বিধি সংশোধনের জন্য যাবে। এরপরই চূড়ান্ত তারিখ জানানো হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *