কোটা সংস্কার আন্দোলনে গ্রেপ্তার ছাত্রদের দায় নেবে না বিশ্ববিদ্যালয়

Slider শিক্ষা সারাদেশ

6bce26e31ad1736533d0b7b728731705-5b3da8bda478a
ঢাকা:কোটা সংস্কার আন্দোলনে গ্রেপ্তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দায় নিতে চাচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা যে আন্দোলন করে আসছেন, সেই আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে মনে করছেন তাঁরা। গতকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বিভাগে ক্লাস-পরীক্ষা চললেও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা ক্যাম্পাসে ফিরতে পারেননি।
গ্রেপ্তার ছাত্রদের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রেপ্তার আছে নাকি? যা হবে আইনি কাঠামোর মধ্যেই হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় ১৮ বছর বয়স হলে ব্যক্তিকে তার নিজের দায়দায়িত্ব নিতে হয়। সবার জন্যই এই আইন প্রযোজ্য।’ তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের কাঁধে ভর দিয়ে যেন কোনো অশুভ শক্তি তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে না পারে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক কার্যক্রম বিনষ্ট করার কোনো অপপ্রয়াস সহ্য করা হবে না।
প্রক্টর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ছাত্রদের গ্রেপ্তার, তাঁদের ওপর হামলার বিষয়গুলো এড়িয়ে চলেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর এ কে এম গোলাম রব্বানী ছাত্রদের এ আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মাকসুদ কামাল বলেছেন, শিক্ষক সমিতির কাজ শিক্ষকদের স্বার্থ দেখা। তা ছাড়া তাঁরা শিক্ষা কার্যক্রম ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের বিষয়টা দেখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের গ্রেপ্তারের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানে।

পুলিশ গতকাল পর্যন্ত ১০ জনের গ্রেপ্তারের খবর নিশ্চিত করেছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন রাশেদ খান, ফারুক হোসেন, তরিকুল, জসিমউদ্দিন, মশিউর, আমানুল্লাহ, মাজহারুল, জাকারিয়া, রমজান ওরফে সুমন ও রবিন। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, একজন এখনো নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁরা হলেন রাশেদ খান, ফারুক হোসেন ও মশিউর। নিখোঁজ ছাত্রের নাম মাহফুজ। অন্যদের পরিচয় এখনো পুলিশ নিশ্চিত করেনি।
রাশেদ খান তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার হয়ে পুলিশি হেফাজতে আছেন। অন্যদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে গত ১০ এপ্রিল শাহবাগ থানায় দায়ের হওয়া তিনটি মামলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা, পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যের মোটরসাইকেল ভাঙচুর ও ওয়াকিটকি কেড়ে নেওয়ার অভিযোগে ওই মামলাগুলো দায়ের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা, পুলিশের বিশেষ শাখার একজন সহকারী উপপরিদর্শক ও শাহবাগ থানার পুলিশ।
আইন অনুষদ ছাড়া গতকাল বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সব বিভাগে ক্লাস ও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। টিএসসিতে আবৃত্তি ও নাটকের কর্মশালার জন্য সদস্য সংগ্রহেও যুক্ত থাকতে দেখা গেছে শিক্ষার্থীদের। স্বাভাবিক সময়ের মতো বিভিন্ন রুটে

চলাচলকারী বাসগুলোতে বাদুড়ঝোলা হয়ে শিক্ষার্থীদের যাতায়াত করতেও দেখা গেছে।

কোটা সংস্কারের দাবিতে গঠিত বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ ছাত্রেরই ঢাকায় থাকার কোনো জায়গা নেই। আন্দোলনে যুক্ত হলে হলছাড়া করা হবে, এমন হুমকি দিয়ে ছাত্রদের চুপ করিয়ে রাখা হয়েছে।

এর মধ্যে গতকালই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক ছাত্র একরামুল হককে হল থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। আইন অনুষদের ছাত্ররা বলছিলেন, তাঁরা ফেসবুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পরিবারের এই পেজ থেকে ক্লাস বর্জনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। আইন অনুষদের ঠিক উল্টো পাশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছাত্রদের ওপর হামলার প্রতিবাদে তাঁরা এই কর্মসূচি নিয়েছিলেন। এরপর থেকেই তাঁরা ক্লাসে ফিরে যাওয়ার জন্য হুমকি পাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের নেতারা একরামুল হককে বের করে দেন।
জানতে চাইলে বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক নাইমা হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসছে না এটা ঠিক। কিন্তু সামনে তাদের পরীক্ষা। সাধারণত পরীক্ষার কয়েক দিন আগে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসে না।’
ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ওঠা হামলার অভিযোগ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, বিষয়টা প্রক্টরকে দেখতে বলা হয়েছে।

আহতদের শারীরিক অবস্থার উন্নতি নেই
গত শনিবার ছাত্রলীগের হামলায় মারাত্মক আহত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র নুরুল হকের শারীরিক অবস্থার কোনো উন্নতি নেই। ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে নুরুল হক চিকিৎসাধীন আছেন। গতকাল নুরুল হকের একজন স্বজন প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মারধরের কারণে নুরুলের মাংসপেশির ৪৮ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সংক্রমণও দেখা দিয়েছে। প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর নুরুল হকের জ্বর আসছে, তিনি নড়াচড়া করতে পারছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নুরুল হকের খোঁজ না নিলেও ইংরেজি বিভাগ থেকে তাঁর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

ভালো নেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল ইসলামও। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলামের ডান পা পুরোপুরি ভেঙে গেছে। অস্ত্রোপচার না করলে ওই পা ঠিক হবে না বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। গত সোমবার হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তরিকুলের পা ভেঙে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর লুৎফর রহমান বলেন, তরিকুলের অবস্থা আগের চেয়ে অনেক ভালো। সে পুলিশ হেফাজতে রয়েছে। পুলিশের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন খোঁজখবর রাখছে।

নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় মানববন্ধনে বাধা
কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে গণসংহতি আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলা শাখার উদ্যোগে আয়োজিত মানববন্ধন করতে দেয়নি পুলিশ। গতকাল বিকেলে নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধনের প্রস্তুতির সময় পুলিশ ব্যানার কেড়ে নেয়। তারা মাইকও লাগাতে দেয়নি। এ সময় নেতাদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। বিকেলের আগে থেকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ প্রেসক্লাব এলাকা ঘিরে রাখে। পরে নেতারা নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবে তাৎক্ষণিক প্রেস ব্রিফিং করেন।

গণসংহতি আন্দোলন জেলার সমন্বয়ক তরিকুল সুজনের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, জেলা সিপিবির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, বাসদের জেলা সমন্বয়ক নিখিল দাস প্রমুখ। অংশগ্রহণকারীরা অবিলম্বে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ও গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবি জানান।
খুলনায় দুপুর ১২টার দিকে পিকচার প্যালেস এলাকায় প্রগতিশীল ছাত্রজোট খুলনা জেলা শাখার সমাবেশ ও মিছিলে পুলিশ লাঠিপেটা করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এতে কমপক্ষে ছয়জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র বলেছে, ঘটনাস্থলে আয়োজকেরা পৌঁছানোর আগেই পুলিশ পৌঁছায়। রাস্তায় দাঁড়াতে বিধিনিষেধ আছে জানিয়ে তারা সমাবেশকারীদের ব্যানার ও হ্যান্ডমাইক কেড়ে নেয়। এরপরও সংগঠনটির নেতা-কর্মীরা বক্তব্য দিতে চাইলে পুলিশ লাঠিপেটা করে তাঁদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

জানতে চাইলে খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হুমায়ুন কবির বলেন, সমাবেশকারীদের ওপর কোনো লাঠিপেটা করা হয়নি। তাঁরা সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছিলেন। এ কারণে তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *